প্রবা প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১৬ এএম
আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৫১ পিএম
‘জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী। নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি!’ ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ নামে চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত এই কবিতাটি কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে বসে। ১৯২৯ সালে সন্দ্বীপে বন্ধু ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন কবি। এই কবিতায় লেখা ‘গুবাক’ অর্থ সুপারি। সন্দ্বীপের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন সেখানে সুপারি আর নারকেলগাছের ছড়াছড়ি। যা এই দ্বীপের রূপসুধা বাড়িয়েছে বহু গুণ।
চট্টগ্রামের একমাত্র দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন। ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপ ভ্রমণ করেন। ১৫৬৫ সালে ভ্রমণ করেন ডেনিশ পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক। অতীতে পর্যটকের তীর্থস্থান থাকলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে পর্যটনশিল্প বিকশিত হয়নি।
সম্প্রতি বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন খাত সমৃদ্ধ হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন নদীর পাশে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে গড়ে তুলছেন রিসোর্ট। সেসব রিসোর্টে সারা দেশের ভ্রমণপিপাপু হাজারো পর্যটকের আনাগোনা বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তেমনই একজন উদ্যোক্তা উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের তৌকির আহমেদ ইয়েল। রহমতপুরের সাগরপাড়ে তিনি গড়ে তুলেছেন সন্দ্বীপ বিচ অ্যান্ড গল্প কুটির নামে একটি রিসোর্ট। ব্লক বেড়িবাঁধের বাইরে সারি সারি নারকেল ও সুপারিগাছের মধ্যে ছোট ছোট ১৫-২০টি ঘর নিয়ে এই রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এই অংশ থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায় দারুণভাবে। এর কারণে সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে।
তৌকির আহমেদ ইয়েল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, সপ্তাহে তিন দিন তার রিসোর্টে ভিড় থাকে। এর মধ্যে শুক্রবার কমপক্ষে ১৫ হাজার দর্শনার্থী হয়। বৃহস্পতি ও শনিবার গড়ে ৫ হাজারের মতো মানুষ ওই এলাকা ঘুরতে আসে। তিনি বলেন, ‘শহর থেকেও প্রতিবছর অনেকে আসে। তারা রাতে ক্যাম্প করে। প্রতিবছর ৪০-৫০টা গ্রুপ আসে। আবার দিনে ঘুরে ঘুরে চলে যায় এমন সংখ্যাও কম নয়।’ এই রিসোর্টে কোনো ভাড়া নেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্প করা কিংবা রিসোর্টে অবস্থান করার জন্য আমরা কোনো ভাড়া নিই না। একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখান থেকে কিছু উপার্জন হয়। মূল লক্ষ্যটা সন্দ্বীপের পর্যটন খাতকে বিকশিত করা।’
সস্তোষপুর এলাকায় ৭ একর জায়গাজুড়ে ট্রাভেলি ইকো ভিলেজ নামে আরেকটি রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন ইউনিয়নটির বাসিন্দা সাংবাদিক আনোয়ার আবছার। লেক, পুকুর আর নানা প্রজাতির গাছ দিয়ে রিসোর্টটি সাজিয়েছেন তিনি। তার রিসোর্টে নজর কাড়ে লেকের পাড়ে সারি সারি খেজুর ও তালগাছ। রিসোর্ট থেকে বের হতেই চোখে পড়ে বিস্তৃত ঝাউবন আর চর। এই অংশ থেকে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দুটিই উপভোগ করা যায়। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘নৈঃশব্দে ডুব মারার একটা আনন্দ আছে। মানুষকে সেই আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এই রিসোর্টটি সাজিয়েছি।’ এই রিসোর্টেও থাকা কিংবা ঘোরার জন্য কোনো ভাড়া কিংবা টিকিট লাগে না।
সন্দ্বীপের বিভিন্ন অংশে এমন অনেকগুলো রিসোর্ট গড়ে তুলছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের বিচ গেইম চালু করার উদ্যোগও নিয়েছেন কেউ কেউ। এই লক্ষ্যে সার্ফিং প্রশিক্ষণের আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে এই বিষয়ে সমঝোতাও হয়েছে হিউম্যান ২৪ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের। সংগঠনটির পরিচালক সালেহ নোমান বলেন, দ্বীপের মানুষ হিসেবে লাইফ গার্ড ও সার্ফিংয়ে আমাদের দক্ষতা প্রয়োজন। বিশেষ করে পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধ করার জন্য। তা ছাড়া বিনোদনের জন্যও সমুদ্রসৈকতভিত্তিক খেলাগুলো চালু করতে হবে। তাতে দ্বীপটি একটি আন্তর্জাতিক মানের বিচ গেইম কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এসব ভাবনা থেকেই সার্ফিং প্রশিক্ষণের কথা ভেবেছি। ঈদের পর এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘সন্দ্বীপে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এই খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে সব রকমের সহযোগিতা পাবে।’
পর্যটন খাতে সরকারি উদ্যোগ নেই কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা বলেন, ‘সন্দ্বীপ প্রাকৃতিকভাবেই অনন্যসুন্দর। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর হাজারো পর্যটক সন্দ্বীপে আসে। এখন বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে কিছু করা যায়নি। আমি চেষ্টা করছি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে সন্দ্বীপে এনে পর্যটন উন্নয়নে ভূমিকা রাখার। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হচ্ছে যদি বিদেশি বিনিয়োগ আনা যায়, তাহলে দ্রুতই পর্যটন খাতে এগিয়ে যাবে সন্দ্বীপ।’