রংপুর অফিস
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪ ১৭:৪৫ পিএম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪ ২০:১৯ পিএম
বিয়েতে উপহার পাওয়া আসবাবপত্রের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দম্পতিরা। মঙ্গলবার রংপুরের শেখ রাসেল ইনডোর স্টেডিয়ামে। প্রবা ফটো
শেখ রাসেল ইনডোর স্টেডিয়ামে সাজ-সাজ রব। সাদা কাপড়ে ঘেরা পুরো স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ। সেখানে সারি করে রাখা ভ্যানগাড়ি, সেলাই মেশিন, গ্যাসের চুলা, বালতি, প্লেট-গ্লাস, জগ, তোশকসহ সংসারের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। প্রতিটি ভ্যানে এক-দুই করে নম্বর সাঁটিয়ে দেওয়া রয়েছে।
ইনডোর স্টেডিয়াম ভবনের সামনে গিয়ে প্রথমে চোখে পড়ে ফুলে সজ্জিত ফটক। সিঁড়ি মাড়িয়ে স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকতেই দেখা মেলে এক অন্য রকম মিলনমেলার। রাজকীয়ভাবে সাজানো মঞ্চে সারি করে বিয়ের পাঞ্জাবি, পায়জামা, জুতা, পাগড়ি পরে বসে আছেন ১৫ জন পুরুষ। আরেকটি ঘরের ভেতরে বিয়ের সাজে ১৫ জন নারী অপেক্ষায়। সবারই হাস্যোজ্জ্বল মুখ। মঞ্চের বিপরীতে বসে ছিলেন দুই পক্ষের ৩০টি পরিবারের সদস্যরা।
সেখানে আরও ছিলেন রংপুর প্রশাসনের কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্টেডিয়ামের বাহিরে বর-কনের পরিবারসহ বিয়েতে আসা তিন শতাধিক অতিথির জন্য চলছিল রান্না। পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস, জর্দা পোলাওসহ নানা খাবার তৈরিতে ব্যস্ত বাবুর্চিরা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানানো, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনে শামিল হন অতিথিরা।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সন্ধ্যায় রংপুরে এই প্রথম এমন সুসজ্জিত পরিবেশে একসঙ্গে ১৫ জোড়া বিয়ের আয়োজনে করেছে আল-খায়ের ফাউন্ডেশন। সেই সঙ্গে নবদম্পতিকে স্বাবলম্বী করতে নগদ অর্থ, ভ্যান, সেলাই মেশিনসহ সংসারের নানা উপকরণও দিয়েছে মানবিক কাজে নিয়োজিত এই সংস্থা।
রংপুর সদর উপজেলার পাগলাপীর বিড়াবাড়ী এলাকার কনে রশিদা বেগমের মামাতো বোন খাদিজা আক্তার বলেন, ‘গরিব ঘরের সন্তান আমরা। বিরাট আয়োজন করে মামাতো বোনের বিয়ে দেওয়া আমাদের জন্য অনেক কষ্টের হতো। তা সহজ করে দিয়েছে আল-খায়ের ফাউন্ডেশন। তারা যৌতুকবিহীন বিয়ের ব্যবস্থা করেছে, আর্থিক ও সাংসারিক সহযোগিতা করেছে। মেয়ে ও ছেলে দুই পরিবারই খুশি। এভাবে যদি আরও গরিব মানুষকে সহযোগিতা করে, তাহলে যৌতুকবিহীন সমাজ গড়া সম্ভব হবে।’
হরকলি পীরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কনে নার্গিস আক্তারের নানি খাদিজা বেগম বলেন, ‘মোর জামাই মারা গেইচে অনেক বছর হইল (অনেক বছর আগে স্বামী মারা গেছে)। বেটি একটা তাংকু (তামাক) কোম্পানি চাকরি করি সংসার চালায় (আমার মেয়ে চাকরি করে সংসার চালায়)। বেটির দুই বেটি ও এক ব্যাটা (তার দুই ছেলে, এক কন্যা)। বাপ মরা একটা বেটির আইজ বিয়া হইল (বাবাহারা সন্তানের মধ্য আজ এক মেয়ের বিয়ে হলো)। ম্যালা খুশি লাগতোছে (খুব খুশি আমি)। বিয়া হওয়ার সাতে সংসারের ম্যালা জিনিসও পাইল (বিয়ের সঙ্গে সংসারের অনেক আসবাবপত্র উপহার পেয়েছে)। ওমরা সুখে থাকপে (তারা সুখে থাকবে)।’
নগরীর জুম্মপাড়া এলাকার কনে নুসরাত বেগম বলেন, ‘এত বড় আয়োজন করে আমার বিয়ে, এটি ভাবিইনি। অনেক ভালো লেগেছে। সংসারের জিনিসপত্র পেয়ে আরও ভালো লাগতেছে।’
পাগলাপীর কিশামত হরকলি গ্রামের বাসিন্দা বর মারজান মিয়া বলেন, ‘কোনো চাওয়া-পাওয়া ছাড়া বিয়া করবার পারছি (বিয়ে করতে পেরেছি)। এ্যালা বুক ফুলি চলবার পামো (এখন বুক ফুলিয়ে চলব)। কাইয়ো কিছু কবার পাবার নয় (কেউ কিছু বলতে পারবে না)। মোর ভালোই আনন্দ লাগতোছে (খুব খুশি লাগতেছে)। এমন করি বিয়া হইলে যৌতুক সমাজ থ্যাকি উঠি যাইবো (এভাবে বিয়ের আয়োজন হলে সমাজে যৌতুক প্রথা থাকবে না)।’
পাগলাপীর মুলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বর আজমান হোসেন বলেন, ‘যৌতুকবিহীন বিয়ে করতে পেরে আনন্দ লাগছে। তারা চলার জন্য ভ্যান, সেলাই মেশিনসহ অন্যান্য জিনিস দিয়েছে। এসব দিয়ে সুখে-শান্তিতে সংসার করতে পারব।’
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘যৌতুক নেওয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে বেআইনি কাজ। তবে সমাজে ব্যাধি হয়ে এটি এখনও রয়েছে। আল-খায়ের ফাউন্ডেশন যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, আমি তার সাধুবাদ জানাই। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ্য ধারার সূচনা হলো। পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা নবদম্পতির জন্য উপহার দিয়েছি। আশা করছি, ভবিষ্যতে সব বিয়েই যৌতুকবিহীন হবে।’
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবু জাফর বলেন, ‘যৌতুকবিহীন বিয়ের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার হলে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা দূর হবে। যৌতুক প্রথা বন্ধে এ ধরনের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে এমন আয়োজন হলে প্রশাসন সব সময় তাদের পাশে থাকবে।’
জানা যায়, কয়েক বছর ধরে আল-খায়ের ফাউন্ডেশন যৌতুকমুক্ত বিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যাচ্ছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি সিলেটে ২৫ জোড়া যৌতুকমুক্ত বিয়ের সফলভাবে আয়োজন সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুর জেলার ১৫ জোড়া যৌতুকমুক্ত বিয়ের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেওয়া বর ও কনে উভয়ে অসচ্ছল পরিবার থেকে আসা। এসব অসচ্ছল পরিবারের কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার দুঃশ্চিন্তা লাঘবে বিনা খরচে বিয়ের আয়োজনসহ নবদম্পতিকে স্বাবলম্বী করতে জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে আল-খায়ের ফাউন্ডেশন।
আল-খায়ের ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর তারেক মাহমুদ সজীব বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে আল-খায়ের ফাউন্ডেশন প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছে। রংপুরে প্রায় প্রতিবছর শীতে শীতবস্ত্র প্রদান, বন্যা ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্যসহায়তা প্রদান, ঈদ ও রোজাকে কেন্দ্র করে খাদ্যসহায়তা প্রদান, করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। আমরা অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের ঘটা করে যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করেছি। তাদের প্রত্যেককে গাড়িতে করে এখানে নিয়ে এসেছি এবং গাড়িতে করেই বাড়িতে পৌঁছে দেব। সঙ্গে প্রত্যেক দম্পতির জন্য ট্রাকভর্তি উপহার পৌঁছে দেওয়া হবে। তারা কোনোভাবেই যেন না ভাবে তারা সুবিধাবঞ্চিত। যদি বিত্তবানরা এভাবে একটি করে পরিবারের দায়িত্ব নেয়, তাহলে যৌতুকমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাবিবুল হাসান রুমি, বাংলাদেশ ক্রিকেটে বোর্ড-বিসিবি পরিচালক রংপুর জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের শিক্ষক আজহারুল ইসলাম দুলাল, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোন্তাছের বিল্লাহ, রংপুর প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সাংবাদিক আরিফুল হক রুজু, জাভেদ ইকবাল, নজরুল মৃধা, আব্দুর রউফ সরকার, এসএম পিয়াল, মোশাররফ হোসেন রাজু, আবেদুল হাফিজ প্রমুখ। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে নৈশভোজের পর গাড়িতে করে বর-কনে ও পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।