× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্রিয়ভাষিণীর ’৭১

শাহীন আখতার

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৮:৫০ পিএম

আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:৫৬ পিএম

প্রিয়ভাষিণীর ’৭১

১৯৯৬ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর কথ্য ইতিহাস প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর আমরা মাসে, দুই মাসে একবার করে বসতাম। তখন প্রস্তুতির সময়। কাজের বিষয় ও পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো। সে সময় একদিন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রসঙ্গ আসে। তিনি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সময় অবাঙালি অধ্যুষিত শিল্পশহর খালিশপুরে ছিলেন, আমাদের মনে হয়েছিল তাঁর কাছ থেকে সেই এলাকার অত্যাচারিত নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে।

প্রকল্পের পরিচালক ড. হামিদা হোসেন একদিন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি কী এক কাজে আমাদের অফিসে (আসক অফিসে) এসেছিলেন। পরিচয় শেষে আমি আর প্রিয়ভাষিণী কিছুক্ষণ কথা বলি। তাকে ভীষণ উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। কথাবার্তাও বেশ খাপছাড়া। তিনি হঠাৎ করে বললেন, ১৯৭১-এ তাঁর বাড়িতে আর্মি এসেছিল। তিনি বোনকে নিয়ে থাকতেন। স্বামী মুক্তিযুদ্ধে। একদিন কয়েক গাড়ি পাকিস্তানি সৈন্য বাড়িটা ঘিরে ফেলে।

তার কথায় খানিকটা আঁচ পাওয়া গেলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম না, তিনি ৭১-এ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কি না বা হয়ে থাকলেও আমাদের প্রকল্পের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হবেন কি না। তবে তখনই ঠিক হয়ে গেল- আমি তাঁর বাড়ি যাব এবং তিনি ৭১ নিয়ে কথা বলবেন।

১৯৯৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর দুপুরবেলা প্রিয়ভাষিণীর ধানমণ্ডির বাড়িতে হাজির হই। সেদিন বলতে গেলে সারাজীবনের বৃত্তান্ত তিনি আমায় শোনান। সঙ্গে আনা ক্যাসেট ফুরিয়ে গেছে, বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা- তার কথা শেষ হচ্ছিল না। শুনতে শুনতে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। বিভ্রান্তও হচ্ছিলাম। আমাদের জানামতে, ৭১-এর যে পরিস্থিতিতে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, প্রিয়ভাষিণীর বিষয়টা সে রকম নয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়নি। তিনি যুদ্ধের সময় চাকরিতে ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানে দিনের পর দিন নির্যাতিত হয়েছেন। অথচ তিনি সেখানে আটকও ছিলেন না। এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

সাক্ষাৎকারের সময় প্রিয়ভাষিণী বারবার তার পারিবারিক জীবন, আর্থিক অনটন, ব্যক্তিগত জীবনের সংকট, তার সম্পর্কে সমাজের বিচারবোধ ইত্যাদি প্রসঙ্গে বলছিলেন। সত্যি যে, এসব বাদ দিয়ে প্রিয়ভাষিণীর ৭১ বোঝা যাবে না।

প্রথম দিন বাড়ি ফিরে রেকর্ড করা ক্যাসেটগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, আমি কোনো ঘটনারই শুরু-শেষ ধরতে পারছি না। সময়ের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। আচমকা এক ঘটনার মাঝখানে আরেক ঘটনা ঢুকে পড়ছে। ভাবলাম পরেরবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় একটা একটা ঘটনা ধরে আলাপ করব। সেভাবেই বলব তাঁকে বলতে।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে শাহীন আখতার 

এবারও প্রথম দিনের পুনরাবৃত্তি ঘটল। তা ছাড়া ঘটনার চেহারাও দেখলাম পাল্টে যাচ্ছে। প্রথম দিন যেভাবে বলেছেন, সেভাবে না বলে একই ঘটনা বলতে লাগলেন অন্যভাবে। সেখানে খুঁটিনাটি অনেক কিছুর রদবদল হচ্ছিল। এভাবে বক্তব্য বদলে যাওয়ার কারণ হয়তো প্রথম দিন যা বলতে পারেননি, দ্বিতীয় দিনে অপরিচিতের ব্যবধান খানিকটা ঘুচে যাওয়ায় সেসব কথা আমাকে খোলাখুলি বলতে পারছিলেন। এ ছাড়া আমার মনে হয়, ৭১-এর ৯ মাসের প্রায় প্রত্যেক দিন তার জীবনে এত কিছু ঘটে গেছে যে, তিনি তা বলার সময় খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। আমিও না- বোঝার তাড়না থেকে বারবার তার কাছে ফিরে গেছি। ফোনেও যখন-তখন আমাদের কথা হয়েছে। কখনও এমন হয়েছে, হয়তো তার বাড়ির কাছ দিয়ে কোথাও যাচ্ছি, মনে হলো একবার দেখা করে যাই। তো গিয়েছি দেখা করতে। রেকর্ডার দূরে থাক, সঙ্গে কাগজ-কলমও নাই। সেদিনও উনি এমন সব নতুন বিষয়ে কথা বলেছেন, যা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বলেননি। এ ছাড়া কখনও হয়তো সাক্ষাৎকার-পর্ব শেষ, ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে উঠে যাব, উনি নতুন কথা তুললেন। আবার বসলাম। তখনও ঘণ্টাখানেক বা তারও বেশি সময় একনাগাড়ে কথা বলে গেছেন। তার কথা বলার বিশেষ একটি ধরন ছিল- সংলাপের মাধ্যমে তিনি কোনো ঘটনা বা বক্তব্য তুলে ধরতেন। আমাদের আলাপ-পরিচয় ১৯৭১-এর সূত্রে বলেই হয়তো আমাকে দেখামাত্র তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বলতে শুরু করতেন। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এসব কথায় সব সময় নতুন নতুন তথ্য থাকত, হৃদয়- মোচড়ানো ঘটনা থাকত।

এভাবে চার বছরে বেশ কয়েকবার আমি প্রিয়ভাষিণীর মুখোমুখি বসি। তারপরও মনে হয় আরও জানা বাকি, বোঝা বাকি। প্রিয়ভাষিণীর ৭১ ভূগর্ভস্থ খনি- অতল, অন্ধকার, যার বাঁকে বাঁকে বহু জটিল স্তর আছে। সাক্ষাৎকারটি ঠিকভাবে উপস্থাপিত না হলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে। যা হোক, দুই বছরের মাথায় কথ্য ইতিহাস প্রকল্প থেকে রিপোর্ট তৈরির তাড়া আসে। আমার একপাশে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা টাইপ কাগজ- ক্যাসেট-ট্রান্সক্রিপশন, আরেকপাশে প্রিয়ভাষিণীর হাতে লেখা বয়ান, আমি সামনের সাদা কাগজে আঁচড় না কেটে বসে আছি। শত্রু-মিত্রের মিশেল রূপ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এক অবাস্তব আর জটিল চেহারা, রিপোর্ট-ফর্মে আমি কোনোভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পারছিলাম না। তখন প্রকল্পের উপদেষ্টা মেঘনা গুহঠাকুরতা নানা পরামর্শ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেন।

প্রিয়ভাষিণীর সাক্ষাৎকার আসক-এর বইয়ে ছাপা হওয়ার আগেই দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং টিভিতে তিনি এ বিষয়ে বেশকিছু সাক্ষাৎকার দেন। তাকে নিয়ে লেখালেখিও হয় অনেক জায়গায়। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসের টোকিও ট্রাইব্যুনালে আমরা অংশগ্রহণ করি। প্রিয়ভাষিণী সেখানে ১৯৭১-এর নির্যাতন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত জবানবন্দি দেন। সুতরাং ১৯৯৬ থেকে ২০০০ এই দীর্ঘসময়ে আমি যে তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম, তার কম- বেশি তথ্য ততদিনে পাঠকদের জানা হয়ে গেছে। তারপরও আসক-এর নারীর ৭১ ও যুদ্ধপরবর্তী কথ্য কাহিনী বইয়ে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল প্রকল্পের কাজের একটি পূর্ণাঙ্গ চেহারা দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া প্রিয়ভাষিণীর নির্যাতনের কাহিনি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড করা হয় আসক-এর কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায়। তাঁর জন্য এবং প্রকল্পের পক্ষ থেকে আমার জন্য এটি ছিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা যন্ত্রণার- অব্যক্ত কথা প্রথম উচ্চারণের, শোনানোর এবং শোনারও। এদিক থেকে সাক্ষাৎকারটির নিশ্চয়ই মূল্য রয়েছে।

তারপর শুরু হয় আমার অন্য এক জার্নি। প্রিয়ভাষিণীই বীজ বুনে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে আমার তালাশ উপন্যাস লেখার সূচনা।  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা