সিআরবির শতবর্ষী গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণ
চট্টগ্রাম অফিস
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৫৩ পিএম
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪ ২০:০৮ পিএম
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগরীর সিডিএ ভবনে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিডিএর চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রবা ফটো
আন্দোলনের মুখে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের নকশা সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর টাইগারপাসে শতবর্ষী গাছ কেটে এই র্যাম্প নির্মাণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সিডিএ। তবে র্যাম্প নির্মাণের জন্য কোনোভাবেই গাছ কাটা এবং দ্বিতল সড়কের ক্ষতি করা যাবে না বলে সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষকে জানিয়ে দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর সিডিএ ভবনের সম্মেলন কক্ষে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিডিএর চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মতবিনিময় করেন। এ সময় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা টাইগারপাস ও সিআরবির এলাকার সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রাখতে এই এলাকায় র্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ জানান।
মতবিনিময় সভায় একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর টাইগারপাসের দ্বিতল সড়ক এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সেখানে আমার মনে হয় না র্যাম্পের কোনো প্রয়োজন আছে। র্যাম্প হলে একটি কুৎসিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এতগুলো র্যাম্পের দরকার কেন হবে? আমিও তো আরবান প্ল্যানিংয়ের (নগর-পরিকল্পনা) ছাত্র। আরবান প্ল্যানিং হবে এমন যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং জঞ্জাল যেন সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এলিভেটেড মানেই ওপর দিয়ে দূর দূরান্তের গাড়ি যাবে। সব রাস্তায় সেটাকে কেন নামাতে হবে। বেশি র্যাম্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যেই যানজট সৃষ্টি করবে। চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন, আপাতত বন্ধ করে দিন। আমরা সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নেব এ বিষয়ে কী করা যায়। চট্টগ্রামের নাগরিকরা নিজেদের মতামত জানাবেন।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘কেন গাছ কাটতে হবে? চট্টগ্রামের মানুষের সেন্টিমেন্টের বাইরে কিছু করবেন না। আমরা বিশেষজ্ঞদের নাম দেব। সবাই মিলে যেটা ঠিক করব সেভাবে হবে।’
কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বলেন, ‘শতবর্ষী গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণ চট্টগ্রামের জনগণ এটা চায় না। এখানে র্যাম্প করবেন না। সাধারণ মানুষ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে না। এখানে টোল দিয়ে উঠতে হবে। এখানে কোনো র্যাম্প করবেন না।’
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্যের জবাবে সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি শুরুতে কেউ বলেছিল বারেক বিল্ডিংয়ে, কেউ বলেছে দেওয়ানহাটে শেষ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন লালখান বাজারে নামাতে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেওয়ানহাটে নামালে সুফল মিলবে না। ৩৫টা র্যাম্পের দাবি ছিল। কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে র্যাম্প করতে শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে না। ছোট কিছু গাছ কাটা হবে। বন বিভাগ মার্কিং করেছে। আমরা করিনি। নকশা দেখলে বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনে সাইজ আরও ছোট করতে বলেছি।’
তিনি জানান, র্যাম্প নির্মাণের বিদ্যমান নকশা সংশোধন করা হবে। সংশোধিত নকশা নিয়ে ঈদের পর আবার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসবেন তারা। তখন সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘র্যাম্প নির্মাণ করতে কোনো শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে না। শুধু একটি শতবর্ষী গাছের ডাল কাটা যাবে। র্যাম্প যদি এখানে তুলতে চাই নকশা আরেকটু মোডিফাই করব। ঈদের পরে দেখানো হবে। সবাই যদি মত দেন, তাহলে কাজ বাস্তবায়ন করা আমার দায়িত্ব। র্যাম্প দরকার না হলে করব না।’
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী, সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি চৌধুরী ফরিদ, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী প্রমুখ।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর টাইগারপাসের শতবর্ষী গাছ রক্ষায় এবং দ্বিতল সড়ক অক্ষত রাখার দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো মঙ্গলবারও আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন টাইগারপাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় একটি গাছে লাল কাপড় টানিয়ে দেন তারা। সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে ওই এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলা উদ্দিন। তিনি গাছ না কাটার দাবিতে শতবর্ষী গাছে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেন।
এদিকে আন্দোলনের মুখে মঙ্গলবার দুপুরে র্যাম্পের জন্য নির্ধারিত টাইগারপাসের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়ক পরিদর্শন করেছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বোর্ড সদস্য ও প্রকল্প পরিচালক।
এ সময় সিডিএর বোর্ড সদস্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, ‘টাইগারপাসের এই দ্বিতল সড়ক এশিয়ার অন্যতম সুন্দর রাস্তা। ৪৪টি গাছের গুরুত্বপূর্ণ আবেদন আছে। র্যাম্পের প্রস্থ কমিয়ে সমাধান করা হলেও ৪৪টি গাছ থাকবে না। অন্যদিকে র্যাম্প না হলে পলোগ্রাউন্ড টাইগারপাসের কানেক্টিভিটি হচ্ছে না। তখন নিউমার্কেট থেকে আসা গাড়িগুলোতে জিইসি বা আগ্রাবাদ থেকে উঠতে হবে। যদি ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা না যায়, তাহলে র্যাম্প করা না হোক। বিকল্প কোনো পথ বের করা যায় কি না, তা সিডিএকে অনুরোধ করব।’
এর আগে যান চলাচলের সুবিধার্থে ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’তে মোট ১৫টি র্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর সিআরবি এলাকা হয়ে টাইগারপাস মোড় পর্যন্ত একটি র্যাম্প নির্মিত হবে। র্যাম্পটি নির্মাণে মহানগরীর ‘ফুসফুসখ্যাত’ সিআরবি এলাকার প্রায় অর্ধশত শতবর্ষী গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সেবা সংস্থা সিডিএ। ইতোমধ্যে সবুজঘেরা সিআরবি এলাকায় এসব শতবর্ষী গাছে রঙ দিয়ে নম্বরও দেওয়া হয়েছে। র্যাম্পের পিলার কোথায় হবে, সেটাও চিহ্নিত করে লাল রঙ দিয়েছে সংস্থাটি।
এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সোম ও মঙ্গলবার দিনব্যাপী আন্দোলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে ‘নাগরিক সমাজ- চট্টগ্রাম’। যার ফলে মঙ্গলবার বিকালে নকশা পরিবতর্নের সিদ্ধান্ত নেয় সিডিএ।