× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ

‘অল্প বেতনে কাজ করায় ঝুঁকি নিয়ে বাস করি’

রেজাউল করিম ও আবু সাঈদ, গাজীপুর

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪ ১১:২১ এএম

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪ ১২:৩২ পিএম

১৩ মার্চ গাজীপুরের কালিয়াকৈরের তেলিরচালায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতীকী ছবি

১৩ মার্চ গাজীপুরের কালিয়াকৈরের তেলিরচালায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতীকী ছবি

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকায় ১৩ মার্চ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩৬ জনকে ভর্তি করানো হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ভর্তির পর থেকে প্রতিদিন দগ্ধদের কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। বুধবার (২০ মার্চ ) দুপুর পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ জনে। দগ্ধ অন্যদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। 

এলাকাবাসী ও নিহতদের স্বজনরা বলছেন, ঘটনার পর কেউ বুঝতে পারেনি বিষয়টি এতটা ভয়ানক হবে। একে একে মৃত্যুর খবর আসতে থাকবে। সবাই ভেবেছিল, চিকিৎসা শেষে সবাই ফিরে আসবে আবার। ফিরে তারা আসছে ঠিকই কিন্তু লাশ হয়ে। ১৪ জন মারা গেছেন। মনে হচ্ছে বাকিরাও সুস্থ হবে না। অনেক পরিবারের সন্তান চলে গেছে না ফেরার দেশে। অনেক পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষটিও চলে গেছে। প্রতিদিন কারও না কারও মৃত্যুর খবরে আতঙ্কিত এলাকার মানুষ। 

এদিকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দগ্ধদের মধ্যে যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের কাউকে শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। ফলে ধারণা করা হচ্ছে বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যা। 

সরেজমিনে তেলিরচালা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি টিনের ঘর। প্রতিটি ঘরেই একটি করে পরিবারের বসবাস। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরে গ্যাসের সিলন্ডার দিয়ে চলে রান্নার কাজ। সেখানেই চলে পরিবারগুলোর থাকা খাওয়া। প্রতিটি ঘরের মানুষগুলো যেন বাস করছেন এক একটি বোমা নিয়ে। ২৫ টি কলোনিতে এখানে রয়েছে টিনের প্রায় ৬০০টি ঘর। এসব ঘরে বসবাস প্রায় দুই হাজার মানুষের। যারা স্থানীয় বিভিন্ন কারখানায় স্বল্প বেতনে চাকরি করে জীবিকার নির্বাহ করেন। আর্থিক অসচ্ছলতার দরুণ কম ভাড়ায় জীবনের ঝুকি নিয়েই ছোট এই কক্ষগুলোয় পরিবার নিয়ে বাস করেন তারা। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ঘরগুলোয় ঘনবসতির কারণে যে কোনও সময় বড় ধরনের ক্ষয় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বসবাসকারীরা।

তেলিরচালার একটি গলিতে কয়েকজন নারী আগুনে দগ্ধদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তাদের কথায় ছিল আফসোস। পোশাক কারখানার শ্রমিক আমেনা বেগম, ১২ বছরের মেয়ে শারমিনকে নিয়ে ভাড়া থাকেন এখানকার একটি কলোনির ঘরে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তিনি ছিলেন কারখানায়। খবর পান তার মেয়ে আগুনে পুড়ে গেছে। মেয়েকে উদ্ধার করে নিয়ে যান ঢাকায়। শারমীনের পা পুড়ে গিয়েছে। ফলে সে অন্যদের তুলনায় কিছুটা শঙ্কামুক্ত। আমেনা বেগম বলেন, প্রতিদিন একজন একজন করে মরার খবর পাইতাছি। মনটা খুবই খারাপ। কাছের কয়েকজন মানুষও মারা গেছে। 

একটি ঘরের ভাড়াটিয়া ইসমত আরা বলেন, আমাদের সামনে ঘরে গত তিন মাস আগে উঠেছিল সজল মিয়া। আগুনে তার ছেলে তাওহিদ ও মেয়ে তায়েবার মৃত্যু হয়। পরিবারসহ তারা এখন গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ আছেন। সেদিনের পর থেকে তাদের ঘরে তালা ঝুলছে।

দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ১১ বছরের শিশু গোলাম রাব্বির পিতা শাহ আলম। কথা হয় তার সঙ্গে। কান্নায় আটকে আসা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘মা মরা ছেলেটি স্কুল ছুটি থাকায় আমার কাছে বেড়াতে এসেছিল। এখানে এসে আগুনে পুড়ে মারা গেল।’ শাহ আলম আরো বলেন, ‘বাড়ির মালিক শফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে ঝগড়া করেন। ঝগড়াঝাঁটির এক পর্যায়ে শফিকুল সিলিন্ডারটি বাসার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন। শো শো শব্দে সিলিন্ডারটি থেকে গ্যাস বের হতে থাকে। পাশে মাটির চুলায় রান্না করছিলেন এক নারী, সেখানে সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হলে আশেপাশের নারী শিশুসহ অগ্নিদগ্ধ সবাই জীবন বাঁচাতে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন। আমার ছেলে রাব্বির গায়েও আগুন লাগে তখন। ৫ দিন আইসিইউতে থাকার পর মারা যায় রাব্বি।’ একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নিঃস্ব এই বাবা ঘটনার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ন্যায় বিচার দাবি করেন। 

পোশাক শ্রমিক আমির হোসেন বলেন, ‘আমরা এখন আতঙ্ক নিয়ে পরিবারসহ বাস করি। কয়টা টাকা বেশি পাওয়ার লোভে মালিকরা ছোট ছোট ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। বিদ্যুতের লাইন বা গ্যাস সিলিন্ডারের আগুন যদি কোনও রুমে লাগে তাহলে পুরো এলাকাটি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এখানে নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে চিকন রাস্তা দিয়ে বের হতে গিয়ে পায়ের নিচে পড়েই মারা যাবে অনেকে। আমারা অল্প বেতনে কাজ করি। তাই কম টাকায় এখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করি।’ 

শাপলা খাতুন নামের আরেক বাসিন্দা উদ্বেগ নিয়ে বলেন, সেদিনের ঘটনায় অনেকে আগুনে পুড়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪ জন মারাও গিয়েছেন। এই এলাকায় এতই ঘনবসতি আর রাস্তাগুলো সংকীর্ণ যে বড় কোনও ঘটনা ঘটলে মানুষ বের হতে পারবে না। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস বা উদ্ধারকারিরাও সময়মতো কাজ শুরু করতে পারবে না। 

সেদিনের ঘটনায় বাহিউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিও আগুনে দগ্ধ হন। তিনি বলেন, ‘শো শো শব্দ পেয়ে ঘটনাস্থলে দেখতে গিয়ে আমার শরীরেও আগুন লাগে। টাকা-পয়সার টানাটানিতে চিকিৎসা নিতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার ঈদের আনন্দ শেষ হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম পরিবারের সঙ্গে গ্রামে গিয়ে এবার ঈদ করবো। অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আচি। কোম্পানি তো আর আমাকে বেতন দিবে না। স্ত্রীর বেতনের টাকায় কোনভাবে চিকিৎসা চলছে।

আগুনের সূত্রপাত হয় এখানকারই ঘরের মালিক শফিকুলের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার শেষ হয়ে যাওয়ায় আমার স্ত্রী তার ভাই মালেককে একটা সিলিন্ডার পাঠাতে বলে। মালেক আমার ছেলেকে দিয়ে সিলিন্ডার পাঠায়। সিলিন্ডারটি সংযোগ দিতে গেলে চাবি ভেঙ্গে গিয়ে গ্যাস ঘরের ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় নিজেকে বাঁচাতে সিলিন্ডারটি ঘরের বাইরে গলিতে ফেলে দেই। এ সময় লোকজনদের কাছে না আসতে বললেও কেউ কথা শোনেনি। পরে গলিতে কাঠের চুলায় রান্না করার আগুনে গ্যাসের সংস্পর্শে দুর্ঘটনা ঘটে।

গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রয়কারী ওমেগা গ্যাসের সাব ডিলার এরশাদ রানা বলেন, আমার দোকান থেকে মালেক একটি গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যায়। তিনি সিলিন্ডারটি একটি ছোট ছেলেকে দিয়ে বাড়িতে পাঠায়। ছেলেটি সিলিন্ডার নেওয়ার পথে আছাড় খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে সংযুক্ত করলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। 

নিহত ১৪ জনের পরিচয়

আগুনের ঘটনায় নিহতরা হলেন সিরাজঞ্জের শাহাজাহানপুর উপজেলার আলমপুর গ্রামের হোসেন মোল্লার  ছেলে সোলায়মান মোল্লা (৪৫), তিনি মৌচাক তেলিরচালায় ভাঙারির ব্যবসা করতেন। নিহত হয়েছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আলমপুর গ্রামের আরিফ হোসেন (৪০)। তিনি মৌচাক এলাকায় স্থানীয় একটি কারখানার চাকরি করতেন। এছাড়াও বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মানদহ গ্রামের মনসুর আলী (৩৫) এই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে নিহত হন। তিনি পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। মারা গিয়েছেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়ইহাটি গ্রামের সজল মিয়ার মেয়ে তায়েবা (৫) ও ছেলে তাওহিদ (৭)। 

এছাড়াও সিরাজগঞ্জের নার্গিস আক্তার, স্থানীয় একটি গার্মেন্টস চাকুরি করতেন। নিহত মাইদুল ইসলাম (২৫) ওই এলাকায় একটি ঝুটের গোডাউনের শ্রমিক ছিলেন। জহিরুল কুটি (৩২), পেশায় ছিলেন মধু বিক্রেতা। শাহ আলমের ছেলে রাব্বি (১৩)। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সদর এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে সোলাইমান (৯)। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ইদুলপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে মোতালেব হোসেন (৪০)। কুষ্টিয়ার খোকসা ইয়াসিন আরাফাত (২১) ও লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা মশিউর আলী (২২)। সর্বশেষ বুধবার সকালে মারা গেছেন কমলা খাতুন (৬৫)। 

কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউছার আহাম্মেদ বলেন, বুধবার সকাল পর্যন্ত দগ্ধদের মধ্যে থেকে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি তহবিল থেকে আহতদের সাড়ে ৭ হাজার এবং নিহত প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা