ঠাকুরগাঁও প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:৫২ পিএম
ঠাকুরগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হলো কারাম উৎসব। ছবি : সংগৃহীত
ঠাকুরগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হলো ওরাঁও,সাঁওতালসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নানা সম্প্রদায়ের কারাম উৎসব। পরিবারের সুখ-শান্তি ও নিজেদের সুস্থতা কামনায় কারাম নামের একটি বিশেষ বৃক্ষের বন্দনার মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করা হয়।
গত সোমবার রাতে সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের পাঁচপীরডাঙ্গা গ্রামে শুরু হয় এ উৎসব। মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) কারাম গাছের পূজা-অর্চনা শেষে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এই উৎসবের সমাপ্তি হয়। দিনের বেলা উপোস এবং উপোস ভাঙার পর নাচ, গান ও পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে দুই দিনব্যাপী চলে এ উৎসব। বর্ষায় খাল-বিল, নদী-নালায় পূর্ণতা আসে। গাঢ় সবুজ রং নিয়ে প্রকৃতিতে আসে তারুণ্য। খাল-বিলে ফোটে শাপলা-শালুক। ধান লাগানোর পর আদিবাসী সম্প্রদায়ের অফুরন্ত অবসর। ঠিক সেই সময়ে ভাদ্র মাসে আসে তাদের অন্যতম বার্ষিক এ উৎসব।
মূলত ভাদ্রের শেষে এবং আশ্বিনের শুরুতে ওরাঁও জনগোষ্ঠী এই উৎসব আয়োজন করে। ওরাঁওদের হিসেবে ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। উৎসবে গাছ দেবতা যেন সামনের বছরে ভালো ফসল দেন সে প্রার্থনা করা হয়। এই গাছ ঘিরে চলে আরাধনার গান। সবাই গানের সুরে সুর মিলিয়ে গাছ দেবতার প্রার্থনা করেন। দেবতার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ধান, সর্ষে দানা, কলাই, গমসহ নানা ফসলের বীজ গাছের গোড়ায় রাখা হয়। গাছ দেবতা যেন সামনের বছর ভালো ফলন দেন, সে প্রার্থনা করে রাতভর চলে নৃত্যগীত ও হাড়িয়া পান।
বিমল কেরকেটা নামে একজন জানান, কারাম উৎসব উদযাপনের জন্য নর-নারী সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পূজার প্রথম দিন উপোস থাকে। সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় বিশেষ খাবার। সৃষ্টিকর্তার প্রতি উৎসর্গ করার পর সেগুলো আমন্ত্রিত অতিথি ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সারা দিন আদিবাসী মেয়েদের উপোসের মধ্য দিয়ে কারাম পূজা শুরু হয়। পরে তারা মাদল, ঢোল, করতাল ও ঝুমরির বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে এলাকার গাছ থেকে কারামগাছের (খিল কদম) ডাল তুলে আনে। এরপর তারা একটি পূজার বেদি নির্মাণ করে।
তিনি জানান, সূর্যের আলো পশ্চিমে হেলে গেলে সেই কারামগাছের ডালটি পূজার বেদিতে রোপণ করা হয়। আদিবাসী পুরোহিত উৎসবের আলোকে ধর্মীয় কাহিনী শোনান। সে সঙ্গে চলে কাহিনীর অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যা শেষ হলে বেদির চারধারে ঘুরে ঘুরে যুবক-যুবতীরা নাচতে থাকে। এদিকে পুরোহিতের ধর্মীয় কাহিনী পাঠ শেষ হওয়ার পর উপোস রাখা মেয়েরা পরস্পরকে খাবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে উপোস ভাঙে। এরপরই আপ্যায়ন করা হয় আমন্ত্রিত অতিথি ও আত্মীয়স্বজনকে। ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে স্থানীয় নদীতে কারাম ডালটি বিসর্জনের মাধ্যমে কারাম উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
মারথা খালকো বলেন, ‘কারাম উৎসব সব থেকে বড় উৎসব। সবার বাড়িতে মেহমান আসে। নতুন জামাকাপড় কিনে দেই ছেলেমেয়েকে। পরে সবাই মিলে নেচে-গেয়ে এই উৎসব পালন করি।’
ঠাকুরগাঁও জেলা আদিবাসী পরিষদের সভাপতি জাকোব খালকো বলেন, ‘সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, বড়াইক, কুর্মি, সিং, পাহান, মাহালিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ রীতিতে কারাম পূজা পালন করে থাকে। কারাম নামের গাছের ডাল কেটে বিভিন্ন প্রাচীন প্রথা মান্য করে এই উৎসব করা হয় বলে এর নাম কারাম উৎসব।’
আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা ইমরান চৌধুরী বলেন, ‘প্রতি বছর নানান আয়োজনে ওঁরাও সম্প্রদায় কারাম উৎসব পালন করে। তবে সমাজের মধ্যে এখনও তারা অবহেলিত। সরকারিভাবে তাদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সাহায্যের প্রয়োজন।’