আবুল হাসান, মোংলা (বাগেরহাট)
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৪ ০৯:৫১ এএম
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৪ ১১:১৬ এএম
বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সুন্দরবনে ডিজিটাল মনিটরিংয়ে (নজরদারি) কমেছে অপরাধ। স্মার্ট টহল ব্যবস্থা নিশ্চিতে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে ড্রোন দিয়ে চলছে মনিটরিং কার্যক্রম। এতে গত ছয় বছরে সুন্দরবন থেকে ২ হাজার ৮১৯ শিকারি ও অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।
সুন্দরবন বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগেও বনরক্ষী এবং নৌকাচালক নৌকাযোগে সুন্দরবনে টহল দিতেন। তখন টহল পরিমাপ পদ্ধতি, তথ্য সংরক্ষণ, আইন প্রয়োগের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সীমাবদ্ধতা ছিল। বর্তমানে স্মার্ট টহল পরিচালিত হচ্ছে। ৮-১০ জনের টহল দল গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে বুকে গো-প্রো ক্যামেরা বেঁধে এবং বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে জলে-স্থলে টহল দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে থাকছে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ, জেনারেটর, ১২-১৪ দিনের খাবার ও ওষুধ, দ্রুতগামী জলযান, লগ বই এবং জিপিএস রিসিভার। তারা সহজেই বন্যপ্রাণী, এদের প্রতি হুমকিসমূহ ও অপরাধীকে শনাক্ত করেন। সেই সঙ্গে মালামাল আটক ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করছেন। পরবর্তী দিনের টহল পরিচালনার দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। টহল শেষে তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন তৈরি, বন্য প্রাণী ও এদের আবাসস্থল, অপরাধ-অপরাধী, বন্য প্রাণী শিকারি, বন্য প্রাণীর সংখ্যা, বনজসম্পদ আহরণের স্থানগুলোর বিষয়ে ডেটাবেজও তৈরি করছেন। এর ফলে লগ বই ও জিপিএস রিসিভারের স্থান দখল করেছে সাইবার ট্র্যাকার। সাইবার ট্র্যাকার হলো একটি মোবাইল এপ্লিকেশন। যা জিপিএস সুবিধাসম্পন্ন যেকোনো স্মার্ট মোবাইল ফোনে ইনস্টল করে টহল কার্যক্রম চালানো যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাঘ প্রকল্পের সহযোগিতায় ২০১৫ সালের জুন মাস থেকে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের পশ্চিম বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে স্মার্ট টহল শুরু হয়। স্ট্রেনদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন প্রকল্পের অর্থায়নে ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে সুন্দরবনের অন্যান্য রেঞ্জে স্মার্ট টহল সম্প্রসারণ করা হয়। এর মাধ্যমে অবৈধ অনুপ্রবেশ, অননুমোদিত জাল ব্যবহার, কাঁকড়া ধরা, বন্য প্রাণী শিকার এবং শিকার নিষিদ্ধ এলাকায় মাছ ধরা রোধ সম্ভব হয়েছে। সেইসঙ্গে বন্য প্রাণী হত্যা ও অপরাধ কমেছে।
প্রতি রেঞ্জে নিয়মিত দুটি দল মাসে দুবার পর্যায়ক্রমে টহল দেয়। প্রত্যেক দল ১২-১৪ দিন এবং প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা টহল দেয়। সংরক্ষিত এলাকার প্রবেশযোগ্য সব স্থানে জলযানে ও পায়ে হেঁটে কার্যক্রম চালানো হয়। অপরাধপূর্ণ এলাকা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। টহলের সময় বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ এবং বনে অপরাধ অনুসন্ধান করা হয়। অপরাধের প্রমাণ, আলামত সংগ্রহ, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি এবং গ্রেপ্তার করা হয়।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল জানান, স্মার্ট টহলের কারণে সুন্দরবনে অপরাধ, বন্য প্রাণী এবং হরিণ হত্যা কমেছে। এছাড়া সহজেই বন্য প্রাণী, এদের প্রতি হুমকিসমূহ ও অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল মনিটরিংয়ের আওতায় নদী ও খাল নজরদারিতে ড্রোন ব্যবহার হয়। এর সফলতাও পাওয়া গেছে। এসব কাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে অপরাধীর সন্ধানদাতার পরিচয় গোপন রাখা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্মার্ট টহলের আওতায় ২ হাজার ৮১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ নৌযান, মাছ ও প্রাণী শিকারের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।’
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ খুলনার মৎস্য বিশেষজ্ঞ মফিজুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলো মানুষ ও ধরিত্রীর বন্ধন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণে ডিজিটাল উদ্ভাবন। এই প্রতিপাদ্য অনেক আগে থেকেই সুন্দরবন এলাকায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর আওতায় ড্রোন দিয়ে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। স্মার্ট টহলে সুন্দরবনের গহীনের খালেও নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। বনে বিষ দিয়ে মাছ শিকরের ঘটনা এখন তেমন আর ঘটছে না।’