বাগাতিপাড়া ও নাটোর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪ ১৪:৫৯ পিএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪ ২১:৩২ পিএম
চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ কবির স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিলসের (কেএসআরএম) মালিকানাধীন এ জাহাজটি ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। জাহাজটিতে আছেন বাংলাদেশি ২৩ জন নাবিক।
দস্যুরা ফোন কেড়ে নিচ্ছে। আর কথা নাও হতে পারে। বাবা-মাকে যেন এ ব্যাপারে কিছু না জানানো হয়। হয়তো কোনোদিন বাড়িতেও ফেরা হবে না। এ ছিল জয় মাহমুদের সর্বশেষ বার্তা। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপে পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে শেষ কথা হয় তার। সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে এ কথোপকথনের পর থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন জয়। বুধবার (১৩ মার্চ) এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (দুপুর আড়াইটা) একই অবস্থা বিরাজমান বলে জয়ের পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের ২৩ বাংলাদেশি নাবিকের একজন জয় মাহমুদ। তার বাড়ি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের সালাইনগর গ্রামে। তিনি এ জাহাজের অর্ডিনারি সি-ম্যান (সাধারণ নাবিক) হিসেবে কর্মরত আছেন। এমভি আব্দুল্লাহ নামের জাহাজটি চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ কবির স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিলসের (কেএসআরএম) মালিকানাধীন। জিম্মি এক নাবিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ওই সময় সাগরে চলাচলকারী আরেকটি জাহাজে কর্মরত এক বাংলাদেশি নাবিক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, অন্তত ৫০ জন জলদস্যু এই ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর জয় বিষয়টি তার চাচাতো ভাই মারুফ আলীকে জানান। মা-বাবা দুশ্চিন্তা করবেন ভেবে তাদের জানাতে নিষেধ করেন। এরপর কয়েক দফা যোগাযোগ করে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে পরিবারের এ সদস্যকে অবহিত করেন জয়।
আরও পড়ুন: পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সাব্বির এখন দস্যুদের হাতে
জয়ের চাচাতো ভাই মারুফ হোসেন বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় জয়ের বাবা-মা তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা বলেন। পরে আমিও তার সঙ্গে কথা বলি। জয় জলদস্যুর কবলে পড়েছে বলে আমাকে জানায়। বিষয়টি চাচা-চাচির কাছে গোপন রাখতে বলে জয়।’
তিনি আরও জানান, সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে জয় হোয়াটসঅ্যাপে জানায়– তাদের (সব নাবিক) ফোন কেড়ে নিচ্ছে জলদস্যুরা। এরপর থেকে জয়ের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে জাহাজ কোম্পানির কাছ খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
দুই ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় জয় এ জাহাজে চাকরি নেন ২০২১ সালে। প্রশিক্ষণ শেষে চার মাসের ছুটি কাটিয়ে জাহাজে যাওয়ার পর আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার।
সাগরপথে আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজ পরিচালনার ব্যবসায় দীর্ঘদিন ধরে জড়িত চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ কেএসআরএম। তাদের বহরে ২৩টি জাহাজ রয়েছে। ১৪ বছর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর এই গ্রুপটির মালিকানাধীন ‘জাহান মনি’ নামের আরেকটি জাহাজও সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। তখন জিম্মি হওয়ার ১০০ দিন পর মুক্তিপণ দিয়ে ২৬ নাবিকসহ জাহাজটি ফিরে পেতে সক্ষম হয় কেএসআরএম। এখন ফের এ শিল্প গ্রুপটিকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে ১৪ বছরের পুরোনো সেই ভয়ানক স্মৃতির। এবার জিম্মি হওয়া ২৩ নাবিককে উদ্ধার করতে কত দিন লাগতে পারে, সে ব্যাপারে এখনও কোনো ধারণা করতে পারছে না শিল্প গ্রুপটি।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী– এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজ ও জাহাজের ২৩ নাবিকের মুক্তিপণ বাবদ ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫০ লাখ ডলার দাবি করেছে জলদস্যুরা। জাহাজটির মালিকপক্ষ দস্যুদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জিম্মি নাবিক ও জাহাজ উদ্ধার করতে মালিকপক্ষ তৎপরতা শুরু করেছে বলে জানা গেলেও তারা কিন্তু মুক্তিপণের অর্থের পরিমাণ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বলা হচ্ছে, জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। আলোচনা চলছে। এখনও সুরাহা হয়নি। তবে আশা করা যায়, জলদস্যুদের কবল থেকে নাবিকদের উদ্ধার করে আনা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: ‘ও আল্লাহ, আমার ছেলেরে আমার বুকে ফেরত দেন’
নাবিক জয় মাহমুদের মা আরিফা বেগম বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা যেন সহিসালামতে থাকে। তাকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও মাবুদ।’
বাবা জিয়াউর রহমান জানান, বাড়ির বাইরে থাকায় বিষয়টি ফোনে জানতে পারেন তিনি। বাড়িতে এলে বিষয়টি নিশ্চিত হন। ছেলের জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবরে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
জয়ের বাবা বলেন, ‘আমার ছেলেসহ জিম্মি হওয়া সবাইকে দ্রুত উদ্ধার করা হোক, সরকারের কাছে এটাই আমার আবেদন।’
খবর পেয়ে জয়ের বাড়িতে গিয়ে জয়ের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) হেলাল উদ্দিন। স্থানীয় ইউপি সদস্য মজিবর রহমান বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই– আটকা পড়াদের যেন দ্রুত উদ্ধার করা হয়।’
নাবিকদের স্বজনদের দাবির বিষয়ে কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম জানান, জাহাজের মালিকপক্ষ নাবিকদের উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনা ফলপ্রসূভাবে শেষ করতে মালিকপক্ষ বদ্ধপরিকর।