নুপা আলম, কক্সবাজার
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৭ পিএম
মিয়ানমারের কারাগারে থাকা জেলে পরিবারের সদস্যরা। প্রবা ফটো
কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া। নাফ নদসংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকার বাইরেই অবস্থিত গ্রামটিতে অনেকটা নদীর কূলের সঙ্গে জোয়ার-ভাটা মিশে যায়। সেই গ্রামের দুই সন্তানের জননী মুবিনা খাতুন। যার স্বামী আলী আকবর নাফ নদ বা সাগরে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু গত দুই বছর আলী আকবর মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি আছেন। ফলে দুই সন্তানের জীবিকার জন্য এখন ভিক্ষা করতে হয় মুবিনা খাতুনকে।
সম্প্রতি শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ায় জরাজীর্ণ বাড়িতেই বসে কথা হয় মুবিনা খাতুনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমার স্বামী প্রায় দুই বছর এক মাস মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি। তাই এখন দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। বাজারে, স্টেশনে গিয়ে ভিক্ষা করি। ভিক্ষা করার টাকা দিয়ে কোনো রকম অনাহারে-অর্ধাহারে বেঁচে আছি। শুধু অপেক্ষায় আছিÑ কখন স্বামী মিয়ানমারের কারাগার থেকে দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু স্বামী আলী আকবর কখন ফিরতে পারবেন সেটাই তিনি জানেন না।
শুধু এই মুবিনা খাতুন নন, টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ার ১৪ জেলেই এখন মিয়ানমারের কারাগারে। যাদের পরিবার রয়েছে চরম উৎকণ্ঠায়। কারও স্বামী বা কারও সন্তান দুই বছরের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের কারাগারে। তাদের পরিবারের দাবি, মিয়ানমারের কারাগারে তাদের সাজা শেষ হয়েছে। এখন তাদের স্বদেশে ফেরাতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে এসব জেলে পরিবার।
ঘটনার সূত্রপাত ২০২২ সালের ১৫ মার্চ। ওই দিন নাফ নদেতে মাছ শিকারকালে বাংলাদেশি ১৮ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। পরে ১৮ জেলের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক চারজনকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে চার মাস পর বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে মিয়ানমার। কিন্তু বাকি ১৪ জেলে এখনও মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
অপ্রাপ্তবয়স্ক ওই চার জেলের একজন জালিয়াপাড়ার রেজাউল করিম। ২০২২ সালের ১৫ মার্চ রেজাউলের বয়স ছিল ১৬ বছর। কী হয়েছিল সেই দিন? এমন প্রশ্নের উত্তরে রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা চারটি ট্রলারে নাফ নদীতে বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ শিকার করছিলাম। হঠাৎ দেখি নদীতে কতগুলো কাঠ ভেসে যাচ্ছে। তখন মাছ শিকার না করে কাঠগুলো ধরছিলাম। কিন্তু হুট করে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি স্পিডবোট এসে অস্ত্রের মুখে আমিসহ বাংলাদেশি ১৮ জেলেকে ধরে তাদের বিওপিতে নিয়ে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রাখার পর মিয়ানমারের এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। কিন্তু টাকা নেই বলাতে তারা আমাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ১ মাস ৯ দিন পর আদালতে নিলে আদালত কারাগারে পাঠান। এরপর একদিন আমাদের ৪ জনকে আলাদা করে বাকি ১৪ জনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের বুচিদংয়ের একটি জায়গায় নিয়ে যায়। ওখানে প্রায় ১৭-১৮ দিনের মতো রাখছে। তারপর একদিন আবার আদালতে তুললে আমাদের বয়স কম হওয়াতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়। পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে আমাদের চারজনকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে। আর বাকি ১৪ জেলেকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন বিজিপি সদস্যরা।
এ সময় কথা হয় মিয়ানমারের কারাগারে থাকা সহোদর মোহাম্মদ হোসেন ও ইসমাঈলের মা আয়েশা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার দুই সন্তানকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাফ নদী থেকে ধরে নিয়ে গেছে প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে। যেভাবে হোক আমার দুই ছেলে মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনলে খুবই খুশি হব। এই দুই ছেলে ছাড়া আমার আর কেউ নেই।’
রেদুয়ান বেগম নামের অপর এক নারী বলেন, আমার ছেলে, মেয়ের জামাইসহ সবার নাকি কারাভোগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুল আবেদন করছি, যাতে আমাদের সন্তানদের মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনে।
শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল গনি বলেন, ধরে নিয়ে যাওয়া ১৪ জেলেই বাংলাদেশের বাসিন্দা। এসব জেলেকে ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছে জেলে পরিবারগুলো।
বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কূটনৈতিক আলোচনার বিষয়। তবে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রবেশ করে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ১৮০ সীমান্তরক্ষী ও সেনাসদস্যকে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি মিয়ানমারে আটকা পড়া ১৭০ জন বাংলাদেশিকে দেশে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরা সবাই মিয়ানমারের কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করছেন। ওখানে এই ১৪ জেলেও আছে কি না, তা দেখতে হবে।
মিয়ানমারের চলমান সংঘাতের জেরে মিয়ানমার থেকে ১৭৭ জন বিজিপি ও সেনাবাহিনীর ৩ সদস্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের সবাইকে নাইক্ষ্যংছড়ির বিজিবি স্কুল ভবনে রাখা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন বিজিপি সদস্যসহ ৩৩০ জন। যার মধ্যে ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, ৪ জন বিজিপি পরিবারের সদস্য, ২ জন সেনাসদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য ও ৪ জন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। এদের গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।