গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ
শফিক সরকার, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩৩ পিএম
আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১৪ পিএম
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে পাশাপাশি কবর গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে দুর্ঘটনায় নিহত তাওহিদ ও তায়েবার। প্রবা ফটো
দুই ভাই-বোন তাওহিদ ও তায়েবা। তাদের বায়না ছিল ঈদে নতুন জামা কেনার, বায়না ছিল দাদার বাড়িতে ঈদ করার। ইফতারের সময় বাবা-মায়ের পাশে বসেই ইফতার করত তারা। সারাদিন ভাই-বোনের চলত খুনসুটি। গার্মেন্টকর্মী মা বাসায় এলেই একে অপরের নামে বিচার দিত মায়ের কাছে। মা তাদের নানাভাবে শান্তনা দিতেন। গাড়ীচালক বাবার কাছেও বিচার দিত আর নানা বায়না ধরত তারা। কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় তাদের একসঙ্গে চলে যেতে হবে পরপারে; এটা জানা ছিল না বাবা-মায়ের।
এখন আর তাদের সঙ্গে কেউ ইফতার করে না,
ঈদের নতুন জামার বায়নাও ধরে না। বাসায় ফিরলে তাদের কাছে আর কেউ নালিশ করতেও আসে না।
ফোনে এসব কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদেন তাওহিদ-তায়েবার বাবা সজল মিয়া। পাশে মা সুমাইয়া
বেগম বসে থাকলেও কথা বলতে চাননি তিনি।
ঘটনার পর থেকে ছেলেমেয়ে হারিয়ে নির্বাক
বাবা-মা। কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না তারা। সারাদিন বাসার দরজা বন্ধ করে কাঁদেন। তাদের
শান্তনা দেবে কে? আর প্রতিবেশিরা কিসের শান্তনাইবা দেবে তাদের।
গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে অগ্নিকাণ্ডে
নিহত তাওহিদ-তায়েবার বাড়ি ময়মনসিংহর ফুলবাড়িয়ার বরইহাটা গ্রামে। পারিবারিক কবরস্থানে
তাদের পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়িয়া
উপজেলার দেওখোলা ই্উনিয়নের বরইহাটা গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেমের ছেলে সজল
মিয়া। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন। পেশা হিসেবে
বেছে নেন গাড়ী চালানো। গাড়ী চালানোর সুবাধে টাঙ্গাইলের মধুপুরের মেয়ে গার্মেন্টকর্মী
সুমাইয়া বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৬ সালে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পর বাবার সংসার ছেড়ে
আলাদা বসবাস শুরু করেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।
বিয়ের এক বছর পর তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে তাওহিদ। ছেলের দুই বছর পরেই তাদের
কন্যা সন্তান তায়েবার জন্ম।
ছেলেকে ভর্তি করেন কালিয়াকৈরের তেলিরচালা
এলাকার একটি মাদ্রাসায়। আর মেয়ে তায়েবাকে আগামী বছর মাদ্রাসায় ভর্তি করানোর কথা ছিল।
দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের অনেকটা সুখেই জীবন কাটছিল। একটি গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজের দুর্ঘটনায়
তাদের সব পাল্টে গেছে। আদরের দুই সন্তানকে হারিয়ে তারা এখন পাগলপ্রায়। নিমিষেই তাদের
সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। সন্তানদের হারিয়ে মা সুমাইয়া বেগম এখন আর কাজে যান না,
বাবা সজল মিয়াও কাজে যান না। শোকে তারা পাথর হয়ে গেছেন। সন্তান হারানোর কয়েক দিনেও
তারা স্বাভাবিক হতে পারেননি। এখনো কালিয়াকৈরের তেলিরচালায় ভাড়া বাসায় আছেন তারা। ঈদে
বাড়ি আসবেন কি-না, এখনো নিশ্চিত না।
গত ১৩ মার্চ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার
তেলিরচালা এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনের
প্রাণ যায়। তাদের মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বরইহাাট গ্রামের সাত বছরের তাওহিদ ও
তার পাঁচ বছরের ছোট বোন তায়েবা রয়েছে। এ ঘটনায় নিহত হয়েছে একই উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের
শফিকুল ইসলামের ৯ বছরের ছেলে সোলায়মানও। তারা বাসা থেকে বের হয়েছিল সিলিন্ডারের লিকেজ
গ্যাস দেখার জন্য। কিন্ত তাদের শরীরে জড়িয়ে যায় গ্যাস। পাশের একটি হোটেলে মাটির চুলা
থেকে তাদের শরীরের আগুন ধরে যায়। তাদের ঢাকার শেখ হাসিনার বার্ন হাসাপাতালে ভর্তির
পর অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও মৃত্যু হয়। ছোট শিশু তায়েবা মারা যায় গত ১৬ মার্চে আর
একদিন পর ১৮ মার্চ মারা যায় তার বড় ভাই তাওহিদ। একই দিন মারা যায় একই উপজেলার সোলাইমানও।
তাওহিদ ও তায়েবার গ্রামের বাড়ি গিয়ে
দেখা যায়, পারীবারিক কবরস্থানে শিশু তাওহিদ ও তায়েবার পাশাপাশি কবর। কবরের পাশেই পাওয়া
যায় সজলের দাদা ক্বারী হাছেন আলীকে। এছাড়া বাড়িতে আর কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি তাওহিদ
ও তায়েবার কবর দেখান। এ সময় তার দুই চোখ ভরা পানি।
হাছেন আলী বলেন, তার নাতি সজল মিয়া
অনেক কষ্টে বড় হয়েছেন। তাদের কোনো সহায়-সম্পত্তি নেই। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে গাজীপুরের
বিভিন্ন এলাকায় থেকে বড় হয়েছেন সজল। দুটি সন্তান নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু
একটি দুর্ঘটনা তাদের পুরো পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে।
প্রতিবেশী কবির হোসেন বলেন, একদিনের
ব্যবধানে দুটি শিশুর কবর দেওয়া তাদের জন্য ভারি হয়ে গিয়েছিল। তাদের শোকে এলাকা যেন
পাথর হয়ে গিয়েছিল। তারা এমন মৃত্যু চাননি।
ফোনে তাওহিদ-তায়েবার বাবা সজল মিয়া
বলেন, ‘ভাই আমার সব
শেষ হয়ে গেছে। আমার আর এই দুনিয়ায় বেঁচে থেকে লাভ কী? যাদের জন্য দিন-রাত কষ্ট করেছি,
তারাই যদি না থাকে।’ এখন সন্তানদের কবরের পাশে শায়িত হতে
চান তারা।
তিনি বলেন, ভিটে-বাড়ি ছাড়া তার আর কোনো
সহায়-সম্পত্তি নেই। সন্তানদের দাফন-কাফনের জন্য কালিয়াকৈর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে
তাদের ৪০ হাজার টাকা দিয়েছে। এছাড়া তাদের আর কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হয়নি। দুটি সন্তানের
চিকিৎসার সব খরচ তারা জোগান দিয়েছেন। তবে তিনি আর কিছু চান না, তিনি চান আর যেন কোনো
বাবা-মায়ের কোল এভাবে খালি না হয়।
এদিকে নিহত সোলাইমানের বাড়িতে গিয়ে
কাউকে পাওয়া যায়নি। তার পরিবারও কালিয়াকৈরের তেলিরচালায় একটি ভাড়া বাসায় থাকে। এই পরিবারটিও
শোকে কাতর হয়ে আছে। ছোট সোলেমানকে হারিয়ে তার বাবা-মা এখন পাগলপ্রায়।
এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী জালাল বলেন, বিষয়টি অনেক দুঃখজনক। এই পরিবারগুলো সহযোগিতার
আবেদন করলে তিনি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবেন।