ভাস্কর রামকিঙ্কর
বেইজের ভাস্কর্যের সূচনা পাশ্চাত্যশিল্পীদের কাছে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দ্বন্দ্ব সেই
সঙ্গে উভয় ধারা থেকে রসদ সংগ্রহ করে নিজেকে পরিশীলিত করেছেন। তার চিত্রকলায় যেমন নিসর্গচিত্রে
দেশীয় পটভূমিতে দেখা যায় ভিনসেন্ট ভ্যান গগ কিংবা পল সেজানের প্রতিচ্ছায়া এবং কিউবিস্টদের
পথ ধরে তিনি বিমূর্তাশ্রায়ী। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছিল কলকাতাতেও। এ প্রসঙ্গে রিবেল
আর্ট সেন্টারের কথা বলা যায়, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দেশজ শিল্পের প্রকৃত চরিত্র ও
সত্তাকে রক্ষার জন্য পাশ্চাত্যের শিল্পরীতির আঙ্গিক আয়ত্ত করা এবং রিয়ালিস্টিক বা বাস্তববাদের
দিকে ধাবিত করা। ঘরের চালের ফুটো দিয়ে কোজাগরি চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে মুখের ওপর, অদ্ভুত
এক আলো-আঁধারীর খেলা ঘরজুড়ে। আহল্লাদে আটখানা রামকিঙ্কর, বাদ সাধল বর্ষার জল, থালা-বাটি
উপচেপড়া জলে আনন্দ মিলেমিশে একাকার; কিন্তু বাসের অযোগ্য হলে, তা রোধ করা ছাড়া উপায়
নেই। তেলচিত্র আঁকবার ক্যানভাসে ঢাকলেন ঘরের চাল। অসম্ভব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন
কিঙ্কর। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে নারী ও নেশা, নেশা বলতে মদ, সে দেশিই হোক বা বিলেতি। তার
কাছে মদের কোনো জাতপাত ছিল না, যেমন নারী শরীরে কোনো জাতপাত নেই। সংগীতের মূর্ছনা সবার
কানে না পৌঁছালেও মদ ও নারীর গল্প পৌঁছে যেত, শান্তিনিকেতন ছেড়ে বোলপুরের বিভিন্ন মজলিসে।
রাম কিঙ্করের
একটি ভাস্কর্য নিয়ে শান্তিনিকেতনে তোলপাড়। গুরুদেব ডেকে পাঠালেন, বাধ্য বালকের মতো
কিঙ্কর এলেন। কোনার্ক বাড়ির বারান্দায় বসে গুরুদেব কি যেন লিখছিলেন, লাল মেঝেতে তখন
গোধূলি বিকালের রক্তিম আভা জাফরীর সঙ্গে লুকোচুড়ি খেলায় মত্ত। না তাকিয়েই রবীন্দ্রনাথ
বল্লেন,
: কার মূর্তি
গড়েছ কিঙ্কর?
: আমি নিজেও
জানি না ওটা কার মূর্তি, স্বপ্নের ঘোরের ভিতর ও যে এসে ধরা দিল, কোনো এক অধরা।
: ওই মূর্তির
মধ্যে কি কোনো প্রাণ আছে?
: আছে অথচ
যেন নেই।
: আমি তো মাথা
অবনতা এক অপূর্ব নারীমূর্তি দেখলুম।
অস্পষ্ট স্বরে
কিঙ্কর বল্লেন, ‘হয়তো কাউকে চুমু খেতে মুখ নামিয়েছে।’ গুরুদেবের
সামনে চুমু শব্দটা বলে ফেলে অস্বস্তির সীমা নেই কিঙ্করের, যেন বাবার সামনে স্কুলপড়ুয়া
পুত্র।
রামকিঙ্কর মডেল খুঁজছেন, তার নিজের জন্য, ছবির কৌশলের জন্য, প্রয়োজন একজন মডেলের। যাকে স্পর্শ করে, আঘাত করে, হৃদয়ে প্রবেশ করে, তার হৃদয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে ভালো বাসায় ডুবিয়ে, জীবনের দিক থেকে আশ্রয়হীন করে তাকে চিনে নেবেন তিনি। শান্তিনিকেতনে মীরা দেবীর (ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়, ১৯২৩-১৯৯৮) কাজে সাহায্য করেন এক সাঁওতাল রমণী। দেখা হলো সাধারণত্বে অসাধারণ রাধারানীর সঙ্গে, রাধারানী তাঁর সাধনার, পরীক্ষার একটি উপকরণ হতে পারে। শিল্পী এদগার দেগাকে ফরাসি দার্শনিক ও কবি পল ভ্যালোরি প্রশ্ন করেছিলেন- ড্রইংয়ের দ্বারা তিনি কী বোঝেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ড্রইং ইজ নট এ ফর্ম, ইট ইজ ওয়ে অ্যা লুকিং এ্যাট ফর্ম, লুকিং এ্যাট ফর্মের ভিতর ধরতে হবে যন্ত্রণা এবং তার বিস্তৃত বোধ, তার সীমানা। সেই সীমানার ভেতর নিজেকে অত্যাচারিত করার প্রবণতায় রামকিঙ্কর মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। রামকিঙ্করের সঙ্গে রাধারানীর পরিচয় সামান্য সময়ের, সেই সামান্য সময়ের পরিচয়ের মধ্যেই আহ্বান করেছিলেন তাঁর কাছে আসতে এবং তিনি জানতেন রাতে রাধা আসবে তাঁর কাছে। মীরা দেবীর বাড়ি আর রামকিঙ্করের স্টুডিওর মাঝে কাঁটাতারের বেড়া। সন্ধ্যার পর থেকে এপারে তিনি মাঠে বসে একতারায় শব্দ তুলছেন কিন্তু মনোযোগী নন। সন্ধ্যা পেরিয়ে অস্থির রাত, সময় সমুদ্র তালগোল। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে অন্ধকারে এক রমণীর লজ্জিত পদক্ষেপ। অস্থির রামকিঙ্কর শিল্পের নতুন আকৃতি এবং নিজেকে প্রকাশ করবার ব্যগ্রতায় সবকিছু ভুলে গিয়ে রাধারানীকে দুই হাতে তুলে নিয়ে এলেন কাঁটাতারের বেড়ার এপারে। তাকে স্টুডিওর মডেল বক্সের ওপর আধশোয়া করে এমনভাবে রাখলেন, রাধা যেন কলের পুতুল। রাধা স্বপ্নের ঘোরের ভেতরে আছেন, শব্দহাবা লজ্জায় রক্তহীন অথচ অভিজ্ঞতায় এবং নিজস্ব যন্ত্রণার কাছে প্রৌঢ়া।
রামকিঙ্করের
কাছে স্টুডিওর পরিবেশে এক স্বর্গীয় অনুভূতি, পেন্সিলের টানে ধরে রাখতে হবে রাধার শরীরের
ফর্ম এবং সেই ফর্মের ভেতর ঝলসে উঠবে তীব্র যন্ত্রণা। কোহল ক্লান্ত রামকিঙ্কর শল্য চিকিৎসকের
মতো শুরু করলেন রাধার শরীর ব্যবচ্ছেদ, এক অলৌকিক ময়নাতদন্ত। যা দিয়ে বোঝা যায় এক মানবিক
মনের গভীরতা। শরীরের ভিতর আরেক শরীর। গর্ভের ভেতর বেড়ে ওঠা এক শরীরে আরেক শরীরের মতো
অবিকল রূপে। যে রূপ একটা বিশেষ ফর্ম শিল্পী এডগার দেগার কাছে। তাঁর স্নানরতা ছবির বিষয়ের
মতো, স্নানের পর এক তরুণী পিছন ফিরে তার চুল থেকে জল মুছে নিচ্ছে খুব স্বাভাবিকভাবে।
কিন্তু শিল্পীর ক্যানভাসে মোটা রেখার টানে তা ফুটে উঠছিল অপূর্ব দেহভঙ্গিমায়। যে দেহভঙ্গিমা
এখনও মুগ্ধ করে গ্যারারির দর্শককে।
রামকিঙ্করের
সঙ্গে দীর্ঘ বসবাসের এক সময় সন্তানসম্ভাবা হলো রাধা। এ সময় রামকিঙ্কর একটি ম্যাডোনা
চিত্র আঁকলেন, ম্যাডোনার কোল থেকে নেমে আসছে চারটি শিশু। ম্যাডোনার একটি চোখের আভাস
দৃশ্যমান, অন্যদিকের চোখ ডুবে আছে ঘন চুলের নিচে। ম্যাডোনার দুটো স্তন উন্মুক্ত, চারটি
শিশুর মুখ সেখানে। বসুন্ধরার প্রতীকী রূপ, সকল শিশুর জন্য মায়াবতী দুধঘর নিয়ে প্রস্তুত।
রামকিঙ্করের কল্পনা ও রাধারানীকে প্রত্যক্ষ করা এক ম্যাডোনাচিত্র। দীর্ঘদিন সন্তানসম্ভাবার
কোনো ইঙ্গিত না পেয়ে রাধারানী এক ব্রাহ্মণপুত্রকে দত্তক নিয়েছিলেন। দত্তক নেওয়ার পর
জানতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। ধর্মীয় মতে, দত্তক নেওয়ার পর নিজের সন্তান জন্ম দেওয়া
অনাচার, তাও আবার ব্রাহ্মণপুত্র। একদিকে অনাচার, লজ্জা, ভয়- অন্যদিকে নারীত্বের গর্ব,
মা হওয়ার প্রবল ইচ্ছা। একদিকে যন্ত্রণা, অন্যদিকে গর্ভের শিশুকে বাড়িয়ে তোলার আতুর
মমতা। রাধারানীর সংকটকালে শিল্পী রামকিঙ্করের কাছে ছবির বিষয়ের আর এক নতুন দিগন্ত খুলে
গেল। নারীত্বের গর্ব এবং তার যন্ত্রণা। আঁকতে শুরু করলেন গর্ভযন্ত্রণার নারীচিত্র,
তাঁর যন্ত্রণার মধ্যে বসে আছে সেই নারী, ভারী স্তনযুগল ঝুলছে। স্মৃতিতে সন্তানের মুখের
কাছে কিন্তু শিশুর অবয়বে চোখ মুখ নাক অদৃশ্য। আবার রাধাকে দাঁড় করিয়ে আঁকলেন তার তলপেটে
সারা শরীরে আঁচড়। রাধারানী সেই সন্তানকে নষ্ট করে ফেলেছিলেন পালিত পুত্রের জন্য। কারণ
ধর্মীয় মতের বিরুদ্ধস্রোতে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। রামকিঙ্কর এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
তিনি রাধার কষ্টের অনুভবকে প্লাস্টার দিয়ে তৈরি করলেন অসাধারণ এক ভাস্কর্য ‘মাতৃত্ব’। যার তলপেট
স্থূলকায়, দুই হাত তার ওপরে, সেই হাতের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শিশু, শিশুর মুখ দুই স্তনের
আড়ালে। যেন দুই স্তনের মাঝে শিশুটি ঘুমিয়ে আছে। নারীচরিত্রের মুখে হাসি এবং সারা শরীরে
এক যন্ত্রণাহীন প্রশান্তি। রাধারানীর বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে। বর ছিল তার চেয়ে তিনগুণ
বয়সের। বিয়ের পর কিছুদিন থাকার পর রাধা গিয়েছিল স্বামীর ঘর করতে, স্বামীর ভালো বাসায়
সিক্ত হতে। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল সে, স্বামী তার প্রেমে অবিচল নন। তার একটি
রক্ষিতা আছে। সে সময় মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বাড়ি এলো রাধা। বাবা সব শুনে বল্লেন- ওখানে
গিয়ে কাজ নেই, আমি তোর জন্য অন্য ব্যবস্থা করে দেব। বাবার কথায় সায় দিলেও কিছুদিনের
মধ্যে রাধা শরীরের ভিতর এক পুরুষের টান অনুভব করেছিল, যা ছিল চিরন্তন। তার স্বামী নিয়মিত
যাতায়াত শুরু করেন রাধার বাবার বাড়িতে। ভালোবাসার গল্প শোনেন রাধা। শরীর এবং মনের জন্য
বাবার কথা অমান্য করে রাধারানী স্বামীর হাত ধরে আবার নিজের বাড়ি গিয়েছিলেন। যুবতী রাধা,
স্বামী তাকে ব্যবহার করেন। না পাওয়ার চেয়ে এ অনেক ভালো। স্বামীর অকালমৃত্যুর পর রাধার
ঠাঁই হলো শান্তিনিকেতনে মীরা দেবীর বাড়িতে, এই হলো রাধারানী, রামকিঙ্করের অধরা।
রানাঘাটের
লিটল ম্যাগাজিন ‘পুনরুত্থান’-এর দুই সম্পাদক
আমার বন্ধুজন শান্তিনাথ আর গৌতম চট্টোপাধ্যায় রাধারানীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন (১৯৮৯)
শান্তিনিকেতনে। আমি তখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা অনুষদের স্নাতকোত্তর
শেষপর্বের ছাত্র। শান্তি আর গৌতম বলেছিল- চলো যাই, তিনজনে মিলে এক সাথে। আমার যাওয়া
হয়নি রাধারানীকে সম্মান জানানোর জন্য। সেই সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল ‘পুনরুত্থান’-এ।
গৌতম ও শান্তি
: এখন আপনার মনে হয় না সন্তান থাকলে ভালো হতো।
লজ্জামিশ্রিত
কষ্টের ভেতর রাধারানীর উত্তর : ভালো হতো, তাকে নিয়ে থাকতাম, এখন ভাবি কেন নষ্ট করলাম,
একজন মহান পুরুষের উত্তরাধিকার।
গৌতম ও শান্তি
: রামকিঙ্করের কথা মনে হয় না।
রাধারানী
: ওর মূর্তির সামনে দাঁড়ালে কান্না পায়। এমন মানুষ হয় না, এমন ভালো কেউ বাসতে পারবে
না।
গৌতম ও শান্তি
: আপনার প্রথম স্বামী ভালো বাসত না।
রাধারানী
: কারও সঙ্গে কারও তুলনা করতে চাই না। কেউ তো কারও মতো নয়।
গৌতম ও শান্তি
: আর কিছু বলবেন তার সম্পর্কে।
রাধারানী
: বাবু, মৃত্যুর সময় বলেছিলেন- রাধা, শ্মশানে অমৃত (মদ) দিস। রাধারানী তার কথা রেখেছিলেন,
শ্মশানে অমৃত ঢেলে দিয়েছিলেন, যেখানে রামকিঙ্করের দেহাবশের শেষ চিহ্ন ছিল।
কিছু সময় নিমগ্ন
থাকার পর আবার কথা বলেন রাধারানী : প্রথম দিকে মনে সন্দেহ হতো, বাবু কেন শ্মশানে অমৃত
ঢেলে দিতে বলেছিলেন।
গৌতম ও শান্তি
: এখন সন্দেহ নেই।
রাধারানী
: না।
গৌতম ও শান্তি
: কেন?
রাধারানী
: তা তো ভেবে দেখিনি।
রাধারানীর
কাছে এর ব্যাখ্যা না থাকলেও গৌতম ও শান্তিনাথের মতো আমাদের সবার জানা হয়ে গেছে সে অমৃত
কথা।
শিল্পানুরাগী
মানুষ তার শিল্পের ভেতর দিয়ে পান করেন সেই অমৃত সুধা।
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.