মেহেদী হাসান শিয়াম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৪ পিএম
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:০৮ পিএম
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায় হলুদ সাজে নেচে-গেয়ে নবান্নের উৎসব উদযাপন করেছে গ্রামবাসী। প্রবা ফটো
পুনর্ভবা নদীর তীরবর্তী গ্রামটিতে শুক্রবারের (১ ডিসেম্বর) সকালটা অন্য আর আট-দশটা দিনের মতো ছিল না। মেয়েলি গীত, আটা পেষার জাঁতা আর ধান ভাঙার ঢেঁকির শব্দে শুরু হয়েছিল সকালটা। নবান্নের উৎসবে মেতেছিলেন গ্রামটির নারীরা। তারা সেজেছিলেন হলুদ সাজে আর গ্রামটির পুরুষরা পরেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি।
সবুজে ঘেরা গ্রামটির নাম বাবুরঘোন। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায়। এক যুগ ধরে নেচে-গেয়ে নবান্নের উৎসব উদযাপন করে আসছে গ্রামবাসী।
নবান্ন উৎসবের দিনে নতুন চালের ভাত, আটা দিয়ে হরেক রকমের পিঠাপুলি, পায়েস-ক্ষির, নতুন আলুর সঙ্গে ডিম রান্না করা হয়। গোটা বাড়ির বারান্দাজুড়ে দফায় দফায় চলে জম্পেশ খাইদাই। খাওয়া শেষে বসে গানের আসর। জোয়ান-বুড়ো সবাই খালি গলায় গীত গায়। গানের ছন্দে হাততালি আর উপস্থিত সবাই গানে মেলায় কণ্ঠ। তখনোই জমে যায় গানের আসর। এভাবেই শেষ হয় দিনব্যাপী নবান্ন উৎসব।
উৎসবে আসা ছোট শিশুরা জানায়, তারা তাদের পাঠ্যবইয়ে নবান্ন উৎসবের কথা পড়েছে। তাদের অনেকেই দেখেনি নবান্ন উৎসব। প্রথমবারের মতো তারা এ অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পেরে খুবই উৎফুল্ল। বড়রা জানিয়েছেন, এই অনুষ্ঠানে এলে তাদের ছোটবেলার স্মৃতির কথা মনে পড়ে।
রওশন আরা বেগম নামে এক গৃহিণী বলেন, ’সকাল থেকে গ্রামের মেয়েরা সাজগোজ করে নবান্নের উৎসবে অংশ নিয়েছে। এ বছর আট-দশ রকমের পিঠা বানানো হয়েছে। এখানে আসা সবাই ঘুরেফিরে পিঠা খাচ্ছে। সবাই একসঙ্গে মেয়েলি গীত গাইছে। একসঙ্গে সবাই নতুন কাপড় পরেছে। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’
আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক পোয়া চাল, ডিম আর আলু কেনার জন্য সামান্য কিছু টাকা করে চাঁদা তোলা হয়েছে। এতে অংশ নেন শতাধিক নারী। অনুষ্ঠানে গ্রামবাংলার আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে স্মরণ করা হয় বলে জানান অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক মমতাজ বেগম।
তিনি বলেন, ‘আমরা টানা এক যুগ ধরে পিঠাপুলির নবান্ন উৎসব উদযাপন করে আসছি গ্রামবাসীদের নিয়ে। আজকের দিনটির জন্য এসব এলাকার গৃহিণীরা অপেক্ষা করেন গোটা বছর। প্রতিবছরই পিঠাপুলি দিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা থেকে নতুন চালের ভাত, নতুন আলু দিয়ে ডিম রান্না করে পোষালুর (পিকনিক) আয়োজন করা হয়েছে। আলু দিয়ে ডিম রান্না বড় কিছু না হলেও গ্রামের সবাই এতে খুব আনন্দিত হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবারের পোষালুতে বাবুরঘোনসহ আশপাশের গ্রামগুলোর শতাধিক গৃহিণী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তারা মেয়েলি গীত গেয়ে আর নানা ফন্দিফিকির করে হেসে-খেলে দিনটি উদযাপন করেছেন। গৃহিণীদের পাশাপাশি এখানে গ্রামের বৃদ্ধরাও যোগ দেন। তারা মাতেন খোশগল্পে; সবাই নিজের মতো করে আনন্দ করেছেন।’
গৃহিণীদের আয়োজিত নবান্ন উৎসবে উপস্থিত ছিলেন জেলা কালচারাল অফিসার ফারুক রহমান ফয়সল। বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নগরায়ণ আর কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্নের মতো অনেক উৎসব। গৃহিণীরা তাদের নিজ উদ্যোগে প্রতিবছর নবান্ন উৎসব আয়োজন করে থাকেন। যার ফলে গ্রামের নারীরা একটা দিন আনন্দ উৎসবে কাটান।’
বাবুরঘোন গ্রামের মতো প্রতিটি গ্রামে এমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে মানুষের প্রতি মানুষের সৌহার্দ্য ও প্রীতি বন্ধন বাড়বে বলেও জানান জেলা কালচারাল কর্মকর্তা।