প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩ ২১:২৬ পিএম
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৩ ২২:০০ পিএম
বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলমান রয়েছে। সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে শিল্পনগরী গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ-আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) শ্রমিক বিক্ষোভের ১৮তম দিনে গুজবের মুখে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ-শ্রমিক ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে গ্রেপ্তার ও মারধরের গুজবে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শ্রমিকরা। এ ঘটনায় র্যাব-১ আটক করেছে ২৭ জনকে। বেশ কিছু কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা-শিববাড়ি সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন করে শ্রমিকরা। পুলিশ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে শুরু হয় যান চলাচল। এরপর আবারও গাজীপুর মহানগরের বাসন থানা এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিক্ষোভ শুরু করে শ্রমিকরা। আন্দোলনরত শ্রমিকরা মহাসড়কে কাঠ, গাছের গুঁড়ি ও টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করলে পুলিশ টিয়ার শেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
দুপুরের খাবারের বিরতিতে আবারও বিক্ষোভ শুরু করে কোনাবাড়ি বিসিক এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিক। এ সময় তারা মিছিল নিয়ে আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে। তুসুকা গার্মেন্টস লিমিটেড নামের একটি কারখানার শ্রমিকরাও তাদের সঙ্গে তখন রাস্তায় নেমে আসে।
বেলা ৩টায় তুসুকা কারখানার ভেতর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ-র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা শ্রমিকদের ধাওয়া দিলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। উত্তেজিত কিছু শ্রমিক ভেতরে অবস্থান করে কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। বাইরে অবস্থানরত শ্রমিকদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ঘটনায় প্রায় ১৫ জন শ্রমিক আহত হয়েছে। পাশাপাশি ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মোশতাক আহমেদ বলেন, ’শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। কিছু কুচক্রী মহল শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করছে। যেহেতু তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে, আমরা বিশ্বাস করি শ্রমিকরা শান্ত থাকবে।‘
গাজীপুর মহানগরীর উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু তোরাব মোহাম্মদ সামসুর রহমান বলেন, ’শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে বেশ কিছু যানবাহনে হামলা চালিয়েছে। একটি কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর করেছে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।’
গাজীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মুরাদ আলী শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়ে বলেন, ’দুপুরের পর শ্রমিকদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাদের গ্রেপ্তার ও মারধর করা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এরপরই শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়।’
তুসুকা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মাসুম হোসেন বলেন, ’আমাদের সন্দেহ, কিছু বহিরাগত লোক কারখানায় প্রবেশ করে ভাঙচুর চালিয়েছে। আমাদের কারখানার শ্রমিকরা এমন কাজ করেছে বলে মনে হয় না।’
আশুলিয়ায় কাজে যোগ দেয়নি ৩০টি কারখানার শ্রমিক
সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে কাজে যোগ দেয়নি অন্তত ৩০ কারখানার শ্রমিক। টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জামগড়া, ছয়তলা, নরসিংহপুর ও আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকার কারখানাগুলোয় আজ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এই সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সাভার ও আশুলিয়া কমিটির সভাপতি খায়রুল মামুন মিন্টু। তিনি বলেন, ’আজ জামগড়া থেকে জিরাবো এলাকা পর্যন্ত প্রায় সব কারখানা বন্ধ। এর সংখ্যা হবে অর্ধশতাধিক।’
দুপুর পর্যন্ত টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের ইউনিক, শিমুলতলা, জামগড়া, ছয়তলা, নরসিংহপুর ও নিশ্চিন্তপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্বাভাবিক নিয়মেই শ্রমিকরা সকালে কারখানায় প্রবেশ করেন। সকাল সাড়ে ৮টায় দুই থেকে তিনটি কারখানার শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কাজ বন্ধ করে কর্মস্থল ত্যাগ করে। পরে একের পর এক কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এদিকে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সড়কে র্যাব, ঢাকা জেলা পুলিশ ও বিজিবির পর্যাপ্ত উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
স্টারলিং অ্যাপারেলসের এক নারী শ্রমিক বলেন, ’আমরা সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরি মানি না। তাই কারখানায় ঢুকলেও কাজ করিনি। বেতন বৃদ্ধি করা না হলে আমরা কাজ করব না।’
এএম ডিজাইন লিমিটেড কারখানার অপারেটর লিটন বলেন, ’সরকারের তরফ থেকে বেতন বাড়ানোর যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
এদিকে সড়কে মোটরসাইকেল মহড়া দিতে দেখা গেছে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ও নেতাকর্মীদের।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ’সকালে পাঁচ থেকে ছয়টি কারখানার শ্রমিকরা বের হয়েছে। সড়কের পাশের কারখানাগুলো ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। আমাদের পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। ফলে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’
অরবিটেক্স কারখানার ৪২ শ্রমিক অসুস্থ
এদিকে ঢাকার আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করার সময় ৪২ জন শ্রমিক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় অসুস্থ শ্রমিকদের স্থানীয় নারী ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বুধবার সন্ধ্যায় আশুলিয়ার গোরাট এলাকার অরবিটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেড নামের কারখানায় এ ঘটনা ঘটে।
অসুস্থ শ্রমিকদের দাবি, সন্ধ্যার পর হঠাৎ ঝাঁজালো গন্ধে চোখ জ্বালাপোড়া করতে থাকে। অনেকে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। বমিও করে কেউ কেউ। তবে কোনো ধরনের গ্যাসের ধোঁয়া দেখতে পায়নি কেউ।
অসুস্থ এক এক নারী শ্রমিক বলেন, ’দুপুরের খাবারের পর প্রায় দুই ঘণ্টা কাজ বন্ধ রাখে শ্রমিকরা। বিকাল ৪টার দিকে কর্মকর্তাদের চাপের মুখে শ্রমিকরা কাজ শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে শ্রমিকরা হঠাৎ করে একের পর এক অজ্ঞান হয়ে যায়।’
স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের কোনো ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ সন্ধ্যার পর কারখানা থেকে অসুস্থ শ্রমিকদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিতে যেতে দেখে তারা।
কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, ’কয়েকজন মাথা ঘুরে পড়ে গেলে তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসি। কী কারণে এমন হলো আমরা এখনও জানতে পারিনি।’
আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক কৌশিক বাকের বলেন, ’শ্রমিকরা কী কারণে অসুস্থ হয়েছে তা এখনি বলা সম্ভব নয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি গণ-মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
শ্রীপুরে কাভার্ড ভ্যান ও শ্রমিক বহনকারী বাসে আগুন
শ্রীপুরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার রাত আড়াইটায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের শ্রীপুর পৌরসভার ২ নম্বর সিঅ্যান্ডবি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা বলে, মধ্যরাতে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাভার্ড ভ্যানে হঠাৎ আগুন জ্বলতে দেখে তারা। এ সময় ভ্যানের চালক একটু দূরে অবস্থান করছিল। দ্রুতই আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় আগুন নেভায় সে। ভ্যানের সামনের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, পেট্রোল দিয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
শ্রীপুরের মাওনা হাইওয়ে থানার ট্রাফিক পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বলেন, ’কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেওয়ার খবর জানা নেই।’
এদিকে একই দিন সন্ধ্যায় শ্রীপুরের রঙ্গিলা বাজার সড়কের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিক বহনকারী বাসে পেট্রোল ছুড়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আগুনে ওই বাসটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। তাৎক্ষণিক স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে মাওনা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থল পৌঁছে আগুন নেভায়।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল ফজল মো. নাসিম জানান, মেরামতের জন্য মহাসড়কের পাশে পার্কিং করে রাখা বাসে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।