সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১১:১৯ এএম
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১৪:২০ পিএম
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালেখাঁর ভান্ডা গ্রামের রকিব হাসান ভূঁইয়ার বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে ইট-পাথরের বদলে শোভা পাচ্ছে বইয়ের মোড়ক। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালেখাঁর ভান্ডা গ্রামে রকিব হাসান ভূঁইয়ার বাড়ি। আনন্দধারা নামের বাড়িটি সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে বিশেষ এক কারণে। এর সীমানাপ্রাচীরে ইট-পাথরের দেয়ালের বদলে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ। মাদক এবং মোবাইল আসক্তি থেকে বর্তমান প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে বিশ্বসাহিত্যের জনপ্রিয় কালজয়ী ৩৩টি বইয়ের মোড়ক দিয়ে সাজানো এ বাড়ির গেটের দুপাশের সীমানাপ্রাচীর যেন বিশাল বুকশেলফ। প্রতিদিন বইয়ের দেয়াল দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে অসংখ্য মানুষ।
সরারচর রেলস্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জমুখী পথে যেতে দেখা মেলে আনন্দধারা নামে বাড়িটি। বাড়িতে প্রবেশের প্রধান গেটটি দেখতে খোলা বইয়ের পৃষ্ঠার মতো। গেটের দুই পাশের সীমানাপ্রাচীর দেখে মনে হয় বিশাল বুকশেলফ। ১৪ ফুট উঁচু ৯০ ফুট দীর্ঘ প্রাচীরজুড়ে স্থান পেয়েছে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের ৩৩টি বিখ্যাত বই।
জানা গেছে, এ জেলার বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালেরখাঁ ভান্ডা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শামছুল হক ভূঁইয়া ও তার স্ত্রী ছিলেন বইপ্রেমী। বাবা-মায়ের মতো বই পড়ার অভ্যাস তাদের ছেলে রকিব হাসান ভূঁইয়ারও। তাই বই পড়ার বিষয়ে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে বাড়ির দেয়াল সাজিয়েছেন অভিনব কায়দায়, কালজয়ী বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে। ব্যতিক্রমী এ দেয়াল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে স্টিলের পাত। এটি তৈরি করতে ঢাকা থেকে আনা হয় কারিগর। সময় লেগেছে দুই বছর। কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, জসীম উদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ, আনিসুল হকের মা, হিসাম আল আওয়াদির বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ, সৈয়দ আমীর আলীর দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সীরাতে ইবনে হিসাম, সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী, সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প এবং তোমাদের জন্য রূপকথা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, আরিফ আজাদের প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ, খালেদ হোসেইনির দ্য কাইট রানার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেন, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম ও আমার বন্ধু রাশেদ, আলেক্সান্দর বেলায়েভের উভচর মানুষ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, হারুকি মুরাকামির নরওয়েজিয়ান উড, শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক, রশীদ হায়দারের ১৯৭১ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী, আল্লামা ইবনে কাসিরের (রহ.) তাফসিরে ইবনে কাসির, জহির রায়হানের বরফ গলা নদী, আইজাক আসিমভের ফাউন্ডেশন ও হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে বইয়ের প্রচ্ছদ স্থান পেয়েছে এ দেয়ালে।
গ্রন্থ প্রাচীর দেখতে আসা রাজীব সরকার বলেন, বর্তমান প্রজন্ম মোবাইল গেম, ফেসবুক এবং ইউটিউবে আসক্ত। তারা বাঙালির জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস তেমন জানে না। এ পরিস্থিতিতে রকিব হাসান বইয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন। মানুষকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করতে তার এ চেষ্টা প্রশংসার দাবিদার।
জেবিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, অনেক দূর থেকে এসেছি বইয়ের দেয়াল-বাড়ি দেখার জন্য। এখানকার অনেকগুলো বই আমাদের ঘরে আছে। বাকি বইগুলোর নাম লিখে নিচ্ছি। তবে এখানে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার থাকলে সবাই এসব বই পড়ার সুযোগ পেত।
আরেক শিক্ষার্থী আলিায়া পারভীন বলেন, কলেজে যাওয়ার পথে প্রতিদিনই এ বাড়ির দেয়ালে তাকিয়ে থাকি। দেখতে দেখতে বই ও লেখকের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে। বইগুলো দেখে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
রকিব হাসান ভূঁইয়ার মা শামসুন্নাহার বলেন, আমাদের বাড়ির প্রাচীরের এই কাজ দেখতে অনেক লোকজন আসে। বিষয়টি আমার ভালো লাগে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাড়িতে লাইব্রেরি ছিল। ছেলেমেয়েদের বই প্রীতি আমাকে আনন্দ দেয়।
বইয়ের আদলে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের বিষয়ে জানতে কথা হয় রকিব হাসান ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বইয়ের আদলে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের ভাবনাটা এসেছে ২০১৫ সালের জাতীয় বইমেলায় গিয়ে একটি প্রকাশনীর স্টল দেখে। বুকশেলফের মতো সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে দক্ষ কারিগর পেতে অনেক খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে। তাদের সঙ্গে দিনরাত শ্রম দিয়ে কালজয়ী কিছু বইয়ের মোড়কে বাড়ির প্রাচীরটি তৈরি হয়েছে।
এই দেয়াল তৈরির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব ইত্যাদির কারণে বর্তমান প্রজন্ম বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। অথচ একজন মানুষের প্রকৃত বন্ধু হচ্ছে বই। বন্ধু ছেড়ে যেতে পারে কিন্তু বই সারা জীবন বাতিঘর হয়ে পথ দেখায়। নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার এবং বাঙালির জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস জানার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে এ উদ্যোগ নেওয়া। আমার বাড়ি দেখে কারও মধ্যে বই পড়ার চেতনা এলে আমার এ চেষ্টা সার্থক ও সফল হবে।