চট্টগ্রাম অফিস
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪ ০১:২২ এএম
আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪৫ পিএম
প্রতীকী ছবি
চট্টগ্রামে ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় আবু বক্কর সিদ্দিক নামে এক ফ্রিল্যান্সারের অ্যাকাউন্ট থেকে খোয়া যাওয়া সোয়া ৩ লাখ ডলারের মধ্যে ২ লাখ ৮ হাজার ডলার উদ্ধার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। মো. কাউসার আহমদ ও শাহাদাত হোসেন নামে ডিবির দুই সোর্স মিলে আবু বক্করের অ্যাকাউন্ট থেকে ওই বিটকয়েনগুলো সরিয়েছিলেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে খুলশী থানার ২ নম্বর গেট এলাকার ভারতীয় হাইকমিশনার অফিসের সামনে থেকে কাউসার আহম্মদ নামে ওই সোর্সকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের একটি দল। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ডলার হাতানোর পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ভিসা পেতেই ভারতীয় হাইকমিশনে যান কাউসার। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
কাউসারকে গ্রেপ্তারের পর বায়োজিদ বোস্তামি থানায় নাটকীয় এক এজাহার দায়ের করেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপপরিদর্শক মো. আলমগীর হোসেন। ওই এজাহার অনুযায়ী গতকাল শনিবার দুপুরে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭-এর ২৩-এর ১ ধারায় একটি মামলা নথিভুক্ত করে বায়োজিদ বোস্তামি থানা-পুলিশ। বায়োজিদ বোস্তামি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর-দক্ষিণ) পুলিশের উপকমিশনার মোসা. সাদিরা খাতুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখানে দুটি ঘটনা আছে। একটা হলো ক্রাইম, আরেকটা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। আমরা দুটি বিষয়ই দেখছি। বিটকয়েন ব্যবহার করায় তিনজনকে আসামি করে একটা নিয়মিত মামলা হয়েছে। আর পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটা কমিটি করা হয়েছে।’
ডিবির করা মামলার এজাহারে দাবি করা হয়েছে, আবু বক্করের যোগসাজশেই কাউসার আর শাহাদাত মিলে বক্করের বাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট (ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ; যা বাংলাদেশে অবৈধ) থেকে ৪ দশমিক ৯৭৩৭৯২২১ বিটকয়েন সরিয়ে নেয়। প্রতি বিটকয়েন ৫০ হাজার মার্কিন ডলার ধরে এসব কয়েনের দাম দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৮৯ মার্কিন ডলার। এজাহারে বলা হয়েছে, আবু বক্করের নির্দেশমতো ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা থেকে ১১টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে প্রথমে বিটকয়েনগুলো শাহাদাতের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। পরে শাহাদাত বিটকয়েনকে ডলারে রূপান্তর করে। সেসব ডলার থেকে ২ লাখ ৮ হাজার ৩৮০ কাউসারের অ্যাকাউন্টে দেয়। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভারতীয় হাইকমিশন অফিসের সামনে থেকে কাউসারকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। কাউসারের অ্যাকাউন্ট থেকে তার কাছে থাকা ২ লাখ ৮ হাজার ৩৮০ ডলার জব্দ করার কথাও এজাহারে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এজাহারে বলা হয়েছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহাদাত আর কাউসারের দেওয়া তথ্যেই আবু বক্করকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ১ মার্চ বিটকয়েনের দাম ছিল ৬২ হাজার ডলার। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় এর দাম দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ডলারে। অন্যদিকে যে সময়ে বক্করের অ্যাকাউন্ট থেকে বিটকয়েন স্থানান্তর করা হয়, সে সময়ে ডিবি হেফাজতেই ছিল বক্কর।
মহানগর পুলিশের পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ওই দুজন ডিবির সোর্স। তারাই টাকা সরিয়েছে। সরানোর পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেখান থেকেই কাউসারকে গ্রেপ্তার করা হয়। মনে হচ্ছে ডিবির সদস্যরা এই বিষয়ে জানতেন না। তারা সোর্স দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন।’
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন গুলবাগ আবাসিক থেকে মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ও ফয়জুল আমিনকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের একটি দল। পরদিন মঙ্গলবার বিকালে অনলাইন জুয়া খেলার অভিযোগে সিএমপি অধ্যাদেশে একটি নন-এফআইআর মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান করে ডিবি পুলিশ। আদালত তাদের ১০০ টাকা করে জরিমানা করে মুক্তি দেন।
এদের মধ্যে আবু বক্কর সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার। মুক্তির পর ফ্রিল্যান্সার আবু বক্কর গোয়েন্দা পুলিশের দলটির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তোলেন। তার অভিযোগÑ তার নিজের বাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট থেকে ৪ দশমিক ৯৭৩৭ বিটকয়েন খোয়া গেছে। ডলারের হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার ডলার। প্রতি ডলার ১১০ টাকায় যা ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। আবু বক্করের দাবি, ছাড়া পেতে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার পরও ডিবি পুলিশের সদস্যরা তার বিটকয়েন হাতিয়ে নিয়েছেন। ডিবি হেফাজতে থাকাকালীন আবু বক্করের বিটকয়েন অ্যাকাউন্ট ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আর্থিক লেনদেনের প্রমাণও পাওয়া গেছে।
আবু বক্করের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৭৮৬৩২৪৫০০০০০৮১৮১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে সোমবার রাত ৩টা ৪১ মিনিট ২১ সেকেন্ডে একই ব্যাংকের ০৯৭৩২০১০০০০৩৮৯৪৩ নম্বর হিসাবে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। একইভাবে আবু বক্করের সিটি ব্যাংকের ১৪০১৮৮২০২৪০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে রাত ৩টা ৫০ মিনিটে একই ব্যাংকের ১৭৮১৪৩০৫৫৫ নম্বর ব্যাংক হিসাবে আরও ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। যে দুই অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছেÑ দুটি অ্যাকাউন্টই জাহিদ হোসাইন স্বাধীন নামের এক ব্যক্তির। তিনি পাহাড়তলীর সিডিএ মার্কেট এলাকার বাসিন্দা। সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে এই ব্যক্তি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
আবু বক্কর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডিবির কনস্টেবল আব্দুর রহমান আমাকে এই দুটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়েছে। সেখান থেকেই অনলাইনে আমি টাকা পাঠিয়েছি।’
এই বিষয়ে কথা বলতে ডিবির কনস্টেবল আব্দুর রহমানের মোবাইলে কল দিয়ে ও হোয়াটসঅ্যাপে কল-মেসেজ দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। জাহিদ হোসাইন স্বাধীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুটি অ্যাকাউন্টের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর আর তাকে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এই বিষয়ে ডিবির সদর দপ্তরে অভিযোগ পাঠানোর পাশাপাশি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে আবু বক্কর বলেন, ‘আমাকে এখানে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। তবে আমি নিরাপদ বোধ করছি না। ডিবি সদর দপ্তরে অভিযোগ দেব। আর মামলা করব।’
নিজের ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার সম্পর্কে আবু বক্কর বলেন, ‘আমি আপওয়ার্কে বুককিপিংয়ের কাজ করি। ক্লায়েন্টরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে পেমেন্ট দেয়। এর কিছু আমরা বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে তুলতে পারি, কিছু পারি না। যেগুলো তুলতে পারি না, সেগুলো জমা করে রেখে দিই। বাধ্য হয়ে এগুলো রেখে দিতে হয়। মাঝেমধ্যে অন্য কাউকে সেন্ড করে এগুলো ক্যাশ করতে হয় অনেকটা নিরুপায় হয়ে। এভাবে সবাই করে, আমি তো শুধু না। আমার ভুল হইছে, আমি বিদেশে চলে যাইনি।’