× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সংখ্যালঘু জাতিসত্তা

তিন দশকের নেতৃত্ব হারাল গারো জনগোষ্ঠী

ফারহানা বহ্নি ও আনিসুর রহমান, ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:৪৮ এএম

আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:২৩ পিএম

তিন দশকের নেতৃত্ব হারাল গারো জনগোষ্ঠী

‘ভোটটা দিতাম না। ভেবেছিলাম এবারও নৌকা জিতেই যাবে। পরে শুনলাম কিছুটা প্রতিযোগিতা আছে। তখন গিয়ে জুয়েলদাকে ভোট দিয়েছিলাম।’ বলছিলেন পরাগ রিছিল। ময়মনসিংহ-১ আসনের ভোটার পরাগের বাড়ি হালুয়াঘাটে। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘ফলাফলের সময় একেক কেন্দ্র থেকে একেক ফল আসতে শুরু করল। কখনও দেখছি দুই হাজার পিছিয়ে, কখনও আবার এক হাজার পিছিয়ে। তারপরও আশা ছাড়িনি। মনে হয়েছে, আরও কেন্দ্র তো আছে। নিশ্চয়ই জিতে যাবে। কিন্তু সেটা হলো না। সারা রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। উনি হেরে যাবেন- এটা ভাবতেই পারিনি আমরা। কেউ ভাবেনি। এখানকার মান্দি (গারো) জনগোষ্ঠীর জন্য বিষয়টা খুবই হতাশাজনক।’ 

সংখ্যালঘু জাতিসত্তা গারো-অধ্যুষিত ময়মনসিংহ-১ আসন (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া)। এ আসনে গত ৩৩ বছর নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন গারো জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বশীল নেতারা। এবার দীর্ঘদিন পর সেই নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ায় চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। পুরো বাংলাদেশের মান্দি জাতিই হতাশাচ্ছন্ন এ ঘটনায়। কারণ এত দিন জাতীয় সংসদে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরার মতো সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি গারো বা মান্দিদেরও প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব ছিল। কিন্তু এবারের সংসদ নির্বাচনে জুয়েল আরেং (৩৬) হেরে যাওয়ায় গারোদের দাবিদাওয়া তুলে ধরার জন্যে সরাসরি কোনো প্রতিনিধি থাকছে না।

নির্বাচনে পরাজয় অপ্রত্যাশিত, হতাশাজনক

গারো সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ প্রমোদ মানকিন ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চার পর্বে ময়মনসিংহ-১ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথমে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও পরে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে তার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন তারই ছেলে জুয়েল আরেং। তিনি ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

কিন্তু এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জুয়েল আরেং স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে সদ্য পদত্যাগী মাহমুদুল হকের কাছে ১৯ হাজার ৬৭৯ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন। এ আসনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুল হকের প্রাপ্ত ভোট ৯৩ হাজার ৫৩১। অন্যদিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জুয়েল আরেংয়ের প্রাপ্ত ভোট ৭৩ হাজার ৮৫২। তার এমন পরাজয় অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিতই ছিল। গারো পাহাড়ঘেঁষা এ আসনের মোট ভোটার ৪ লাখ ৫০ হাজার ৮৫২ জন। তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার ভোটার গারো। 

‘ময়মনসিংহের মান্দিরাই না শুধু আমি যদি সব মান্দিদের কথা বলি এটা তাদের জন্যই একটা বিরাট ক্ষতি’Ñ বলছিলেন মধুপুরের ইদিলপুরের বাসিন্দা জাদু রিছিল। তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের নানারকম সমস্যা আছে। তার মধ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিষয়টা আরও সমস্যার। এর মধ্যে সংসদে একজন প্রতিনধি থাকাটাই ছিল বিরাট ব্যাপার। কথায় আছে না, থানায় জিডি করতে গেলেও টাকা লাগে? হাসপাতালের একটা বেড পেতে গেলেও কত কষ্ট করতে হয়? তাই কেউ একজন থাকলে কিছু করুক বা না করুক, কিছুটা সান্ত্বনা থাকে।’

এলাকার বাসিন্দা প্রলয় তুজু বলেন, সংসদে আমাদের আদিবাসী নেতৃত্বে থাকায় আমাদের অনেক সাহস শক্তি ছিল। হঠাৎ নেতৃত্ব চলে যাওয়া আমাদের জন্য হতাশাজনক।

ভোটার উপস্থিতি ছিল কম

হেরে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে গারোদের অনেকেই বলছেন, ভোটার উপস্থিতি কম থাকার কথা। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে জাদু রিছিল বলেন, ‘আমাদের জনগোষ্ঠীর ওই আসনে ভোটারের সংখ্যা হবে ৩০ হাজার বা ৪০ হাজার। ভোটের আগে বড়দিন হয়ে গেছে। ওই সময় সবাই উৎসব করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাড়ি এসেছিল। তারপর কর্মস্থলে চলে গিয়েছিল। এক বা দুই হাজার টাকা খরচ করে আবার ভোট দিতে বাড়িতে আসবে, এমন মানুষ আর কয়জন আছে? এইভাবে অনেক ভোট কমেছে। আবার যারা বয়স্ক তাদের অনেকেও ভোট দিতে যাননি। আবার অনেকে আছেন, যারা ভেবেছেন, ভোট দিই বা না দিই, এবারও জিতবে!’ 

উন্নয়নমূলক কাজ কম হয়েছে, আছে কোন্দল

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নৌকার প্রতিনিধি জুয়েল আরেংয়ের বিরুদ্ধে ধোবাউড়া উপজেলায় উন্নয়নমূলক কাজ কম হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারা জানান, ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুলের নেতৃত্বে দলীয় নেতাকর্মীদের একাংশ দীর্ঘদিন ধরেই জুয়েলের বিরোধিতা করে আসছেন। যার প্রভাব পড়েছে এ নির্বাচনে। এ ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনও পরিবর্তন চাইছিল। সবকিছু মিলিয়ে এ নির্বাচনে নৌকার এমন পরাজয় ঘটেছে। 

এ প্রসঙ্গে প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নৌকার পরাজয়ের প্রধান কারণ জুয়েল আরেং নিজে। তিনি আওয়ামী লীগকে চরমভাবে দ্বিখণ্ডিত করেছেন। দলের নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করেছেন। যার ফলে নৌকার এই পরাজয়।’ 

উপজেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শওকত উসমান বলেন, উপজেলায় দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নৌকার প্রার্থী জুয়েল আরেংয়ের যোগাযোগ ছিল না। বরং দলের নেতাকর্মীদের তিনি বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছেন। যার কারণে এমন পরাজয়!’ 

নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসাইন বলেন, ‘দলীয় নেতাদের একাংশ নৌকার বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন ও ষড়যন্ত্র করার কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে।’ 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল মোতালেব আকন্দ বলেন, ‘শেখ হাসিনা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সুযোগ দেওয়ায় উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন।’

‘নেতিবাচক, বিব্রতকর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে’ 

ফল ঘোষণার পর থেকে নানারকম নেতিবাচক স্লোগান শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ট্রাইবাল চেয়ারম্যান এডুওয়ার্ড নাফাক জানান, ‘জুয়েল আরেংয়ের পরাজয়ের পর থেকে আমাদের গারো সম্প্রদায় নিয়ে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করা হচ্ছে। যা আমাদের (গারো) জন্য বিব্রতকর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। আশা করি, শেখ হাসিনা যত দিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন তত দিন আমাদের কোনো সমস্যা হবে না।’

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রেমন্ড আরেং বলেন, নিজেদের প্রতিনিধি থাকলে, কিছু করুক আর না করুক সাহস খুঁজে পাওয়া পায়। কিন্তু নির্বাচন তো একটা গেম। যার জন্য একটা গেম প্ল্যান লাগে। এখানে আমার মনে হয় প্ল্যানিংয়ের অভাব আছে। কেন্দ্র পর্যায়ে যে সমন্বয় হওয়ার কথা, তা হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ইস্যু থাকে। সেটাও এখানে কাজ করেছে। নির্বাচনের পরপরই গারোবিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গেছে অনেককে। একটা ভিডিও-ও দেখেছি। কিন্তু বাঙালি ও গারোদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মতো কিছু হয়নি। এটা বাঙালিদের স্লোগান না, রুচিহীন গুটিকয়েক স্বার্থান্ধের স্লোগান।’ 

বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নির্মল রোজারিও বলেন, ‘আদিবাসী এবং খ্রিস্টানদের প্রত্যাশা ছিল, এ আসনে জুয়েল এবারও জিতবেন। এতে আমাদের সম্প্রদায়ের সুখদুঃখ তুলে ধরা সহজ হতো। কিন্তু এ নির্বাচনে টাকার খেলা হয়েছে। আসলে রাজনীতিতে এখন টিকে থাকা কঠিন।’ 

গারো ছাত্রসংগঠনের সভাপতি রেডক্লিফ দিব্রা বলেন, ‘জুয়েল আরেং যে হেরে গেলেন, এটা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী যদি অন্য কোনোভাবে এটা পূরণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে ভালো লাগবে। তিনি জানান, ভোটের সময় প্রতিপক্ষের কেউ কেউ বলেছে, ‘গারো হটাও’। যা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

যা বলছেন সাবেক এমপি 

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং বলেন, ‘সবাই আশাহত। কারণ আমি থাকলে সবাই একটা নিরাপদবলয়ে থাকত।’ এবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোটের সময় সাম্প্রদায়িকতা বড় বিষয় হয়ে উঠেছিল। দলের মধ্যেও কিছু দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, তবে সেটা বড় কিছু না। দলসহ বাইরের অনেকেও আমার জন্য কাজ করেছে। ভোটে না জিতলেও এলাকার সবার জন্য আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব কাজ করে যাব।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা