সাজানো দরবারের
দিকে তাকায় লুৎফুন্নেসা। তার দৃষ্টি স্থিত হয় দরবার অভিমুখে হেঁটে আসা বাংলা-বিহার-ওড়িশার
নবাবের ওপর। সিরাজউদ্দৌলাকে কলেজ ইউনিফর্ম সাদা শার্ট আর কালো প্যান্টে মোটেও বেমানান
লাগছে না। ওর হাঁটায় নবাবের ষোলো আনা আভিজাত্য ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া দরবারের পরিবেশও
মোটামুটি অনুকূলে। নাটকীয় এ দরবার পরিচালনার ভার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন লুৎফুন্নেসা।
ইতিহাসের পথ ধরে সময় পেছনে হাঁটে।
সাল ১৭৫৬,
১০ মার্চ
স্থান নবাবের
দরবার। দরবারের মেজাজ নবাবের আগমন অপেক্ষায় যতটুকু পরিশীলিত ও মার্জিত থাকা প্রয়োজন
মাঝেমাঝে তার ব্যত্যয় ঘটছে। অপেক্ষমাণ সেনাপতি মীর জাফর আলী খান, রাজবল্লভ, ইংরেজ ওয়াটস
হাত নাড়িয়ে কথা বলছে। লুৎফার মধ্যে তা বিরক্তির উদ্রেক করে। ওদের দৃষ্টি লুৎফুন্নেসার
দিকে পড়তেই কথা থামিয়ে সবাই নবাবের আগমনের অপেক্ষায় থাকার নিবিষ্ট ভঙ্গি নেয়।
সাজানো দরবারে
উপস্থিত মীর জাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ইংরেজ ওয়াটস, মোহনলাল, জনৈক উৎপীড়িত
ব্যক্তি। দরবারে আদর্শ নীরবতা বিরাজমান। ঘরের বাতাসে টোকা মেরে নকিবের কণ্ঠ গুরুগম্ভীর
ভঙ্গিতে ঘোষণা করেÑ নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজউদ্দৌলা শাহ কুলি খাঁ মির্জা মুহম্মদ হায়বতজঙ্গ
বাহাদুর। বা-আদাব আগা বাশেদ। (সবাই আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ায়।) নবাব দৃঢ় পদক্ষেপে দরবারে
ঢুকলেন। সবাই নতশিরে শ্রদ্ধা জানাল। কিছু গলা চাপা হাসিতে সরব হওয়ার চেষ্টা করলে লুৎফা
ঠোঁটে আঙুল চেপে স্ স্ স্ করেন। দরবারজুড়ে এখন মুর্শিদকুলি খাঁর দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার
অভিজাত উপস্থিতি। সিরাজ : (সিংহাসনে আসীন হয়ে) আজকের এ দরবারে আপনাদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ
করা হয়েছ কয়েকটি জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্য। রাজবল্লভ মাথা নত করে কুর্নিশ জানালেও
তার কণ্ঠ তির্যক ও অমার্জিত শোনায়Ñ বেআদবি মাফ করবেন জাহাঁপনা, দরবারে এ পর্যন্ত তেমন
কোনো জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি। তাই আমরা তেমন...। তার কথা শেষ হওয়ার আগে সিরাজউদ্দৌলার
গমগমে গলা দরবারের গাম্ভীর্য আরও বাড়িয়ে তোলে : গুরুতর কোনো বিষয়ের মীমাংসা হয়নি এজন্য
যে, গুরুতর কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এমন আশঙ্কা আমার ছিল না। আমার বিশ্বাস ছিল
যে, সিপাহসালা মীর জাফর, রাজা রায়বল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে
সজাগ থাকবেন। আমার পথ বিঘ্নসংকুল হয়ে উঠবে না। অন্তত নবাব আলি বর্দির অনুরাগভাজনদের
কাছ থেকে আমি তা আশা করেছিলাম।
মীর জাফর
: নবাব কি আমাদের আচরণে সন্দেহ প্রকাশ করছেন? মার্চের ঝকঝকে রোদে বাইরে বেশ গরম থাকলেও
দরবারে কোনো পাঙ্খাওয়ালা বা চামরদোলানো নকরকে দেখা যায় না। (বরং উষ্ণতাহরণের কাজটা
জেনারেল কোম্পানির দুটি ছয় টনি এসি সম্পন্ন করছে)। দরবারসংলগ্ন বাইরের জানালাঘেঁষা
আম গাছে একটা কাক কা কা করে উঠলে তার স্বর কাচের জানালায় ঘষা খায়, ফলে ক্ষীণ বায়সকণ্ঠ
ভেতরের এসির বাতাসে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। অমনোযোগী রাজবল্লভ সেদিকে তাকিয়ে
হাসির চেষ্টা করলে তাকে ধমক খেতে হয়। ফলে অপরাধী ভঙ্গিতে দরবারের অভিজাত মেজাজ মেরামতে
সে পুরোপুরি সচেষ্ট হয়। শুরু হওয়া দৃশ্যে আবার নবাবের সংলাপ।
সিরাজ : (ওয়াটসকে)
ওয়াটস।
ওয়াটস : ইওর
এক্সিলেন্সি।
সিরাজ : আলীনগরের
সন্ধির শর্তানুসারে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে দরবারে তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। সেই
সম্মানের অপব্যবহার করে এখানে বসে তুমি গুপ্তচরের কাজ করছো। তোমাকে সাজা না দিয়ে ছেড়ে
দিচ্ছি। বেরিয়ে যাও দরবার থেকে। ক্লাইভকে গিয়ে সংবাদ দাও আমি উপযুক্ত শিক্ষা দেব। আমার
অবর্তমানে নন্দকুমারকে ঘুষ খাইয়ে চন্দননগর ধ্বংস করেছে। এ ঔদ্ধত্যের শাস্তি যথাযোগ্যভাবেই
দেওয়া হবে।
ওয়াটস : ইওর
এক্সিলেন্সি। কুর্নিশ করে বেরিয়ে যাবে।
এর মধ্যে ভাগীরথীর
বুকে বিস্তর জল গড়িয়ে যায়! বহমান নদীর মতো জীবনের গল্পও গতীশীল।
যুবক সিরাজের
নমনীয়তা, অসীম সহনশীলতা, বিশ্বাসঘাতককে বারবার ক্ষমা প্রদর্শনের ভুল উদারতা, খালা ঘষেটি
বেগমের রাজমাতা হওয়ার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা, সেনাপতি মীর জাফরের চরম বেইমানি বাংলা-বিহার-ওড়িশার
স্বাধীন সূর্য অস্তমিত করে। ইংরেজদের সূক্ষ্ম কূটনৈতিক চালের দাবা খেলায় পরাস্ত নবাব
অবশেষে একা, নিঃস্ব। পলাশীর যুদ্ধে একে একে নিহত হয়েছে নবাবের আস্থাভাজন নৌবেসিং, বদ্রিআলি,
মীর মর্দান। বন্দি করা হয়েছে মোহনলালকে। অথচ ইংরেজদের তুলনায় নবাবের সৈন্য ও অস্ত্র
অনেক বেশি। নবাবের সৈন্য ৫০ হাজার আর ইংরেজ সৈন্য মাত্র ৩ হাজার। শত্রুশক্তির কামান
সংখ্যা ছোটবড় মিলিয়ে ১০টি আর নবাবের সেখানে ৫০টি কামান। লুৎফুন্নেসা ভারাক্রান্ত মনে
তৃতীয় দৃশ্য অবলোকন করেন। যেখানে সিরাজের উদ্দেশ্যে ফরাসি সৈনিক সাঁফ্রেকে হতাশ গলায়
বলতে শোনা যায় : আমি তো ফ্রান্সের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ছি জাহাঁপনা। দরকার পড়লে যুদ্ধক্ষেত্রে
আমি প্রাণ দেব। কিন্তু আপনার বিরাট সেনাবাহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যান্ডিং লাইক
পিলার্স...।
পলাশীর যুদ্ধে
প্রধান সেনাপতি মীর জাফর সৈন্যদের যুদ্ধ করতে দেয়নি। সৈনিকরা রণক্ষেত্রে পুতুলের মতো
দাঁড়িয়ে রইল; সঙ্গে প্রকৃতিও করল বৈরী আচরণ। প্রবল বর্ষণে নবাবের গোলাবারুদ সব ভিজে
গেল।
আজকে শেষ দৃশ্যপটে
সুনসান দরবার।
চতুর্থ দৃশ্য
সময় : ১৭৫৭
সাল, ২৫ জুন। স্থান : মুর্শিদাবাদ নবাব দরবার।
... (সিরাজ
হাত তুলে পলায়নপর জনতাকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। জনতা তাতে কান না দিয়ে
পালাতেই লাগল)
সিরাজ : আমার
পাশে এসে দাঁড়ান। আমরা শত্রুকে অবশ্যই রুখব।
(সবাই বেরিয়ে
গেল। অবসন্ন সিরাজ আসনে বসে পড়লেন। দুই হাতে মুখ ঢাকলেন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার
ঘনিয়ে এলো। লুৎফার প্রবেশ। মাথায় হাত রেখে ডাকলেন)
লুৎফা : নবাব।
সিরাজ : (চমকে
উঠে) লুৎফা! তুমিএই প্রকাশ্য দরবারে কেন, লুৎফা?
লুৎফা : অন্ধকারের
ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই নবাব।
সিরাজ : (রুদ্ধ
কণ্ঠে) কেউ নেই! কেউ আমার সঙ্গে দাঁড়াল না লুৎফা। দরবার ফাঁকা হয়ে গেল।
লুৎফা : (কাঁধে
হাত রেখে) তবু ভেঙে পড়লে চলবে না জাহাঁপনা। এখান থেকে যখন হলো না তখন যেখানে আপনার
বন্ধুরা আছেন, সেখান থেকেই বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার আয়োজন করতে হবে।...
সিরাজ : হ্যাঁ,
তাই যাই।
লুৎফা : আমি
তার আয়োজন করে ফেলেছি।
সিরাজ : কী
আর আয়োজন লুৎফা। দু-তিন জন বিশ্বাসী খাদেম সঙ্গে থাকলেই যথেষ্ট। তোমরা প্রাসাদেই থাকো।আবার
যদি ফিরি দেখা হবে।
লুৎফা : না,
আমি যাব আপনার সঙ্গে।
সিরাজ :
... পালিয়ে আমাকে পথ চলতে হবে। সে কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে না লুৎফা।
লুৎফা : পারব।
আমাকে পারতেই হবে।... মৃত্যু যখন আমার স্বামীকে কুকুরের মতো তাড়া করে ফিরছে তখন আমার
কিসের কষ্ট? আমি যাব, আমি সঙ্গে যাব।
সিরাজউদ্দৌলা
নাটকের শেষ দৃশ্যে পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। মাত্র কিছুক্ষণ আগে বাংলা-বিহার-ওড়িশার
শেষ স্বাধীন নবাবকে মাত্র ১০ হাজার টাকার লোভে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে মোহাম্মদী বেগ।
সিরাজের মা-বাবা পুত্রস্নেহে প্রতিপালন করেছিলেন যে মোহাম্মদী বেগকে, সে বেইমান মোহাম্মদী
বেগের সিরাজের শোনিতে হাত রাঙাতে একটুও কাঁপল না...।
একাদশ শ্রেণিতে
সিকানদার আবু জাফর রচিত সিরাজউদ্দৌলা নাটকের পাঠ ও অভিনয় সমাপ্ত হলে ছাত্রছাত্রীদের
কাছে নাটকটির পর্যালোচনা করতে শিক্ষক লুৎফুন্নেসা ডায়াসে দাঁড়ান।
কলেজ ছুটির
পর বাইরে বেরিয়ে বাহনের জন্য অপেক্ষা করে লুৎফা। এ সময় টুংটাং ঘণ্টার সঙ্গে রাজহংসের
মতো সাদা দুটি ঘোড়ার ছান্দসিক ছুটে আসা চোখে পড়ে তার। এখনও পুরান ঢাকায় কিছু ঘোড়ার
গাড়ির প্রচলন রয়েছে। লুৎফার গন্তব্য সেদিকেই, কেরানীগঞ্জের কাছাকাছি জিনজিরার উপকণ্ঠে।
হাত ইশারায় ঘোড়ার গাড়ি থামতে বললে সারথি ঘোড়া থামিয়ে সওয়ারি তুলে নেয়।
লুৎফুন্নেসা
গাড়িতে বসে সিরাজউদ্দৌলার কথাই ভাবে। মাত্র পঁচিশ বছরের এক যুবকের পক্ষে বাংলা-বিহার-ওড়িশার
মতো বৃহৎ ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, প্রজাসাধারণের সুখ-দুখ দেখভাল সঙ্গে প্রাসাদ
ষড়যন্ত্র ও অমাত্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতা প্রতিহত করা কঠিন ছিল বইকি! ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনিতে
ফেনিয়ে ওঠা ভাবনার রাশ টানে লুৎফা। ঘোড়ার গাড়ির সহিসকে ভালো করে এতক্ষণে লক্ষ করে সে,
নারীমূর্তির সুদক্ষ চালনার মগ্নতা দেখে মুগ্ধ না-হয়ে পারে না। ছুটে চলা দুরন্ত অশ্বযুগলকে
নির্দেশনা দেয় চালক : কুছ ধীরে চলো তাজ, দুল। গতি খানিকটা শ্লথ হলে কৌতূহলী গলায় লুৎফা
জানতে চায় : বহিনঝি, আপকা নাম? স্মিত হাসি ফোটে সারথির ঠোঁটে - মেরি নাম সুলতান রাজিয়া।
সপ্রতিভ গলার ঋজু উচ্চারণে লুৎফার প্রতীতি জন্মে, এ নারী বহন করছে ভারতবর্ষের প্রথম
নারী শাসক সেই সাহসিকার শোনিত রক্তস্রোত। সুপ্রসন্ন গলায় লুৎফা তারিফ করে : বহুতি খুব!
প্রশংসা শুনে রাজিয়ার মুখ প্রীত হয়ে ওঠে। জবাবে ছুটে চলা গতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে
বলে : শুকরিয়া। কেরানীগঞ্জের জিনজিরার উপকণ্ঠে নামে লুৎফা। নামার পর একটু বিস্মিত বোধ
করে সে। জুড়ি ঘোড়ার গাড়ি কখনও বাবুবাজার ব্রিজ পার হয় না। আজ একেবারে বাসার কাছে নামিয়ে
দিল! ক্লান্তিতে এ ভাবনাকে আর প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করে না।
আজ অনেক দিন
পর ছাদে ওঠে লুৎফুন্নেসা। বুড়িগঙ্গা থেকে ছুটে আসা প্রাচীন হাওয়ারা ইতিহাস উড়িয়ে আনে।
এখান থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে জরাজীর্ণ হাওলি নাগেরা। কয়েক একর জমির ওপর মোগল স্থাপত্যের
অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত স্থাপত্যের নিদর্শন এ প্রাসাদ। গাছগাছালির সবুজ সমারোহে ফুলে
ফুলে শোভিত একসময়ের নান্দনিক মোগল প্রাসাদ। স্থানীয়রা তখন বলত হাবেলি নাগেরা। প্রাসাদের
যৌবন খসে এখন ওটা ঘিঞ্জি বসতিতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম দিকের বেশির ভাগ কুঠরি ময়লা আবর্জনার
স্তূপ। ওদিকে তাকিয়ে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে লুৎফা। শুধু বিষাদভরা ইতিহাস ছাড়া আজ আর প্রাসাদের
কোনো ছাঁদছিরি নেই। প্রতি বছর ক্লাসে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটক শেষ করার পর কয়েকদিন এ
বিষাদের আনাগোনা থাকে। একসময় ফিকে হয়ে যায়; তবে একেবারে সরে না মন থেকে। এ বোধের কারণ
নিশ্চিত করে বলা যায় চোখের আওতায় ক্রমে দুমড়ে যাওয়া জিনজিরা প্রাসাদের নীরব বিলাপ।
দূরে ক্ষয়িষ্ণু ও বিলীয়মান জিনজিরা প্রাসাদের বিমর্ষ ভঙ্গি সিরাজ পরিবারের দুর্ভাগ্যের
কাহিনি স্মরণ করাতে আকুল হয়ে থাকে। এটা টাটকা হয়ে ওঠে একাদশ শ্রেণিতে সিরাজউদ্দৌলা
নাটক পড়ানোর দিনগুলোয়। প্রাসাদের প্রতিটি ইটপাথর ওর মনে উস্কে দেয় বিষাদের নীল একটা
ধারা। প্রাসাদের জৌলসহীন রঙ, ক্ষয়িষ্ণু ইট, ঝুরা বালুর প্রতিটি অঙ্গে আছে বেদনার দীর্ঘশ্বাস।
সিরাজের মৃত্যুর পর পরিবারের পুরুষদের হত্যা করে নারীদের করা হয় বন্দি। মুর্শিদাবাদ
থেকে অন্য নারীদের সঙ্গে লুৎফাকেও বন্দি করা হয়। এখানে দীর্ঘ সাত বছর আটকে রাখা হয়
লুৎফা, তার কন্যা জোহরা, সিরাজের মা আমেনা খাতুন, আলিবর্দির স্ত্রী আর কুচক্রী ঘষেটি
বেগমকেও। মানবেতর জীবন যাপন করেন বন্দিরা। পরে মিরনের ষড়যন্ত্রে লুৎফা ও তার শিশু কন্যা
জোহরাকে ছাড়া বাকি সব বন্দিকে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। এ প্রাসাদের রন্ধ্রে
রন্ধ্রে আছে লুৎফার দীর্ঘশ্বাস আর শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ।
ইতিহাস কত
দরদের সঙ্গে বহন করে চলেছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সততা, দেশপ্রেম, আর ত্যাগের মাহাত্ম্য।
ঘৃণিত হলেও সবাই জানে বেইমান, বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের নাম। শুধু কি তাই! জাফরাবাদে
মীর জাফর বংশের অভিজাত সমাধি আজও অনুসন্ধিৎসু পর্যটকদের আগ্রহের স্থান। কিন্তু নদী
পার হয়ে কিছু দূরের খোশবাগে সিরাজউদ্দৌলার কবরস্থান জৌলসহীন, নিরাভরণ। সেখানে নীরবে
সিরাজউদ্দৌলার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা শায়িত। ইতিহাসে লুৎফুন্নেসার সেই দীপ্তি
কোথায়? কজন জানে যন্ত্রণাদগ্ধ সিরাজপত্নীর হৃদয়ের রক্তক্ষরণের ইতিহাস! সবাই যখন এক
এক করে সিরাজুদ্দৌলাকে ত্যাগ করে চলে যায় তখন প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা যোগানো সাহস
আর সঙ্গ তাঁকে ফের ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ যুগিয়ে ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ভগবান গোলায়
যখন নবাব বন্দী হোন তখনও সঙ্গী ছিল স্ত্রী লুৎফা। নির্মম মৃত্যু সিরাজের স্বপ্নকে থামিয়ে
দিলেও পরাজিত নবাব হওয়ার লাঞ্ছিত, ঘৃণিত জীবনের হাত থেকে সেও এক পরিত্রাণ ছিল বৈকি!
বেঁচে থাকা লুৎফাকে কী অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর কষ্ট সইতে হয়েছে! যেভাবে মানুষ জানে সিরাজের
মৃত্যুর গৌরবময় ইতিহাস, তার সিকিভাগ কী জানে লুৎফুন্নেসার ত্যাগ, শোক, তাপ, বেদনার
কথা! সিরাজের মৃত্যুর পর মীর জাফর ও তার ছেলে মিরন দুজনই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আয়েশি
জীবনের লোভে লুৎফুন্নেসা বিকিয়ে দেননি নবাবপত্নীর পরিচয়। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত
তিনি তার নামের সঙ্গে গেঁথে রেখেছিলেন স্বামী সিরাজউদ্দৌলার নাম। মৃত স্বামীর প্রতি
সন্মান, শ্রদ্ধা, সততা আর প্রেম বহন করে দীর্ঘ ৩৩ বছর মানবেতর জীবনযাপন করে গেছেন যে
নারী; কই তাকে তো তেমনভাবে দেদীপ্যমান করেনি ইতিহাস! জিনজিরা প্রাসাদ থেকে মুক্ত হয়ে
খোশবাগে ফিরে গিয়েও অসহায়, দীনহীন জীবন অতিবাহিত করেছেন নবাবের বিধবা পত্নী। বিয়ের
আগে সিরাজের নানিজান শরিফুন্নেসার হিন্দু পরিচারিকা ছিলেন লুৎফা। তখন তার নাম ছিল রাজকুনোয়ারি।
তার অপূর্ব
সৌন্দর্যে মুগ্ধ যুবক নবাব সিরাজউদ্দৌলা নানিজানের কাছে রাজকুনোয়ারিকে প্রার্থনা করলে
সিরাজকে আশাহত করেন না নানিজান শরিফুন্নেসা। সিরাজ ও রাজকুনোয়ারির সঘন প্রেম পরে বিবাহে
পরিণতি পায়। বিয়ের পর সিরাজ তাকে লুৎফুন্নেসা নামে অভিষিক্ত করেন। এ প্রেমকে গভীর শ্রদ্ধায়
আমৃত্যু অক্ষত রাখেন লুৎফা। কালের সাক্ষী এই জিনজিরা প্রাসাদে কী দহনে সাতটা বছর কালাতিপাত
করেছেন বিধবা নারী! বিভীষিকাময় দুর্গম পথ পাড়ি দিতে দিতে মৃত্যুকে পেয়েছিলেন অবশেষে!
অবশেষে মৃত্যুই তো তাকে সুযোগ করে দেয় নবাবের পাশে শেষশয্যায় শায়িতের সুখ! ভাবনার লাগামহীন
আবেগকে প্রশ্রয় দিতে এবার অস্বস্তি হয় লুৎফুন্নেসা। আসলে মৃত্যু কি পারে প্রেমের সেই
আগের দিনগুলো বিনির্মাণ করতে! কলেজ থেকে ফিরে কন্যাকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে অনেকদিন পর
ছাদে উঠেছে লুৎফা। দিন দিন বুড়িগঙ্গার বাতাসে ভেসে আসা দুর্গন্ধকে সহ্য করা পীড়াদায়ক
হয়ে উঠছে। যদিও বুড়িগঙ্গার দূষিত বাতাস দূর করতে পারে না লুৎফুন্নেসার প্রেমের সৌরভ।
এক বছর পর আবার দেখা হলো নবাবপত্নী লুৎফার সঙ্গে। শুধু কি লুৎফার জন্য মন এত অস্থির
আজ! জুড়িগাড়ি চালকের সুললিত অথচ দৃঢ় কণ্ঠের নামটা কানে অনুরণিত হচ্ছে। ঐতিহাসিক সেই
নাম ‘সুলতান রাজিয়া’। না সুলতানা
বলেনি চালক। সুলতানা তো সুলতানের স্ত্রী। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দিল্লির নারী শাসক একজনই
ছিলেন; আর তিনি ‘সুলতান রাজিয়া’। পিতা সুলতান
ইলতুৎমিশের নির্বাচিত উত্তরাধিকার। পুত্র থাকা সত্ত্বেও সুলতানকন্যা রজিয়াকেই যোগ্যতম
হিসেবে রাজ্য শাসনের উত্তরসূরি মনোনয়ন করে যান। ঘোড়ার গাড়িটা তাকে আজ কী করে জিনজিরার
উপকণ্ঠে পৌঁছে দিয়ে গেছে! এতদূর তো কখনও জুড়িগাড়ি আসে না! বিভ্রমে পড়ে যায় সে। প্রাসাদের
ক্ষয়িষ্ণু আর বিপর্যস্ত আঙিনায় দৃষ্টি পড়তেই লুৎফুন্নেসার বাস্তব ও কল্পনার পেন্ডুলাম
স্থবির হয়ে যায়। সেই ঘোড়ার জুড়ি গাড়িটা বুড়িগঙ্গার শীতার্ত হাওয়া টপকে আকাশের শূন্যতা
খামচে উড়ে যাচ্ছে হারেলি নাগেরার দিকে। চালক দক্ষ হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে দীপ্ত নারীকণ্ঠে
বলছে : আওর তেজে চালও তাজ- দুল, জোরসে...। যে মুখ ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বসেও স্পষ্ট করে
দেখা হয়নি সেই অবয়ব এখন কুয়াশার মিহি কণা ছিঁড়েখুঁড়ে আলোময় হয়ে ওঠে লুৎফার চোখে। সুলতান
রাজিয়া! জিনজিরা প্রাসাদের তোরণ থেকে বেরিয়ে আসা সফেদ কুর্তিপরা এক নারীমূর্তি বুড়িগঙ্গার
তীরে এসে থামে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রিয়তমা পত্নীকে চিনতে ভুল হয় না লুৎফুন্নেসার।
নবাবপত্নী লুৎফুন্নেসার অপরূপ সৌন্দর্যে আলোকিত হয়ে ওঠে বুড়িগঙ্গার চরাচর। নদীর জলও
ফিরে পেয়েছে পুরনো যৌবন। টলটলে পানিতে দলছুট ঢেউয়ের বেহিসাবি আনন্দ সন্তরণ দৃষ্টিতে
স্বস্তি আনে। জুড়ি গাড়িটা মাটি স্পর্শ করে না। রাজিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া আলিঙ্গনের মুদ্রায়
ফিনিক্স পাখির মতো অলৌকিক উড়ালে সেদিকে ধাবিত হন লুৎফুন্নেসা। আলোকিত আকাশ ভ্রমণের
দিক থেকে দৃষ্টি ফেরানো দায় হয়ে ওঠে শিক্ষক লুৎফুন্নেসার।
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.