তালা (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৫২ এএম
১৬ বছর শিকলবন্দি হোসেন আলী। প্রবা ফটো
বাবা-মায়ের আদরের সন্তান হোসেন আলী। বয়স ২৩ বছর। কিন্তু তাকে প্রায় ১৬ বছর ধরে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছে। জন্ম থেকে সে মানসিক ও বাকপ্রতিবন্ধী। অন্যত্র চলে যাওয়ার ভয়ে তাকে প্রতিদিন বাড়ির পেছনের রাস্তার ধারে শিকলবন্দি করে রাখা হয়। তিনি উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শুকদেবপুর গ্রামের দিনমজুর মালেক সরদারের ছেলে।
শিকলবন্দি অবস্থায় পথচারীদের কাছে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে তিনি খাবার চান। তার আকুতি দেখে অনেকেই তাকে খাবারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র দেন। পথচারীদের উপহার পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন হোসেন আলী। শিকলবন্দি এই জীবন কত কষ্টকর সেটা তাকে দেখলে বুঝতে বাকি থাকে না।
হোসেন আলী প্রতিবন্ধী হলেও বাবা-মায়ের কাছে চোখের মণি। দরিদ্র বাবা-মা সাধ্যমতো যত্নে রাখার চেষ্টা করেন তাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হোসেন আলীকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা থাকলেও নির্যাতনের ভয়ে তাকে সেখানে দেননি তারা। নিরুপায় হয়ে বাড়িতে শিকলবন্দি করে রেখেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হামিদ জানান, অনেক কষ্ট করে জীবন পার করছেন হোসেন আলী। তার শিকলবন্দি জীবন দেখে প্রতিবেশীসহ সবার খারাপ লাগে। তবে কিছু করার নেই। কারণ তাকে ছেড়ে দিলে দূরে চলে যান। অনেক দিন কোনো খোঁজ থাকে না। তা ছাড়া আশপাশের শিশুরাও তাকে দেখে ভয় পায়।
বাবা মালেক সরদার বলেন, ‘ছোটবেলায় অন্য শিশুদের থেকে ভিন্ন আচরণ করত হোসেন আলী। সে কথা বলতে পারত না। বিভিন্ন রকম অসংগতিপূর্ণ আচরণ করত। একপর্যায়ে বিভিন্ন ডাক্তার ও কবিরাজ দেখানোর পর জানতে পারি সে প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় তাকে ছেড়ে দিলে বিভিন্ন স্থানে চলে যেত। কয়েক দিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া যেত। তাই বাধ্য হয়ে তাকে প্রায় ১৬ বছর ধরে শিকলবন্দি করে রেখেছি। এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ডাক্তার দেখানোর পরও তাকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা থাকলেও নির্যাতনের ভয়ে পাঠাইনি। শুনেছি সেখানে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।’
মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘তিন ছেলের মধ্যে বড় হোসেন আলী মানসিক প্রতিবন্ধী। সকালে তাকে ঘর থেকে বের করে বাড়ির পেছনে রাস্তার ধারে শিকলবন্দি করে রাখি। সন্ধ্যায় তাকে উঠিয়ে নিজ হাতে গোসল করিয়ে ভাত খাইয়ে ঘরের মধ্যে তালাবন্দি করে রাখি। এটা নিত্যদিনের কাজ। ১৬ বছর ধরে এই কাজ আমি করে আসছি। সে যদি মারা যায় তাহলে আমার কাছে থেকে মারা যাক। তবু তাকে আমি দূরে যেতে দিতে চাই না।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একটি প্রতিবন্ধী কার্ড ছাড়া তার কিছুই নেই। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সুযোগসুবিধা থাকলেও হোসেন আলী তা থেকে বঞ্চিত। অভাবের সংসারে প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে তাদের খুব কষ্টে দিন চলে।
তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, হোসেন আলীর নামে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সরকারি সুবিধা এলে তাকে দেওয়া হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রাজীব সরদার বলেন, হোসেন আলী মানসিক প্রতিবন্ধী। স্থানীয়ভাবে তার ভালো চিকিৎসা সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করে চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। তবে বয়স বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।