সুফল চাকমা, বান্দরবান
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪ ২৩:৩৬ পিএম
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪ ২৩:৫২ পিএম
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লেমুপালং ও শিলাঝিরি এলাকায় বনের গাছ কেটে জড়ো করা হয়েছে। প্রবা ফটো
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই এলাকায় দুই শতাধিক গাছ কেটে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মোরশেদ আলম চৌধুরী এসব গাছ কেটেছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি গাছ কেটে পাচার করছেন বলেও পাহাড়বাসী অভিযোগ করেছে। পরিবেশ দপ্তর বা বন বিভাগ ব্যবস্থা না নিয়ে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে দুর্গম এলাকার অজুহাত দেখিয়ে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পাহাড়বাসী।
গত রবিবার বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংগিপাড়া, বাক্কাপাড়া, দেওয়ানপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাড়াগুলোর পাশ দিয়ে বয়ে চলা লেমুপালং খাল ও শিলাঝিরি এলাকার বনাঞ্চল থেকে হাতি দিয়ে অবাধে গাছ টেনে নেওয়া হচ্ছে। তিন মাস ধরে এই কাজ চলছে জানিয়ে এলাকাবাসী বলেন, প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে এই খাল ও ঝিরির ওপর দিয়ে হাতি দিয়ে বনের গাছ টানা হয়। সরেজমিন লেমুপালং খাল ও শিলঝিরি এলাকার বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক গাছ জড়ো করা হয়েছে। গাছগুলোর একেকটির বেড় তিন থেকে পাঁচ ফুট, আর দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ৫০ ফুট। গাছের মধ্যে আছে চাম্পা, জারুল, কড়ই, গুটগুটিয়া, জলপাই, চাপালিশ, হারগাছা, গর্জন, গামারি, সেগুন প্রভৃতি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, মোরশেদ আলম চৌধুরী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। ভয়ে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না। এসব গাছ পাচার হচ্ছে ক্যজুপাড়া-আমিরাবাদ সড়ক দিয়ে। ক্যজুপাড়া পড়েছে বান্দরবানের লামা উপজেলায়। আর আমিরাবাদ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোরশেদ আলম চৌধুরী ওই এলাকায় এক যুগের বেশি সময় ধরে কাঠের ব্যবসা করেন। তিনি কিছু গাছ নামমাত্র দামে বেচতে বাধ্য করেন এবং না কিনেও গাছ কেটে নেন।
বাক্কাপাড়ার কার্বারি (গ্রামপ্রধান) বাক্কা ম্রো প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ১৩টি পাড়ার লোকজনকে জিম্মি করে মোরশেদ আলম চৌধুরী ও তার ম্যানেজার রফিকের নেতৃত্বে ২০-৩০ জন শ্রমিক বনাঞ্চল কেটে সাবাড় করছে। সরকারি গাছের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাছও জোর করে কেটে নেন মোরশেদ। তাছাড়া মোরশেদ আলমের হাতি এলাকাবাসীর ফসল নষ্ট করে।
সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মেনওয়াই ম্রো বলেন, ‘মোরশেদ আলম চৌধুরী সব গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করলে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করে। আমি প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে মোরশেদ আলম চৌধুরীর কর্মচারী মো. আজম হত্যাসহ তিনটি মামলা করে। ২০২২ সালে সব মামলায় আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই।’ মেনওয়াই ম্রো অভিযোগ করেন, ‘মোরশেদ আলমকে সহযোগিতা করেন লেমুপালং মৌজার হেডম্যান কাইং ওয়াই ম্রো।
হেডম্যান কাইং ওয়াই ম্রো নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘মোরশেদ আলম চৌধুরী হুমকি দিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি আমার মৃত পিতার কাছে মৌজার বন ক্রয় করেছিলেন। সেজন্য আগামী ৩০ বছর গাছ কাটবেন। কিন্তু মোরশেদ আলম দালিলিক প্রমাণ দেখাতে বললে দেখান না। প্রতিবাদ করলে মামলা দিয়ে হয়রানি করেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে হেডম্যান বলেন, ‘মোরশেদ আলম চৌধুরীর ম্যানেজার মো. রফিক হুমকি দিয়ে বলেন, কোর্ট-উকিল-পুলিশ সব নাকি তাদের। তবু আমরা এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম। সবাই মিলে মোরশেদ ও তার শ্রমিকদের বিতাড়িত করেছিলাম ২০১৫ সালে। তখন মোরশেদ আলম চৌধুরী তার লোক দিয়ে এলাকার তিনজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। পাঁচ বছর মামলা পরিচালনা করে তথ্য-প্রমাণ না পেয়ে সেই মামলা থেকে ২০২০ সালে সবাই বেকসুর খালাস পান।’
এর জন্য বন বিভাগের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছেন বান্দরবান জেলা হেডম্যান কার্বারি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি হ্লা থোয়াই হ্রি মারমা। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘বন বিভাগের সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বন থেকে কাঠ পাচার রোধ করা সম্ভব।’
কিন্তু স্থানীয় বন বিভাগ বন সাবাড়ের কোনো খবরই পায়নি বলে দাবি করেছে। লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আরিফুল হক বেলাল বলেন, ‘বন উজাড় করে হাতি দিয়ে গাছ পাচার করা সম্পর্কে জানি না। আপনার (প্রতিবেদক) কাছে এই প্রথম শুনলাম।’ গাছ কাটার অনুমতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘লেমুপালং মৌজ এলাকায় বন বিভাগ থেকে বনের গাছ কাটার জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, গত বছর অভিযান চালিয়ে গাছ জব্দ করে মামলা করা হয়েছে। লামা বন বিভাগ থেকে দ্রুত অভিযান পরিচালনার জন্য ডলুছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেবেন এবং নিজেই খোঁজখবর নেবেন বলে জানান তিনি।
আর পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, এলাকাটি দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তারা কিছু করতে পারছেন না। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন চৌধুরী পরিষ্কার করে বলেন, ‘এলাকাটি দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ।’ লেমুপালং মৌজা এলাকায় পরিবেশ ধ্বংস করার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা হবে বলে তিনি জানান।
অভিযোগের বিষয়ে কাঠ ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতা মোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, ‘যে গাছগুলো আপনারা দেখেছেন, সেগুলো আমার নয়। আমার হাতিও নেই। আমি অসুস্থ। জায়গা জিম্মি করে গাছ কাটার অভিযোগ সঠিক নয়। আমি বৈধভাবে সরকারি অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিপক্ষ ক্ষতি করার জন্য আমার নামে বদনাম করছে।’ তিনি মামলা দিয়ে হয়রানি করা বা হাতি দিয়ে ফসল নষ্ট করার অভিযোগও অস্বীকার করেছেন।