ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:০৬ পিএম
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:১৬ পিএম
সুনামগঞ্জ জেলার শক্তিয়ারখলা বন বিটের ঢুলারা বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় মঙ্গলবার দেখে মেলে বনছাগলটির। প্রবা ফটো
গত ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার শক্তিয়ারখলা বন বিটের ঢুলারা বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় দেখা মেলে নতুন এক প্রাণীর। বিজিবি সদস্য, স্থানীয় এলাকাবাসী ও বন বিভাগের কর্মীরা প্রাণীটিকে আটকও করেন। সুচালো দুটি শিং, খাড়া কান আর লাল রঙের প্রাণীটিকে প্রথমে সবাই ভেবেছিলেন হরিণ।
অদ্ভুত-দর্শন প্রাণীটিকে পরে ট্রাকযোগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে আসা হয়। এখানে আনার পর জানা যায়, প্রাণীটি হরিণ কিংবা নতুন কোনো প্রাণী নয়। এটি হলো আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত সেরো বা বনছাগল।
একটা সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন বন বা ঝরনা অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকায় দেখা মিলত বনছাগলের। কিন্তু বর্তমানে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রাণীটি খুব একটা চোখে পড়ে না। উদ্ধার বনছাগলটি গতকাল বুধবার রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করা হয়।
মৌলভীবাজারের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘অতি বিপন্ন বনছাগল বা সেরোটি উদ্ধারের পর আমাদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হয়। গতকাল রাতে প্রাণীটিকে কমলগঞ্জের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ার বলেন, উদ্ধারের পর সেরো বা বনছাগলটিকে সবাই হরিণের বাচ্চা হিসেবে ধারণা করেছিলেন। পরে আমরা পরীক্ষা ও বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে নিশ্চিত হই এটি ‘রেড সেরো’ বা ‘বনছাগল’। বাসস্থানের সংকট এবং শিকারের কারণে এ প্রজাতির বনছাগলের অস্তিত্ব বিশ্বজুড়েই হুমকির মুখে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সুনামগঞ্জ থেকে উদ্ধার করা বনছাগলটি গত মঙ্গলবার রাতে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে আসা হয়। বুধবার রাতে এটিকে জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টে ছেড়ে দেওয়া হয়। এটি লম্বায় ৪ ফুট এবং উচ্চতা ৩.৫ ফুট। ২০১৫ সালে আইইউসিএনের মূল্যায়ন অনুযায়ী সেরো বাংলাদেশে বিপন্ন, বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন।
গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে খুবই স্বল্পসংখ্যায় দুই ধরনের সেরোর দেখা পাওয়া যায়। এর একটি লাল সেরো, অন্যটি ইন্দো-চায়নিজ সেরো।
কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে সিলেট-মৌলভীবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বনে একটি সেরোশাবক উদ্ধারের খবর জানা গেলেও পরে আর কোথাও সেরোর প্রাপ্তির কোনো খবর নেই। দীর্ঘদিন পর ২০২২ সালে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনে ক্যামেরা ট্র্যাপ থেকে একটি বিশালাকার সেরোর ছবি পাওয়া যায়। একই বছর চট্টগ্রামের বারৈয়ারঢালা জাতীয় উদ্যান থেকে ক্যামেরা ট্র্যাপে সেরোর ছবি পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক। এ ছাড়া ২০১৫ সালে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রিয় চাকমা সেরো নিয়ে গবেষণা করেন। তার গবেষণায় কাসালং ও সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনে সেরোর উপস্থিতির কথা জানা যায়।
প্রাণী গবেষকদের মতে, বনছাগল বা সেরোর নিবাস বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ ও ঝরনাযুক্ত বনে। এ প্রাণীটি সারা দিন গর্তে লুকিয়ে থেকে খুব ভোরে ও সন্ধ্যাবেলা খাবারের সন্ধানে বের হয়। এরা সাধারণত ঝোপ-ঝাড়ে কিংবা পাথুরে ঢালে লুকিয়ে থাকে। ফলে অসম্ভব লাজুক, সতর্ক, দ্রুতগামী ও প্রচণ্ড শক্তিশালী সেরোর দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এরা এক ধরনের গন্ধগ্রন্থির সাহায্যে গন্ধ ছড়িয়ে নিজের এলাকা চিহ্নিত করে রাখে।