রূপগঞ্জে শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশা বাহিনীর তাণ্ডব
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:৫৫ পিএম
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:০৭ এএম
রূপগঞ্জে সাধারণ গ্রামবাসী ও ভোটারদের ওপর হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন মোশা ও তার বাহিনীর লোকজন। প্রবা ফটো
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাধারণ গ্রামবাসী ও ভোটারদের ওপর হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন মোশা ও তার বাহিনীর লোকজন। সোমবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দফায় দফায় হামলা, গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দুজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। এ সময় সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের পৃষ্ঠপোষকতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা মোশা রূপগঞ্জের নাওড়া গ্রামের মোতালেব ভূঁইয়ার ছেলে। আপন বড় ভাইকে খুনের মধ্য দিয়ে অন্ধকার জগতে পা রাখা এই অপরাধী ‘মোশা বাহিনী’ নামে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তোলে। দীর্ঘদিন ধরে তারা রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল, ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক কারবার আর লুটপাট চালিয়ে আসছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করে গ্রামের সাধারণ মানুষ। ওই নির্বাচনে মোশা ও তার বাহিনীর লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষে ছিলেন। নির্বাচনে ১ লাখ ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে নৌকার প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজীর (বীরপ্রতীক) কাছে পরাজিত হন শাহজাহান। এই বিশাল পরাজয় মেনে নিতে না পেরে ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই মোশা বাহিনীর সদস্যরা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক, নিরীহ গ্রামবাসী ও সাধারণ ভোটারদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
সোমবার দুপুরে নাওড়া এলাকায় মোশা বাহিনীর সদস্য নিরব, স্বাধীন, সাখাওয়াত উল্লাহ, আব্বাস, নাজমুল, রুবেল, আনোয়ার, জয়নাল, তাজেল, রিফাত, রায়হান, আলহাদি, জাগু, বুটটু, চোরা দুলাল, আব্দুল, আরমানসহ এক থেকে দেড়শ সদস্য পিস্তল, টেঁটা, বল্লম, জুইতা, রামদা, চাপাতি, চাইনিজ কুড়ালসহ নানা ধরনের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালায়। এতে শিশু-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব বয়স্ক মানুষজনের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়ায়। একপর্যায়ে মোশা বাহিনী গ্রামবাসীকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে কৃষক আলতাব হোসেনসহ দুজন গুলিবিদ্ধ হন। আহত হন সাজ্জাদ, আব্দুল্লাহ, ফারুক, হানিফসহ অন্তত ৩০ জন। গুলিবিদ্ধ ওই দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
হামলার সময় সন্ত্রাসীরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্কও সৃষ্টি করে। কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে লুটপাট করে আগুন দেওয়া হয়। একপর্যায়ে গ্রামবাসী নিজেদের আত্মরক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখন শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপঙ্কর চন্দ্র সাহার নেতৃত্বে বিপুল পরিমাণ পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশকে লক্ষ্য করেও মোশা বাহিনী ইটপাটকেল ছোড়ে।
এর আগে রূপগঞ্জের দাউদপুরে ভূমিদস্যুদের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন এলাকাবাসী। এ সময় অবৈধ অস্ত্রধারীদের হামলায় অন্তত ১৫ জন আহত হয়। গুরুতর অবস্থায় তাদের মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ভূমিদস্যুরা শুধু গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে ক্ষান্ত হয়নি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়েও হামলা চালায় এবং ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করে। দলীয় কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুরের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দাউদপুর ইউনিয়নের শিমুলিয়া, দাউদপুর, বেলদি, দুয়ারা, কালনি, কুলাদি, খইসাইর, কামতা, খাস দাউদপুর, বড় আমদিয়া, জিন্দা, বইলদা, ভাটপাড়া, পুটিনাসহ বিভিন্ন মৌজায় জমি না কিনেই ভূমিদস্যু বসুন্ধরা গ্রুপ বালু ফেলে দখল করে নিচ্ছিল। জমি জালিয়াতি, ভূমিদস্যুতাসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে ওই ইউনিয়নের মানুষজন।
চলতি মাসের শুরুতেও নৌকার সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে সন্ত্রাসীরা। উপজেলার কায়েতপাড়া, নাওড়া, চনপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। এ বিষয়ে রূপগঞ্জ থানায় একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে।
নাওড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাফিয়া বসুন্ধরা গ্রুপের আশ্রয়ে ৪৪ মামলার আসামি মোশারফ হোসেন ওরফে মোশাসহ তার বাহিনীর সদস্যরা আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে নিরীহ গ্রামবাসীর জমি জবরদখল করতে তারা উঠে-পড়ে লেগেছে। সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। জানমাল রক্ষায় তাদের নির্ঘুম রাত কাটছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপঙ্কর চন্দ্র সাহা বলেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কে এই মোশা
রূপগঞ্জের আতঙ্ক তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশাকে গত ১ জুন ভারতে পালানোর সময় কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। মাত্র আড়াই মাসের মাথায় গত ২১ আগস্ট জামিনে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পায় মোশা। কিছুদিন ‘আত্মগোপনে’ থেকে মাফিয়া গডফাদারের ছত্রছায়ায় আবারও সে দলবল নিয়ে প্রকাশ্যে আসে। সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এলাকায় এলাকায় শুরু করে মহড়া। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে ফিল্মি স্টাইলে বিশাল গাড়িবহর ও অবৈধ অস্ত্রধারী বডিগার্ড নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো রূপগঞ্জ। এর বাইরেও মোশার রয়েছে বিশাল টেঁটা বাহিনী ও হাতুড়ি বাহিনী। কেউ তার কথার বাইরে গেলেই তাকে মারধর ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়।
মোশার বডিগার্ডের সংখ্যা কত, তার হিসাব নেই। রূপগঞ্জ থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এসআই বলেন, ‘মোশার সঙ্গে সব সময় অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কথিত বডিগার্ড হিসেবে ঘুরে বেড়ায়। প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থাকায় তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সন্ত্রাসী মোশার দলের সদস্যসংখ্যা ৭০ থেকে ৮০। এই সন্ত্রাসীরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, অবৈধভাবে জমি দখল, হুমকি, ছিনতাই ও মাদক কারবারসহ অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তারা ভয়ভীতি দেখায়। এলাকার মানুষ মোশা বাহিনীর ভয়ে তটস্থ থাকে।