নড়াইল প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৪ ২০:১১ পিএম
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৪ ২০:১৩ পিএম
নড়াইল জেলার একটি প্রবেশদ্বার। সংগৃহীত ফটো
বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী, চারণকবি, এমনকি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ– কত প্রখ্যাত ব্যক্তি জন্মালেন এই মাটির বুকে। এত এত গুণীজনদের জন্মভিটা নড়াইল জেলার আজ শুক্রবার (১ মার্চ) জন্মদিন। দিনটি ছিল আড়ম্বরে ভরা। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম সূতিকাগার এই জেলার জন্মবার্ষিকী। সারা দিনের নানা কর্মসূচি শেষে বিকালে প্রজন্ম সুলতান নামে একটি সংগঠন জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে আয়োজন করে একটি অনুষ্ঠানের। সেখানে ছিল শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, কেক কাটা, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী।
১৯৬১ সালে যশোর জেলার অধীনে নড়াইল মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ বৃহত্তর যশোর জেলার মহকুমা থেকে নড়াইলকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে নড়াইল একটি জেলা। এই জেলার উত্তরে মাগুরা জেলার শালিখা ও মহম্মদপুর থানা। দক্ষিণে খুলনা জেলার তেরখাদা, দীঘলিয়া ও মোল্লার হাট। পূর্বে ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ। পশ্চিমে যশোর জেলার অভয়নগর, বাঘারপাড়া ও কোতয়ালী থানা।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে– নড়াইল জেলার আয়তন ৯৭৬ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ৬৫ লাখ ৯ হাজার ৬৮১ জনের মধ্যে ৩৩ লাখ ৩ হাজার ৮১৬ জন পুরুষ ও ৩২ লাখ ৫ হাজার ৮৬৫ জন নারী। নড়াইলকে মোটামুটি নদী সমৃদ্ধ অঞ্চল বলা যায়। এই জেলার ওপর দিয়ে মধুমতি, চিত্রা, কাজলা, নলিয়া, নড়াগাতি, নবগঙ্গা, কালিগঙ্গা ও আঠারবাঁকি ছাড়াও শিরোমনি শাখার গাল ও হ্যালিক্যাকস ক্যানেল প্রবাহিত ছিল। তন্মধ্যে ৩/৪ টি নদী মৃত বলা চলে, অপর ৮/৭টি নদী এখন প্রবাহমান।
প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব
নড়াইলে জন্ম বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস, এম সুলতান, প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ, আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী সংগীতজ্ঞ রবী শংকর, সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্ত, বিশ্বখ্যাত সংগীত শিল্পী কমল দাস গুপ্ত, লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, চারণ কবিয়ালসম্রাট বিজয় সরকার, চারণ কবি জারী সম্রাট মোসলেম উদ্দিন বয়াতী ও দানবীর ফাজেল আহমেদ মোল্যার।
ঐতিহ্য
কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দিয়েছে প্রাচীন জনপদ নড়াইলের স্বতন্ত্র পরিচয়। এই জেলার লোকজ ঐতিহ্যের মধ্যে যাত্রাগান, পালাগান, নৌকাবাইচ, হাডুডু খেলা, লাঠি খেলা, হালুইগান, ষাড়ের লড়াই, পিঠাগুলি, কবিগান, জারিগান, গাজিরগান, বৃষ্টির গান ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
পটভূমি
ভূতাত্বিকদের মতানুসারে– অন্তত দশ লাখ বছর আগে গঙ্গা নদীর পলিমাটি দিয়ে গঙ্গেয় ব-দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই দ্বীপগুলোর অন্তর্গত এক ভূখন্ডই হলো বর্তমান নড়াইল জেলা। সে সময় নড়াইল জেলা সাগর তীরবর্তী বর্তমান সুন্দরবনের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ৬০-৭০ বছর আগেও এই জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পুকুর বা কুয়া খনন করে হরিণ, বাঘ ও অন্যান্য জীবজন্তুর ফসিল পাওয়া যেত। তা থেকে প্রমাণিত– নদীমাতৃক এই জেলা সুন্দরবনের বনভূমি বিস্তৃত ছিল।
ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়– গুপ্ত যুগে নড়াইল অঞ্চলের পূর্ব সীমান্ত মধুমতি নদী পর্যন্ত যশোরসহ গুপ্ত সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। যা ৩৪০ থেকে ৩৭৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। রাজা শাশাঙ্ক ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন এবং তার রাজধানী ছিল কর্ণ সুবর্ণ নগর মতান্তরে লক্ষণাবর্তী। সম্রাট হর্ষ বর্ধন শশাঙ্ককে পরাজিত করে এই অঞ্চলকে তারা করায়ত্ত করেন। বৃহত্তর যশোরসহ নড়াইল জেলা শশাঙ্গ ও হর্যবর্ধন রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আনুমানিক দেড়শ বছর নড়াইল জেলা অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল বাহুবলে শাসিত হয়েছিল।
একটা পর্যায়ে এ অঞ্চলে পাল বংশ শসন করে। পাল বংশের পতনে কর্ণাটক থেকে আগত সেন রাজাদের রাজত্য কায়েম হয়। ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কি সেনা নায়ক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলাদেশ অধিকারের ফলে রাজা লক্ষণ সোনের রাজত্বকাল সমাপ্তি ঘটতে থাকে। এরপর আসে মুসলিম শাসনামল। তখন বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো পর্যায়ক্রমে ৩৭ বছর পাঠান আমল এবং প্রায় দুইশ বছর সুলতানী আমল বিরাজমান ছিল। ইংরেজ আমলে ১৭৮৬ সালে যাশোর একটি জেলা রূপে প্রকাশ পায়। তখন নড়াইলের পূর্বাঞ্চল ছাড়া বৃহত্তর যশোরসহ বৃহত্তর খুলনা জেলা যশোরের অন্তর্গত ছিল। ১৯৯৩ সালে নলদী পরগণাসহ ভূষণা ফরিদপুর জেলার পশ্চিমাঞ্চল যশোরের অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৮৪২ সালে খুলনাকে পৃথক মহকুমায় পরিণত করে নড়াইলের কালিয়া থানার দক্ষিণাঞ্চল তার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮৬১ সালে নীল বিদ্রোহের সময় নড়াইল একটি পৃথক মহকুমা স্থাপিত হয়। মহকুমা সদরের স্থান নির্বাচনের জন্য মহিষখোলা মৌজার নড়াইল মহকুমার সদরকেই বেছে নেওয়া হয়। প্রকৃত নড়াইল মৌজা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে– যেখানে নড়াইলের জমিদারদের প্রসাদ অবস্থিত ছিল এবং অপরদিকে মহকুমা প্রশাসকের বাসভবনই নীলকরদের কুঠিবাড়ী ছিল।
যেভাবে নড়াইল
১৯০১ সালের শুমারি অনুযায়ী– নড়াইল মহকুমা-নড়াইল, বড় কালিয়া, লোহাগড়া থানা গঠিত হয়। এর জনসংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ২৮৯ জন। সাবেক যশোরের পাঁচটি মহকুমার পূবাঞ্চলের একটি সমৃদ্ধশালী মহকুমা ছিল নড়াইল। ১৯৩৫ সালে সীমানা পূর্ণগঠনের প্রেক্ষিতে বিদালী, পোড়ালী ও শেখহাটি ইউনিয়নকে নড়াইল থানার সঙ্গে এবং পোড়লী ইউনিয়নকে কালিয়া থানার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর লোহাগড়া, কালিয়া, আলফাডাঙ্গা ও নড়াইল– এই চারটি থানা নাড়াইল মহকুমাতে অবশিষ্ট থাকে। ১৯৬০ সালে আবার আলফাডাঙ্গা নাড়াইল থেকে বিছিন্ন করে ফরিদপুরের সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এভাবে বিভিন্ন সময় নড়াইলের ভৌগোলিক সীমারেখা সংকুচিত করা হয়েছে।