সোমালিয়ায় জিম্মি জাহাজ
হাসিব আল আমিন , নোয়াখালী
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫০ এএম
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১৩ পিএম
স্বামী সালেহ জিম্মি হওয়ায় এলোমেলো তাদের স্বাভাবিক জীবন। তিন মেয়েকে নিয়ে বাকরুদ্ধ স্ত্রী তানিয়া আক্তার। প্রবা ফটো
সবার ঈদ থাকে না। যেমনটা সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজের ফাইটার হিসেবে কর্মরত আহমেদ মো. সালেহ (৪৮) ও মোহাম্মদ আনারুল হক রাজুর (২৯) পরিবারের মানুষদের। দুই পরিবারের ঈদ যেন তলিয়ে গেছে ভারত মহাসাগরে। জিম্মি সংকট নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা যত বাড়ছে তত বেশি অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে নোয়াখালীর এই দুই পরিবারের মানুষদের।
‘আমার বাবা আমাকে কল দেয় না। আমাদের সঙ্গে কথা কয় না। কই পামু তারে। কবে আসবে বাবা? বাবার হাত ধরে ঈদগাহে যেতে চাই।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিল সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজের ফাইটার হিসেবে কর্মরত মো. সালেহর কন্যা তাসফি (১৪)। সালেহর মতোই আনারুল হক রাজুর বাড়ির গল্পটাও একই। তাদের দুজনের বাড়ি একই জেলায়। রাজুর মা দৌলত আরা বেগম বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলে ঈদে আমাকে ফোন দিত। কেনাকাটার টাকা দিত। কীভাবে যে দিন কাটাচ্ছি আমরা জানি। আমাদের কোনো ঈদ নেই। রাজু হইল আমার ঈদ।’
জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজের এবি (অ্যাবল সিম্যান) হিসেবে কর্মরত মোহাম্মদ আনারুল হক রাজু (২৯)। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের আজিজুল হক মাস্টার ও দৌলত আরা বেগমের ছেলে রাজু। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয় রাজু অবিবাহিত।
মো. সালেহ আহমদ নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নোয়াখলা ইউনিয়নের সিংবাহুড়া গ্রামের মুন্সি বাড়ির মৃত সাখাওয়াত উল্লাহর ছেলে। চার ভাই এক বোনের মধ্যে মো. সালেহ সবার বড়। তার স্ত্রী ও তিন কন্যাসন্তান রয়েছে।
সালেহ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। গত বছর ঈদ করেছেন কর্মস্থলে। স্ত্রী ও তিন কন্যার আশা ছিল এবার তাদের সঙ্গে ঈদ করবে। কিন্তু স্বামী জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার খবরে এলোমেলো হয়ে যায় তাদের স্বাভাবিক জীবন। তিন মেয়েকে নিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ সালেহর স্ত্রী তানিয়া আক্তার। সন্তানদের নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রহর গুনছেন স্বামীর মুক্তির। নিকট আত্মীয় ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলছেন না।
সালেহ আহমদের স্ত্রী তানিয়া আক্তার বলেন, এখন নিজেরা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছি এই ভেবে যে, এখনও সময় আছে স্বামী ফিরবে। তবে মেয়েদের সান্ত্বনা দিতে পারি না। রোজা রেখে স্বামীর জন্য দোয়া করি। সরকার আমার স্বামীসহ ২৩ নাবিককে দ্রুত ফিরিয়ে আনবেÑ এমন প্রত্যাশা করছি। সালেহের ভাই তানজিমুল হাসান ফাহিম বলেন, আমার ভাইসহ অপহৃত নাবিকদের ভাগ্যে কী ঘটেছে সেই শঙ্কায় ঈদের আনন্দ নেই আমাদের পরিবারে। আমাদের প্রত্যাশা এমন উৎকণ্ঠার সময় পেরিয়ে ফিরে আসুক সবাই। আমাদের বাবা-মা নেই। ভাই আমাদের বড় করেছেন। যত দ্রুত সম্ভব সরকার সবাইকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুক। এটাই আমাদের চাওয়া।
রাজুর পরিবারে নেই ঈদের আমেজ। তাদের পরিবারে হচ্ছে না কোনো ধরনের কেনাকাটা। অন্যান্য বারের ঈদগুলো খুশির থাকলেও এবার ঈদ তাদের কাছে নীরব কান্নার। রাজুর বাবা আজিজুল হক মাস্টার বলেন, রাজু বাড়িতে এসে ঈদ করার কথা ছিল। গত নভেম্বরের শেষ দিকে রাজু সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজে ওঠে। এরপর ছেলের বন্দিদশায় বদলে গেছে সবকিছু। ঈদের আগেই আমার সন্তানসহ সব নাবিকের মুক্তির ব্যবস্থা করুক সরকার। রাজুর মা দৌলত আরা বেগম বলেন, আমরা খুবই কষ্টে দিন অতিবাহিত করছি। প্রধানমন্ত্রী ঈদের আগেই যেন আমার ছেলেসহ জিম্মি সবাইকে ছাড়িয়ে আনেন। ছেলে ছাড়া আমাদের কোনো ঈদ আনন্দ নেই।
ঈদ উপলক্ষে এই দুই পরিবারের পাশে থাকার কথা জানিয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অবর্তমানে পরিবার খুবই দুঃসহ দিনাতিপাত করে। পরিবারটার কাছে ঈদ আনন্দ ফিকে হওয়ার কথা। আমাদের পরিকল্পনা আছে। আমি তাদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে চাই। তবে তাদের জন্য সে আনন্দ কখনোই তাদের জিম্মি সন্তান/বাবার উপস্থিতি পূরণ করবে না। তারপরও ব্যক্তিগতভাবে দুই পরিবারের পাশে থাকতে চাই।