স্বাস্থ্য ও পরিবেশ
সাইফুল ইসলাম, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)
প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৪ ১১:২৩ এএম
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৪ ১১:২৭ এএম
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পাড়াগাঁওয়ের আপন টেক্সটাইলে রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত অপরিশোধিত পানি ফেলা হয় এই খালে। খালের পানি বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ নানা ধরনের জটিলরোগে আক্রান্ত হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
পানি নয়, কেউ যেন রক্ত ঢেলে রেখেছে পাড়াগাঁও খালে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পাড়াগাঁও এলাকার এই খালের দুই পাশ দিয়ে ২২টি গ্রামে বাস করেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভুলতা থেকে মুড়াপাড়া হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই খালের পাশ দিয়ে কেউ নাকেমুখে কাপড় গুঁজে হাঁটছে, কেউবা মুখে মাস্ক পরেছে।
পাড়াগাঁওয়ের আপন টেক্সটাইলের রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত অপরিশোধিত পানি ফেলা হয় এই খালে। একসময় এই খালের পানি দিয়ে কৃষক জমিতে সেচ দিত। ২২ গ্রামের মানুষ বেশির ভাগই কৃষিনির্ভর ছিল। আপন টেক্সটাইল মিল গড়ে উঠলে খালের পানি বিষাক্ত হয়ে যায়। মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে না পারলেও আদি পেশা কৃষিকাজ ছেড়ে চলে যায় বিভিন্ন পেশায়। কেউবা হয় দিনমজুর বা কারখানার শ্রমিক। কিন্তু দিনদিন তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সহনশীলতার বাইরে চলে যায়। শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, গাছপালাও মরে যাচ্ছে। এমনকি মরে ভেসে উঠেছে এলাকার বেশ কয়েকটি খামারের মাছ। পুরো এলাকার মানুষ এখন আতঙ্কে ভুগছে। এ ছাড়া বিষাক্ত পানি শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে সৃষ্টি করছে ভয়াবহ দূষণ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পাড়াগাঁওয়ের মতো জনবহুল এলাকায় আপন টেক্সটাইল কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। এ কারখানায় সোডা, পারঅক্সাইড, ডিটারজেন্ট, সিকুস্টারিং এজেন্ট, সোপিং এজেন্ট, রিডাকশন এজেন্ট, এসিটিক এসিডসহ বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকারক কেমিক্যাল ব্যবহার হয়। স্থানীয়রা বেশ কয়েকবার কারখানা কর্তৃপক্ষকে এভাবে অবাধে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি খালে ফেলতে নিষেধ করা হলেও কাজ হয়নি। বরং তারা মিথ্যা মামলা ও হামলার ভয় দেখায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
সালমা আক্তার নামে একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘খালের পাশ দিয়ে গেলে নাকেমুখে হাত অথবা কাপড় গুঁজে দিয়ে যেতে হয়। পানির দুর্গন্ধে যেন দম বন্ধ হয়ে যায়। খালের পানি রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে।’
এলাকার কৃষক চান মিয়া বলেন, ‘বাবাগো, কয় বছর আগেও জমিতে ধান লাগাইলে অনেক ফলন পাইতাম। কিন্তু আপন টেক্সটাইলের ডায়িং কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত পানির কারণে ফলন আর আগের মতন হয় না। তাই লাইগ্যা চাষাবাদ ছাইড়া দিয়া ভ্যান চালাইয়া সংসার চালাইতাছি।’
আরেক কৃষক মোক্তার ভুঁইয়া বলেন তার দুঃখের কথা। তিনি বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে এই খালের সরাসরি সংযোগ। আপন টেক্সটাইল কারখানা কর্তৃপক্ষ বিষাক্ত পানি ছাড়ার কারণে খাল নষ্ট হচ্ছে। আর এ খালের পানি নদীতে মিশে শীতলক্ষ্যা নদীকেও দূষিত করছে।’
এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আইভী ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এটি মানবদেহের জন্য হুমকিস্বরূপ। কেমিক্যাল মিশ্রিত পানির সংস্পর্শে গেলে চর্মরোগ, আলসার, ক্যানসারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য মরণব্যাধি হতে পারে।’
এ ব্যাপারে আপন টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান মিলন গাজীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। মিলটি দেখাশোনা করেন ভুলতা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন। আবুল হাসানও স্বীকার করেন তাদের বেআইনি কার্যক্রমের কথা।
তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই আমরা কারখানা চালাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইটিপি ব্যবহার করেই খালে পানি ফেলি। তবে মাঝে মাঝে ইটিপি বন্ধ থাকলে বর্জ্যসহ পানি ফেলা হয়।’
তবে তিনি ভয় দেখানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাফিজুর রহমানকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যেহেতু আপনার মাধ্যমে জেনেছি, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’