সুস্মিতা চক্রবর্তী
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৭:৩৪ পিএম
আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:৩৮ পিএম
বাংলাদেশের
কৃষিসমাজের নিম্নবর্গীয় প্রান্তিকতাকে ভেদ করে নারীর যে স্বর আমরা শিক্ষিত সাহিত্যওয়ালারা
প্রথম শুনতে পাই, সেটা চন্দ্রাবতীর। চন্দ্রাবতীর জন্ম সাড়ে ৪শ বছর আগে, ১৫৫০ সালে।
কিশোরগঞ্জ জেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের পাতুয়ারি গ্রামে। মায়ের নাম সুলোচনা দেবী। পিতা
দ্বিজ বংশীদাস ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মনসামঙ্গলের কবি। দ্বিজ বংশীদাস মনসার
ভাসান গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন।
কবি ছিলেন
চন্দ্রাবতী। বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে যাঁরা কবিতা লেখার ‘সাহস’ প্রদর্শন
করেছিলেন, জানামতে তাঁদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তিটি ছিলেন চন্দ্রাবতী। ছেলেবেলা থেকেই
তিনি কবিতা রচনা করতেন। পিতার সঙ্গে একত্রে মনসার ভাসান গান রচনা করেছেন। কাব্য রচনায়
পিতার উৎসাহ তাঁকে সাহায্য করে থাকতে পারে। গ্রামের সাধারণ মানুষকে নিয়ে অসংখ্য গান
রচনা করেছেন চন্দ্রাবতী। বিভিন্ন মেয়েলি ব্রতের ছড়া, প্রাচীন আচার-পদ্ধতি অবলম্বনে
বিভিন্ন কবিতাও রচনা করেছেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত তাঁর ‘দস্যু কেনারামের
পালা’ দীনেশচন্দ্র
সেনের ময়মনসিংহ গীতিকায় স্থান পেয়েছে। গীতিকার ‘মলুয়া’ পালাটিও তাঁর
রচিত। লোকসাহিত্যের বিশিষ্ট সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে সর্বপ্রথম চন্দ্রাবতীকে পাঠকের
সামনে তুলে ধরেন কেদারনাথ মজুমদারের ‘সৌরভ’ পত্রিকার
মধ্য দিয়ে (মূল লেখার পুনর্মুদ্রিত পাঠের জন্য দ্রষ্টব্য : চন্দ্রকুমার দে, ১৯৯৬)।
ময়মনসিংহ গীতিকায় সংকলিত চন্দ্রাবতীর পালাগুলোও তাঁরই সংগ্রহ করা। এসব খবর অনেকেরই
অজানা নয়।
ভদ্রলোক পুরুষপণ্ডিতদের
সাহিত্যালোচনায় চন্দ্রাবতী ও তাঁর রামায়ণ
চন্দ্রাবতীর
যে একটা রামায়ণ আছে সেটাও, কোনোমতেই নতুন কোনো খবর নয়। খবর বরং এইটা যে, সেই রামায়ণ
বঙ্গদেশের ভদ্রলোকশ্রেণির কাছে ‘সাহিত্যপদবাচ্য’ হতে পারেনি
বলে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনার সিরিয়াস কোনো চর্চাই গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের ফোকলোর রচনাপঞ্জি
(শামসুজ্জামান খান ও মোমেন চৌধুরী, ১৯৮৭) ঘেঁটে কোথাও চন্দ্রাবতী বা তাঁর রামায়ণ নিয়ে
কোনো লেখালেখির হদিস পাওয়া গেল না। পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতি রচনাপঞ্জির (বরুণকুমার
চক্রবর্ত্তী, ২০০২) কোনো শিরোনামেও চন্দ্রাবতী বা তাঁর রামায়ণবিষয়ক কোনো অন্তর্ভুক্তি
দেখা গেল না। এই পঞ্জিতে সাধারণভাবে গীতিকা নিয়ে আলোচনামূলক কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম
আছে বটে (আশুতোষ ভট্টাচার্য, ১৩৯৯; বরুণকুমার চক্রবর্ত্তী, ১৪০৬; বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়,
১৯৮৫ ইত্যাদি), যাদের ভেতরে বোঝাই যায় চন্দ্রাবতীর গীতিকা-পালা-গাথা নিয়ে আলাপ-আলোচনা
থাকার কথা। এসব আলোচনার মধ্যে তাঁর রমায়ণ-পালা নিয়ে আলোচনা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু
সেগুলো চন্দ্রাবতীর রামায়ণের বা অন্য কোনো রচনার, নারীবাদী গুরুত্ব অনুধাবনে সচেষ্ট
কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। এই সংশয় নিছক কল্পিত নয়। তা নিশ্চয়ই বোঝা সম্ভব হবে যদি আমরা
বাংলা ভাষা-সাহিত্য-ফোকলোরের সুপণ্ডিতদের চন্দ্রাবতীচর্চার দিকে মনোনিবেশ করি।
‘ফোকলোর’ না ‘লোকসংস্কৃতি’- কোন নামে
শাস্ত্রটিকে ডাকা হবে তা নিয়ে দুই বাংলার অধ্যাপক-গবেষকদের মধ্যে অনেক ঝগড়াঝাঁটি থাকলেও
চন্দ্রাবতীচর্চার ক্ষেত্রে দারুণ মিল দেখা গেল (অন্য অনেক মিলও পাওয়া যায় বৈকি, তবে
এখানে তা আলোচ্য নয়)। সবাই পুরুষ-চোখে চন্দ্রাবতীকে দেখেন। এই পুরুষ-দেখন অনুসারে চন্দ্রাবতীর
পরিচয়ের প্রধান তিনটা দিক চোখে পড়ে :
ক. চন্দ্রাবতীর
প্রথম প্রধান পরিচয় হলো, তিনি একজন পুরুষের কন্যা; পিতা-পুরুষটি একজন কবি। এইভাবে পণ্ডিতদের
বয়ানে চন্দ্রাবতীর পরিচয় দাঁড়ায়- “সতেরো শতকের
মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাস’-এর ‘কন্যা’ (আহমদ শরীফ,
****: ৩৪১), বা ‘বিখ্যাত কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা” (আশরাফ সিদ্দিকী,
১৯৬৩ : ৩০৯), বা ‘সপ্তদশ শতাব্দীর কবি মনসামঙ্গল রচয়িতা
দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা’ (আশুতোষ ভট্টাচার্য, ১৯৬২ : ৩০৩),
বা ‘কবি চন্দ্রাবতী
কবি দ্বিজ বংশীদাসেরই কন্যা’ (কিশোরগঞ্জের ইতিহাস, ১৯৯৩ : ১৯৯),
অর্থাৎ ‘চন্দ্রাবতী
ছিলেন এই বংশীদাসেরই কন্যা’ (ভূদেব চৌধুরী, ১৯৬২ : ৪০৩) ইত্যাদি।
এভাবে চন্দ্রাবতীর নিজ পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে তাঁর পিতৃপরিচয়। তথাপি পরিহাস, এই পণ্ডিতেরা
খোদ দ্বিজ বংশীদাসের নিজের পরিচয় নির্ণয় করার প্রধানতম সূত্র হিসেবে কাজে লাগান চন্দ্রাবতীর
রচনাংশকেই (ভূদেব চৌধুরী, ১৯৬২ : ৪০৩-৪০৪)।
খ. চন্দ্রাবতীর
দ্বিতীয় প্রধান পরিচয় হলো তিনি কবি নন, ‘মহিলা কবি’ (চন্দ্রকুমার
দে, ১৯৯৬ : ৫৫), বা ‘মৈমনসিংহের মহিলা কবি’ (ভূদেব চৌধুরী,
১৯৬২ : ৩৬৮) বা ‘বিখ্যাত মহিলা কবি’ (দীনেশচন্দ্র
সেন, ১৯৩২ : ৫১৯) বা “বাঙলার ‘প্রথম স্ত্রীকবি’” (গোপাল হালদার,
১৯৫৪ : ১৪৪) ইত্যাদি। এভাবে চন্দ্রাবতীর কবি-পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে মহিলা কবি-পরিচয়।
বলে না দিলেও চলে, ‘নারীত্ব’ আর ‘কবিত্ব’ যে গুণগতভাবেই
পরস্পর বিপরীত বস্তু, এই উপলব্ধিই চন্দ্রাবতীকে মহিলা-কবি হিসেবে তুলে ধরার কারণ। চন্দ্রাবতী
মেয়ে হয়েও কাব্য করেছেন, সেটাই বড় কথা হয়ে উঠেছে। এ কারণেই কাউকে ‘পুরুষ-কবি’ বলে পরিচয়
দিতে হয় না- যেন কবিতা লেখার মতো ‘স্বাভাবিক’ কাজ পুরুষের
আর নাই।
গ. চন্দ্রাবতীর
তৃতীয় প্রধান পরিচয় হয় তাঁর প্রেমিকা-পরিচয় বা নায়িকা-পরিচয়। এই পরিচয়ানুসারে, তিনি
ছিলেন ‘সুপ্রচলিত
লোককাব্যের নায়িকা’ (ভূদেব চৌধুরী, ১৯৬২ : ৩৬৮), যাঁর
ছিল ‘রোমান্টিক
জীবনকাহিনী’ (ভূদেব চৌধুরী, ১৯৬২ : ৪০৩)। এই ‘রোমান্টিক
জীবনকাহিনী’র উৎস তৎকালে নয়ান ঘোষের লেখা ‘চন্দ্রাবতী’ নামের একটি
‘কাব্যের গল্পাংশ’ (ভূদেব চৌধুরী,
১৯৬২ : ৩৬৮), যার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে কিছু বলা মুশকিল। অথচ পণ্ডিতদের প্রায় সবাই
চন্দ্রাবতীর আলাপ উঠলেই ওই ‘রোমান্টিক জীবনকাহিনী’র কেচ্ছা বলতে
শুরু করেন এবং এই কেচ্ছার ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন (ভূদেব চৌধুরী, ১৯৬২ : ৩৬৮;
বরুণকুমার চক্রবর্ত্তী ও দিব্যজ্যোতি মজুমদার, ১৯৬৬; xviii-xix;; কিশোরগঞ্জের ইতিহাস,
১৯৯৩ : ১৯৯-২০০)। এই কেচ্ছা, চন্দ্রাবতীর কবি-পরিচয়ের ওপরে স্থান দেয় তাঁর প্রেমিক-নায়িকা
পরিচয়কে, তাঁর কাব্যচর্চাকে প্রতিপন্ন করে কবিপিতার উৎসাহ-অনুপ্রেরণার পরোক্ষ পরিণাম
হিসেবে এবং সর্বোপরি, চন্দ্রাবতীর পুরোদস্তুর কবিজীবন যাপনের কারণ হিসেবে ইঙ্গিত করে
প্রেমিক জয়ানন্দের জনৈক মুসলমান নারীকে বিবাহজনিত করুণ বেদনাকে। এইভাবে চন্দ্রাবতী
হয়ে পড়েন পরোক্ষ নিষ্ক্রিয় সত্তায়, কর্তা থাকেন সেই পুরুষই।
চন্দ্রাবতীর
‘মলুয়া’ বা ‘দস্যু কেনারামের
পালা’ নিয়ে যদি-বা
সাহিত্য সমালোচকরা আলোচনা করেছেন, কিন্তু কাউকেই চন্দ্রাবতীর রামায়ণের তাৎপর্যপূর্ণ
আলোচনা করতে দেখা যায় না। সাধারণভাবে বঙ্গদেশের লোকসাহিত্য নিয়ে বই লিখেছেন, কিন্তু
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ নিয়ে কোনো আলোচনাই করেননি (যেমন আশুতোষ ভট্টাচার্য, ১৯৬২; আশরাফ
সিদ্দিকী, ১৯৬৩; ওয়াকিল আহমদ, ২০০১), কিংবা ‘পরিচিতি’মূলক দু-চার
লাইন লিখে ছেড়ে দিয়েছেন (যেমন আজহার ইসলাম, ২০০০ : ৩২২) এমন গ্রন্থও অসুলভ নয়।
চন্দ্রাবতীর
রামায়ণ : সীতাদের
যাপিত জীবন
সাহিত্যিক-গবেষক-অধ্যাপক
নবনীতা দেব সেনই প্রথম চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে আমাদের ভদ্রলোকী
শিক্ষিত সমাজের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর আলোচনা (নবনীতা দেব সেন, ১৯৯৭;
Nabaneeta Deb Sen, 1998, ১৯৯৮) থেকে চন্দ্রাবতীর রামায়ণই শুধু নয়, নারী-বিরচিত রামায়ণসমূহের
সম্পূর্ণ আলাদা একটা নারীবাদী তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া চলে এবং চন্দ্রাবতীর রামায়ণ
আবার একবার পাঠ করার তাগিদবোধ করা যায়। এবারে আমরা নবনীতার সাহায্য নিয়ে নারীর রামায়ণের
দিকে তাকাব।
পৃথিবীর সব
মহাকাব্যই আসলে পুরুষের রচিত; পুরুষের গৌরবগাথার বয়ান। নারীকে সেখানে দেখানো হয়েছে
পুরুষদের হাতের পুতুল হিসেবে। কখনও সে পুরুষের থাবার মধ্যে, কখনও অপহৃতা (যেখানে পুরুষই
তাকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে)। অর্থাৎ নারীকে একজন পুরুষের সমপর্যায়ের মর্যাদা তো দেওয়া
দূরে থাক, উল্টো তাকে মহাকাব্যের পুরুষ-কলাকাররা পুরুষের ওপর চরমভাবে সার্বিক অর্থে
নির্ভরশীল দুর্বল জীব হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়েছেন সব সময়ই। এতে করে পুরুষতান্ত্রিক
সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোই জারি থেকেছে। রামায়ণ মহাকাব্যটিও পুরুষদের হাতে
রচিত পুরুষেরই মাহাত্ম্য-কথন। এ মহাকাব্যের নায়ক রামকে গোটা ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের
আদর্শ পুরুষের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। সীতাকেও তাই।
... ‘রাম’ আদর্শ আর্য
পুরুষের প্রতীক। বাল্মীকি সুপরিকল্পিতভাবে এই প্রাচীন গল্পভিত্তিক একটি জীবনদর্শন,
সমাজনীতি ও ধর্মদর্শন রূপায়িত করতে চেয়েছেন। তাঁর কাব্যে তাই আদর্শ পিতা, আদর্শ পুত্র,
আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ ভাই, আদর্শ মাতা, আদর্শ শাসক ও শাসনপ্রণালি, আদর্শ বিচারক ও আদর্শ
বীর, আদর্শ ভৃত্য, আদর্শ অনুচর-সহচর ও আদর্শ শত্রুর বাস্তব দৃষ্টান্ত দেওয়ার প্রয়াস
প্রকট। (আহমদ শরীফ, ১৯৭৮ : ৩৭২)
গোটা রামায়ণে
সীতাকে দেখানো হয়েছে অন্য পুরুষের ওপর সার্বিকভাবে নির্ভরশীল একজন ‘আদর্শ নারী’ হিসেবে, যিনি
সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে যাবেন সারাজীবন এবং যাবতীয় দুর্ভোগের শিকার হবেন।
সীতার এই মূর্তিটিই আমাদের সমাজের আদর্শ নারীর রূপাবয়ব হিসেবে দেখানো হয়েছে- যা সব
অর্থেই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধগুলোকেই আক্ষরিকভাবে জারি রাখে। এ
রকম পৌরাণিক-পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র আমাদের মহৎ সাহিত্যে স্থান পেয়েছে এবং অধিকন্তু,
আমাদের মগজে ও মননে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
প্রচলিত রামায়ণ
তা যে ভাষাতেই লেখা হোক না কেন, সেখানে বিভিন্নভাবে রামের প্রশস্তি বা বন্দনাগীত গাওয়া
হয়েছে। সেদিক থেকে আমাদের বঙ্গদেশের কবি চন্দ্রাবতীই রামকাহিনী রচনায় স্বতন্ত্র মনীষার
পরিচয় দিয়েছেন, যা যুগ যুগ ধরে পুরুষ-কবিদের হাতে লিখিত প্রচলিত রামকাহিনীর মাহাত্ম্যকে
ক্ষুণ্ন করেছে। আর সে জন্যই চন্দ্রাবতীর রামায়ণটি পরিশীলিত সাহিত্য-দরবারে স্থান পায়নি।
সমাজের উচ্চস্তরে নানাভাবে এ রামায়ণ-পালাটি বর্জিত হলেও নিম্নবর্গের, বিশেষত পল্লীসমাজের
নারীর, ঘরোয়া রামায়ণী আচার-অনুষ্ঠানে আজও চন্দ্রাবতীর রামায়ণই গাওয়া হয়ে থাকে।
কবি চন্দ্রাবতী
তাঁর রামায়ণ-গানে কোনো প্রকার ভক্তিরস, বীররস, শৃঙ্গার রস তুলে ধরেননি। শুধুমাত্র মধুর
আর করুণ রসকে আশ্রয় করে কাহিনী নির্মাণ করেছেন। কবি সীতাকে তাঁর রচনায় মুখ্যরূপে দেখিয়েছেন;
প্রচলিত রামায়ণকারদের পথে না হেঁটে সীতার জীবনকেই পাঠককুলের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
সীতার দুঃখ-কষ্টকে তিনি তার নারী-মনোভাব দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই রামকে তিনি কোনো
কোনো স্থানে সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। আর এ জন্যেও, প্রথাবিরুদ্ধ এই রামায়ণ-গান পুরুষশাসিত
সমাজে গ্রহণযোগ্যতা তো পায়ইনি, বরং নিন্দিত হয়েছে।
‘পরিশীলিত’ রামায়ণে সাতটি
কাণ্ড রয়েছে, যার মধ্যে উত্তরাকাণ্ড একটি। এই উত্তরাকাণ্ডেই সীতার বনবাস ও তাঁর ধরিত্রী-প্রবেশ
ঘটে থাকে। চন্দ্রাবতী এই কাণ্ডটিকেই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেন তাঁর রামায়ণে।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ তিন খণ্ডে বিভক্ত। এটিও প্রচলিত অর্থে ঐতিহ্যবিরোধী। প্রথম খণ্ডটি
তিনি সীতার জন্মকাহিনীর মধ্য দিয়ে শেষ করেছেন, যেখানে সীতার পৌরাণিক কাহিনী অনুসরণ
করা হয়নি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দেখা যায়, ‘সীতার বারমাসী’, যেখানে সীতা
সখীদের সঙ্গে বসে আছেন, তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখ তিনি সখীদের কাছে গল্পচ্ছলে বলে চলেছেন।
তাঁর বাল্যের কথা, বিবাহের কথা, রাবণ কর্তৃক তাঁর হরণের কথা, অশোক বনে তাঁর বন্দিদশার
কথা, রামের জন্য তাঁর বিরহকাতরতার কথা, রাম কর্তৃক তাঁর উদ্ধারের কথা এবং অযোধ্যায়
তাঁর প্রত্যাবর্তনের কথা। তৃতীয় পরিচ্ছেদে চন্দ্রাবতী ও সীতা উভয়েই কথকের ভূমিকা নিয়েছেন।
এ পরিচ্ছেদে কবি তার নিজের অনুভূতি দিয়ে রামায়ণের ঘটনাপ্রবাহকে উপলব্ধি করেছেন। প্রসঙ্গত
উল্লেখ্য যে, রাম যখন তার বোনের কথায় বিশ্বাস করে সীতাকে সন্দেহ করে চরম ক্রোধে ফেটে
পড়ে, তখনকার পরিস্থিতিটি কবি তার নিজের বয়ানে হাজির করেন :
বনেতে আগুনি
জ্বলে গো সায়রে ছোটে বান।
উন্মত্ত পাগলপ্রায়
গো বসিলেন রাম॥
রাঙ্গা জবা
আঁখি রামের গো শিরে রক্ত উঠে।
নাসিকায় অগ্নিশ্বাস
ব্রহ্মরন্ধ্র ফুটে॥
যে আগুন জ্বালাইল
আজ গো কুকুয়া ননদিনী।
সে আগুনে পুড়িবে
সীতা গো সহিত রঘুমনি॥
পুড়িবে অযোধ্যাপুরী
গো কিছুদিন পরে।
লক্ষ্মীশূন্য
হইয়া রাজ্য গো যাবে ছারেখারে॥
পরের কথা কানে
লইলে গো নিজের সর্ব্বনাশ।
চন্দ্রাবতী
কহে রামের গো বুদ্ধি হইল নাশ॥
(দীনেশচন্দ্র
সেন, ১৯৩২ : ২৬৯)
রামের এই চিত্রণ
কোথাও নাই। এই চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ছাড়া। এ রামায়ণের সর্বত্র কবি কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ
হয়েছেন। বিশেষত সীতার দুঃখ-কষ্টে তার কাতরতা এবং রামের প্রতি তার ক্ষোভ- এগুলো তার
নিজের জবানীতে জোরালোভাবে এসেছে। এসব দিক থেকে এই রামায়ণ একেবারেই ভিন্ন চিন্তনের ছাপ
রেখেছে আমাদের সমাজে, বিশেষত নারীদের ঘরোয়া আসরে যেখানে তারা চন্দ্রাবতীর গান গেয়ে
সীতার জীবনের নানা সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেরা একাত্ম হন।
সমগ্র রামায়ণটিকে
শেষ করেছেন তিনি সীতার বনবাসের সূচনার ভেতর। চন্দ্রাবতীর বলার স্টাইল এখানে একেবারে
ভিন্ন। পৌরাণিক রামায়ণে সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা বর্ণনা আছে এবং এ পরীক্ষার মধ্য দিয়েও
শেষ পর্যন্ত রামকে চরম প্রজাহিতৈষী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পৌরাণিক রামায়ণকারেরা।
কিন্তু চন্দ্রাবতী তাঁর রাম-কাহিনীতে সীতার অগ্নিপরীক্ষার বিষয়টি একেবারেই আনেননি।
একজন নারী হিসেবে আরেকজন নারীর অপমানজনক ও লজ্জাজনক পরিস্থিতিকে দর্শকের সামনে নির্লজ্জভাবে
দেখাতে চাননি কবি, বরং রামের প্রতি তীব্র বিদ্রূপ হেনে তাঁকে পাষণ্ড ও সন্দেহপ্রবণ
স্বামীরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোনোরকম রাম-বন্দনা তিনি করেননি।
ময়মনসিংহের
আঞ্চলিক ভাষায় কবি রামায়ণটি রচনা করেছেন। রামায়ণটি পাঠ করলে বোঝা যায় এটি একটি নারীবিষয়ক
কাব্য এবং কাব্যটি নারী শ্রোতার প্রতিই উদ্দিষ্ট। নারীর কষ্টকেই এ কাব্যে বড় করে দেখানো
হয়েছে। রামায়ণের অনেক অংশে যেখানে সীতা তার কষ্টের কাহিনী বয়ান করেছেন, সেখানে চন্দ্রাবতী
শুরুই করেছেন ‘শুন সখীজন’ বলে।
কবি চন্দ্রাবতী
এই ব্যতিক্রমী রামায়ণটি রচনা করেন তার জীবনের শেষ পর্যায়ে। আজ থেকে বহু বছর আগে কবি
চন্দ্রাবতীর জীবনাবসান ঘটেছে, কিন্তু তার এই রামায়ণ-গান আজও সেই অঞ্চলের মেয়েরা তাদের
নিজস্ব উৎসব অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকেন। এটাই কবির এই রামায়ণ রচনার সার্থকতা। পুরুষতান্ত্রিক
এই ঘুণে ধরা সমাজে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি সমস্ত কিছু পুরুষের দ্বারা নির্ধারিত হলেও
আজও পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা তাদের সমাজে চন্দ্রাবতীর রামায়ণকেই বেছে নিয়েছেন পৌরাণিক পুরুষ-সাহিত্যিকের
রামায়ণকে বয়কট করে। এখানে নারীবাদী কবির চিন্তনের ছাপ স্পষ্ট হয়েছে গরিব নারীদের এই
রামায়ণী গানকে আপন করে গাওয়ার মধ্য দিয়ে।
ভারতের বিভিন্ন
গ্রামে মেয়েরা যে রামায়ণ গান করে তা কেবল মেয়েদের সমাজেই প্রচলিত। মেয়েদের সমাজের বাইরে
এ রামায়ণ গান গাওয়া হয় না। বাংলা, তেলেগু, মৈথিলী ও মারাঠি ভাষায় গ্রামের মেয়েরা নিজেরা
রামায়ণ গান করে থাকে। এসব রামায়ণ গানে মেয়েরা সম্মিলিতভাবে সীতার বয়ানে তাদের নিজেদের
দুঃখ-কষ্টের গান গেয়ে থাকে। কখনও বীজ লাগানোর সময়, কখনও ফসল তোলার সময়। আবার কখনো-বা
নিজেদের নিজস্ব ঘরোয়া উৎসব-অনুষ্ঠানে। মারাঠি ভাষায় মহারাষ্ট্রের গাঁয়ের মেয়েদের রামায়ণ
গানের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গানের সবিশেষ মিল পাওয়া যায়। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গানও
নারীরা সম্মিলিতভাবে উপস্থাপন করে, যে গানে ধ্বনিত হয় সীতার মহিমা, সীতার জীবনের বিভিন্ন
পর্যায়। তার জন্ম-বিবাহ-সন্তানধারণ-স্বামীপরিত্যক্ত হওয়া, সন্তান নিয়ে একাকী জীবন কাটানো।
অর্থাৎ একটা নারীর জীবনে যে সমস্ত বিষয় প্রায়শই ঘটে থাকে, সেগুলোই এসব রামায়ণ গানে
বড় করে এসেছে। যার জন্য সমাজের শোষিত প্রান্তিক নারীরা এই রামায়ণ গানের সঙ্গে সহজেই
শামিল হয়। সীতার কষ্ট-বেদনার সঙ্গে নারীরা তাদের নিজেদের দুঃখ-বেদনাকে সীতার বেদনার
মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে সীতার কষ্টে কাতর হয়। নারীদের রামায়ণ হয়ে ওঠে নারীদের ইতিহাস,
নারীদের নিজেদের স্বর।