× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অর্থনৈতিক অঞ্চল

সম্ভাবনার সন্দ্বীপ হবে ‘সিঙ্গাপুর’

এস এম রানা ও আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০৬ এএম

আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৫০ পিএম

সন্দ্বীপে নতুন করে জেগে উঠেছে  বিস্তৃত  চর। এসব চরাঞ্চলের কিছু অংশে গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। দীর্ঘাপাড়া এলাকার ছবি। তানভীর মাহমুদ

সন্দ্বীপে নতুন করে জেগে উঠেছে বিস্তৃত চর। এসব চরাঞ্চলের কিছু অংশে গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। দীর্ঘাপাড়া এলাকার ছবি। তানভীর মাহমুদ

সন্দ্বীপ। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে একটুকরো বিচ্ছিন্ন জনপদ। একসময় জলপথে সহজ যোগাযোগ সুবিধার কারণে যে ভূমিতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা তাদের জাহাজ নোঙর করতেন এবং বসতি স্থাপনে আগ্রহী হতেন, যেখানে প্রাণের আবাদ হয়েছিল হাজার বছর আগে, সেই ভূমিতেই সপ্তদশ শতকে ছিল জাহাজ, লবণ ও বস্ত্রশিল্পের সম্ভার। সময়ের ব্যবধানে সেই সোনা ফলানো উর্বর ভূমিতেই আছড়ে পড়তে থাকে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরের ঢেউ। ধারাবাহিক ভাঙনে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ৭৬২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সন্দ্বীপের ভূমি টিকে থাকে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ ভূমিই নাই হয়ে যায়। 

বেঁচে থাকার অবলম্বন ভূমিসহ সর্বস্ব হারানো তরুণ, যুবক ও শিক্ষিতরা জীবিকার সন্ধানে দ্বীপ ছেড়ে হয়ে যান দেশ-দেশান্তরী। আর যারা নিরুপায় হয়ে দ্বীপ আঁকড়ে থাকেন তাদের বড় একটি অংশ জীবন পার করেন চরম দারিদ্র্যে। 

সেই হতশ্রী জনপদে নতুন স্বপ্নের জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। সন্দ্বীপে ফের শিল্পসম্ভার হবে, সেখানকার কলকারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে আয় হবে বিলিয়ন ডলার, মানুষের জীবনমান বাড়বে, যোগাযোগ অবকাঠামো সুদৃঢ় হবে, সমানতালে এগোবে কৃষি, মৎস্য ও পর্যটন খাত- এমন স্বপ্ন এখন হাতের মুঠোয়। সন্দ্বীপের চারপাশে বঙ্গোপসাগরের বুক চেতিয়ে জেগে ওঠা হাজার হাজার একর চরে জন্ম নেওয়া স্বপ্নের নাম ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’। 

সার্বিকভাবে জটিল জীবন-জীবিকার এই দ্বীপ হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির গেমচেঞ্জার। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির সমৃদ্ধ দেশ সিঙ্গাপুরের আয়তন মাত্র ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার। হীরক আকৃতির ভূখণ্ডের সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া থেকে জোহরা প্রণালী এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপরাষ্ট্র। আবার এই দ্বীপরাষ্ট্রের ভেতরেও বহু দ্বীপ আছে। সব দ্বীপ মিলিয়ে আধুনিক দ্বীপ রাষ্ট্রটির অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ উন্নত। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এশিয়ায় বেশ অগ্রগ্রামী। সেই সিঙ্গাপুরের আয়তনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় সন্দ্বীপ। সিঙ্গাপুরের বিশ্ব অর্থনীতির পরিচিত দেশ; আর প্রায় সমান আয়তনের সন্দ্বীপকে বাংলাদেশই যেন ভালোভাবে চেনে-জানে না। অথচ দ্বীপটিই বাংলাদেশের অর্থনীতির গেমচেঞ্জার হয়ে উঠতে পারে সুনিপুণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। 

সন্দ্বীপের চরে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে শিল্পপ্রাণ সঞ্চারে ভূমিকা রাখলেন? সে প্রশ্নের উত্তর শুনিয়েছেন সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা। বলেছেন, ‘পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চলের বর্ধিত অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নিজে সন্দ্বীপের নতুন চরাঞ্চল শিল্পজোনের জন্য নির্ধারণ করেছেন এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) শিল্পজোন করার অনুমোদন দিয়েছেন।’ 

অবশ্য, সন্দ্বীপের চরে শিল্পজোন অনুমোদন দেওয়ার আগেই মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। ইতোমধ্যে সেখানে কিছু শিল্পকারখানায় উৎপাদন শুরু করেছে। বেজা আশা করে, প্রায় ৩৪ হাজার একর ভূমিতে গড়ে ওঠা শিল্পনগরের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে বার্ষিক আয় হবে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। এই শিল্পনগর থেকে মাত্র ৬-৭ কিলোমিটার দূরত্বের সন্দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে সন্তোষপুরের ডোমখালী ঘাটে। সেখান থেকে কিছুটা পশ্চিমে জেগে ওঠা নতুন চরের প্রায় ১৪ হাজার একর জমিতে শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে সেখানকার উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে বছরে কী পরিমাণ ডলার আয় সম্ভব? সেই সমীক্ষার সময় বেজার এখনও আসেনি। তারপরও গড়পড়তা হিসেবে মিরসরাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে অনুমান করা যায়, অন্তত ৭-৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে। 

সন্দ্বীপ ঘিরে এই উদ্যোগ যেন একসময়ের ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা বন্দর সন্দ্বীপকে পুরোনো রূপে জৌলুশপর্ণ করে তোলার নব প্রয়াস। সপ্তদশ শতকে তুরস্কের সুলতান সন্দ্বীপে তৈরি করা জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বেশ কিছু জাহাজ কিনে নিয়েছিলেন। এবার জাহাজ নির্মাণ কিংবা উল্টো তীরে সন্দ্বীপ উপকূলে গড়ে ওঠা ভাঙা শিল্পের মতো না হোক, ভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে তুলে ‘আধুনিক তুর্কি সুলতানদের’ আকৃষ্ট করতে পারে সন্দ্বীপ। 

এরই মধ্যে নতুন শিল্পের সম্ভাবনাময় একটি উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। বলেছেন, ‘সন্দ্বীপে সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র গড়ে তোলার বিষয়ে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখানে হিমাগার তৈরি করে মাছ সংরক্ষণ এবং চরভূমিতে শুঁটকি উৎপাদন করা যাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে শুঁটকি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন করার পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে জার্মান কোম্পানির প্রতিনিধিদল সন্দ্বীপ পরিদর্শন করেছে।’ 

প্রধানমন্ত্রী সন্দ্বীপে শুধু শিল্পপ্রাণ ফেরানোর উদ্যোগই নেননি; সঙ্গে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়েও সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ভাসানচরে নৌবাহিনীকে ভূমি বরাদ্দ দিয়েছেন। আবার সন্দ্বীপের তিনটি মৌজা বরাদ্দ দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে, যেখানে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম চলবে। সার্বিকভাবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সন্দ্বীপ এবং মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক জোনসহ আশপাশের এলাকা আরও বেশি নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিয়েছেন। 

যেখানে সঞ্চারিত হবে শিল্পপ্রাণ

২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বীপে প্রথমবারের মতো জ্বলে বৈদ্যুতিক বাতি। সাগরের তলদেশে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি সাবমেরিন কেবল (সাগরের তলদেশ দিয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক তার) পৌঁছে যায় দ্বীপে। জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর আলোকিত হয় দ্বীপ। পরবর্তী সময়ে অনুমোদন পায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিসিক শিল্পনগরী। বিদ্যুৎ সংযোগ ও অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদনের পর স্বপ্নের পরিধি আরও বাড়ে। সেই স্বপ্নই শিল্পজোন। অবশ্য, এর সঙ্গে নতুন চরে বাড়ছে কৃষি ও মৎস্য এবং পর্যটন সম্ভাবনাও। 

অনুমোদিত শিল্পজোনের ভূমি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেল, এ যেন এক বিরান ভূমি। চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ঘাট থেকে স্পিডবোটে উঠে সন্দ্বীপ চ্যানেলে ভাসতে হলো প্রায় ৩০ মিনিট। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ১৮ কিলোমিটার জলপথ পাড়ি দিয়ে দেখা মিলল সন্দ্বীপ উপজেলার গুপ্তছড়া ঘাটের। একসময় কাদাজল মাড়িয়ে তীরে উঠতে হতো। এখন পাকা ঘাট নির্মিত হয়েছে। তাই সহজে ওঠা গেল তীরে। 

সন্দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণ অংশে সারিকাইত ও মগধরা ইউনিয়নে বিস্তৃত চর জেগেছে। এসব চরের কিছু অংশে বনায়ন করেছে উপকূলীয় বন বিভাগ। পশ্চিম অংশে মাইটভাঙ্গা থেকে কালাপানিয়া ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার প্রস্থ এলাকাজুড়ে নতুন চর সৃষ্টি হয়েছে। চরের দৈর্ঘ্য এক থেকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। চরে চাষাবাদও শুরু করেছে কৃষকরা।

ইতিহাস বলছে, হাজার বছরের সমৃদ্ধ সন্দ্বীপ ১৯৫৪ সালের আগে পর্যন্ত ছিল নোয়াখালী জেলার অংশ। ৬০টি মৌজা ভূমি নিয়ে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। এই ৬০ মৌজার মধ্যে ষাটের দশকের পরবর্তী সময়ে সাগর-নদীতে বিলীন হয় ২৭টি মৌজা। সেসব মৌজার ভূমিপুত্ররা হয়েছিলেন কার্যত উদ্বাস্তু। তাদের কেউ একাধিক দফা স্থান পরিবর্তন করেছেন, কেউবা সন্দ্বীপ ছেড়ে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন।

গত তিন দশক ধরে পুনরায মৌজাগুলো জেগে উঠছে। এখন বর্ধিত মৌজাসহ মোট মৌজার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩টি। বাকি সাতটি মৌজা জেগে উঠলেই সন্দ্বীপের মৌজা ফিরতে পারে ১৯৫৪ সালের অবস্থায়। জেগে ওঠা ভূমিতে এখনও পুনরায় জনবসতির গোড়াপত্তন ঘটেনি। বেশিরভাগই পতিত ভূমি। অবশ্য অল্প কিছু জমিতে কৃষক শস্য উৎপাদন করছে। এখন সেসব চর ভূমিতেই শিল্পের গোড়াপত্তনের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। 

স্থানীয়দের দুঃখস্মৃতি ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন

সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাইন উদ্দিন মিশন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে স্মৃতি হাতড়িয়ে বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে শুধু ভাঙনই দেখেছি। একদিকে ভাঙে, অন্যদিকে চর জাগে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি, সন্দ্বীপের চারপাশেই চর জাগছে। এমনটা অতীতে দেখিনি।’ নতুন এসব চর টেকসই হবে তো?Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘বেশিরভাগ চরের ভূমি আবাদযোগ্য হয়েছে। অনেক জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ভূমি আরও বাড়বে। আশা করি, এই ভূমি টেকসই হবে।’ 

চর টেকসইয়ের কথা প্রায় নিশ্চিত করেই বলেছেন চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রকৌশলী মিহির কুমার চক্রবর্তী। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছর ধরে মেঘনা নদীর মোহনায় ভূমি জাগরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রায় ছয় লাখ হেক্টর নতুন ভূমি জেগে উঠেছে। কখনও প্রাকৃতিক, কখনও ক্রসবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এসব ভূমি উদ্ধার হয়েছে। প্রতি বছর মেঘনার উজান থেকে নেমে আসে প্রায় চার বিলিয়ন টন বালু। এসব বালু হাতিয়া-সন্দ্বীপের আশপাশে জমা হয়ে নতুন ভূমি জেগে উঠছে। একটি চর জেগে উঠতে কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ বছর সময় লাগে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার উড়িরচর-কোম্পানীগঞ্জ এলাকায় একটি ক্রসবাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। আশা করা যায়, এই বাঁধ নির্মাণের পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে আরও বিপুল পরিমাণ চর জেগে উঠবে।’ 

সন্দ্বীপের নতুন চর ভূমির জরিপ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেছেন, ‘জাহাইজ্জার চরের আশপাশের কয়েকটি মৌজার জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। জাহাজ্জার চরে তিন মৌজার প্রায় ১৩ হাজার ৯১২ একর ভূমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে বেজা কাজ শুরু করেছে।’ 

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বেজা গভর্নিং বোর্ডের সপ্তম সভায় সন্দ্বীপসহ ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থানের অনুমোদন দেওয়া হয়। সন্দ্বীপের বাথানবাড়ি, চিরিঙ্গা, কাঁকড়ারচর, বোয়ালিয়া, বাগারচর, চর কাউনিয়া মৌজার জমি বেজাকে বন্দোবস্ত দেওয়ার অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর সন্দ্বীপের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিদর্শী সম্বৌধি চাকমা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ মামুন একটি জরিপ প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠান। ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত ছয় মৌজার ১৩ হাজার ৯৫৭ একর জমি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তি প্রদানের সুপারিশ করা হয়। 

অনুমোদনের চার বছর পর অর্থনৈতিক অঞ্চলের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সন্দ্বীপ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ভূমি বন্দোবস্তের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। ভূমির জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। এখনও বেজা ভূমি বুঝে পায়নি। ভূমি পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনী ও বেজার জন্য নির্ধারিত ৯টি মৌজার বাইরে নতুন আরও ১৮টি মৌজায় দিয়ারা জরিপের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। এ প্রসঙ্গে (সদ্য বদলিকৃত) উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, ‘নতুন চরে ১৮টি মৌজায় দিয়ারা জরিপের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দিয়ারা জরিপ সম্পন্ন হলে জেগে ওঠা চরে ভূমির প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।’ 

জরিপের জন্য প্রস্তাবিত ১৮টি মৌজা হলোÑ কালাপানিয়া, হরিষপুর, রহমতপুর, আজিমপুর, মাইটভাঙ্গা, সারিকাইত, চৌকাতলী, রুহিনি, ইজ্জতপুর, দুবলাপাড়, চর বাউয়া, আমিরাবাদ, চর বৈঠা, কাঠগড়, সফিনগর, চর বদু, বাটাজোড়া ও চর রহিম। 

এর বাইরে জাহাইজ্জার চর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৯ মৌজাসহ সব মিলিয়ে ৬০টি মৌজার মধ্যে ৫৩টি মৌজা ফিরে পেয়েছে সন্দ্বীপ। উল্লিখিত ৫৩টি মৌজা ছাড়াও সন্দ্বীপের আশপাশে সাগর অংশে জেগে ওঠা বেশ কিছু চর নিয়ে নোয়াখালী জেলার সঙ্গে সীমানা বিরোধ দেখা দিয়েছে। সন্দ্বীপ নদী সিকস্তি পুনর্বাসন সমিতির সদস্য সচিব মনিরুল হুদা বাবন বললেন, ‘পশ্চিমের ভাসানচর মূলত সন্দ্বীপের ন্যায়মস্তি ইউনিয়ন। জাহাইজ্জার চরও সন্দ্বীপের ইজ্জতপুর ইউনিয়নের অংশ। সন্দ্বীপের ৬০ মৌজার আয়তন ছিল ৬০৩ বর্গমাইল। বর্তমানে ৮২ বর্গমাইল ভূমি আছে। নতুন করে জেগে ওঠা চর সন্দ্বীপের আয়তন বাড়িয়েছে। নতুন আয়তন হতে পারে প্রায় ৫২১ বর্গমাইল। তবে সেটা নিশ্চিত হওয়া যাবে সরকারিভাবে জরিপের পর। কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগ জায়গা নোয়াখালীর নামে রেকর্ড করা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি হাইকোর্টে একটি রিট করেছি। সেই রিটের আলোকে আদালত সন্দ্বীপের ৬০ মৌজা বুঝিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষ সে আদেশের বিপক্ষে আপিল করেছে। সেই আপিল এখনও চলমান।’ 

অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আশার কথা বলেছেন সন্দ্বীপের কৃতী সন্তান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিদ্যমান যোগাযোগ সমস্যার সমাধান না হলে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। অথচ এই উপজেলার প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স জোগান দেয়। যাতায়াতের অসুবিধা দূর করা গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত সন্দ্বীপের প্রবাসীরাই ২০০-৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা কোনো ব্যাপার নয়।’ অর্থাৎ, অর্থনৈতিক অঞ্চলে যদি যোগাযোগব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা যায়, তাহলে সন্দ্বীপের মানুষ বিপুল পরিমাণ লগ্নি করতে পারেন। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের বিনিয়োগ যুক্ত হলে সেখানে অর্থনীতির পরিসর বড় হবে।

 যেভাবে সিঙ্গাপুর হতে পারে

শুধু ফেরির মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থা নয়, সন্দ্বীপকে চট্টগ্রামে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্যে পদ্মা সেতুর মতো একটি সেতু নির্মাণেরও দাবি উঠেছে। স্বপ্নের সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১৪ হাজার একর জমিতে অনুমোদন পাওয়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সত্যিকার অর্থেই কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে, ভাসানচর, জাহাইজ্জার চর ছাড়াও আশপাশের বিপুল ভূমিতে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। দ্বীপে শিল্পের কাঁচামাল পৌঁছানো কিংবা কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সাগরপথেই যেমন চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যাবে তেমনি সড়কপথেও দ্রুত পৌঁছার ব্যবস্থা থাকবে। দ্বীপটির কৃষি, মৎস্য খাতের পাশাপাশি পর্যটন খাত দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে। আমূল বদলে যাবে দ্বীপের অর্থনীতিসহ মানুষের জীবনমান। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, একখণ্ড ভূমিতে যাতায়াতের প্রয়োজনে বিপুল অর্থ ব্যয়ে সেতুর স্বপ্ন কেন? সহজ উত্তর, বাংলাদেশের ভেতরেই একখণ্ড ‘সিঙ্গাপুর’ তৈরির প্রয়োজনে। সন্দ্বীপ অর্থনৈতিক অঞ্চল কার্যকর করা গেলে বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির সুযোগ অবারিত হবে। যে দ্বীপ থেকে বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির স্বপ্ন সরকার দেখে, সেই দ্বীপে যাতায়াতের জন্য হাজার কোটি টাকার সেতু প্রকল্প নয় কেন? 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সত্যটুকু অনুধাবন করেছেন বলেই সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছেন। সহজ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হয়তো তিনি ‘আরেকটি পদ্মা সেতুর’ কথাও ভাববেন। ধারাবাহিকভাবে জেগে ওঠা চরগুলোতে অর্থনীতির চাষ করা গেলে বাংলাদেশ ‘সিঙ্গাপুরের মতো’ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা