× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নারীমুক্তির সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রামকে একসঙ্গে বেঁধে ফেলতে হবে

সিমোন দ্য বোভোয়ারের সাক্ষাৎকার

সালেহা চৌধুরী

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৯:০৯ পিএম

আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:১২ পিএম

নারীমুক্তির সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রামকে একসঙ্গে বেঁধে ফেলতে হবে

প্রথমে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল তা হলো বোভোয়ারের কথা, কাজ ও কাজের ভেতরের পার্থক্য নিয়ে। সেকেন্ড সেক্স তেইশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন অল্প কিছুদিন আগে বোভোয়ার নারীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছেন এবং সক্রিয়ভাবে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, নারীর মুক্তির জন্য সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। তার মতে, নারীকে ঘিরে স্বাধীনতার কাজকারবার আইন দিয়ে এবং সংস্কার দিয়ে বাঁধা হয়েছে। ফলে নারী অধিকার আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সমাজ বদলে যাওয়ার কথা ভাবছে সবাই। তাই একে সমর্থন করা প্রয়োজন। তবে মনে রাখতে হবে, সোশ্যালিজম সবটা করতে পারবে তা মনে হয় না। সমাজবাদ সবকিছুর সমাধান নয়। ইস্টার্ন ব্লক-এর দেশগুলোয় যেভাবে সমাজবাদ কাজে লাগানো হয়, সেটা সবকিছুর উত্তরও নয়। যদিও নানাভাবে সমাজবাদে কী উৎপাদন হয়, তা দেখলে জানা যাবে পূর্ব ও পশ্চিম ব্লকের নারীদের সুযোগ-সুবিধার ভেতর, পূর্ব ও পশ্চিমে খুব বেশি পার্থক্য নেই।

ফেমিনিজম বা নারীবাদ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়ে গেছে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : সেকেন্ড সেক্সের শেষ পর্বে আমি বলেছি আমি নারীবাদী নই। আমার মতে নারীর এ সমস্যা ধীরে ধীরে একটা ইভুলেশনের মতো ভেতরে ভেতরে ঠিক হয়ে যাবে। আমি যদি বলি, আমি নারীবাদী, তাহলে আমাকে নারীদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে জানতে হবে। যাকে বলা যায় নারীদের দাবি। যা কি না আমাদের সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি। আমি কেবল নারীদের নারীবাদী বলব না, অনেক পুরুষকেও নারীবাদী বলা যায়। অনেক পুরুষ যুদ্ধ করছেন নারীর অবস্থা বদলাতে। এটা শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত। একে মেনে নেওয়া বা এসব কিছু মেনে নেওয়ার এবং প্রতিবাদ করার ভেতরে আছে নারীবাদিতা। আমি নারীবাদী সেই অর্থে। এখন আমি বুঝতে শিখেছি এ পরিবর্তন আমাদের জন্য দরকার। সমাজবাদ নিয়ে যেসব ভাবনা তারও আগে আসবে নারীবাদের ভাবনা। জানতে হবে নারীর কঠোর কঠিন নিয়ম আসলে কী। আমার মনে হয়েছে আমরা যাকে সোশ্যালিস্ট দেশ বলছি, সেখানেও নারী-পুরুষের সমান অধিকার নেই। তখন মনে হয় নারীদের দাবি তাদের নিজেদের আদায় করতে হবে। সে কারণে নারীদের মুক্তির সংগ্রামে আমি নিজেকে জড়াই না। কারণ আমি খুব গভীরভাবে বিষয়টি বুঝতে চেয়েছি। ফরাসি দেশের বামপন্থি আন্দোলনে, সেখানেও দেখা যায় নারী-পুরুষের জীবনযাপন প্রণালির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। নারী সেখানে ছোটখাটো, বোরিং নানান কিছু, এবং মনোযাগ না দেওয়ার মতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আর পুরুষ বড় বড় কথা বলে, নানানরকম রচনা বা আর্টিকেল লেখে, অনেক মজার বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। তখন এই যে নারীমুক্তি নিয়ে বড় বড় কথা বলা হয়, নানাভাবে নারীজাগরণের কথাও শোনা যায় সেখানেও নারী পিছিয়ে পড়ে। মনে হয় নিজেদের সমস্যা নিয়ে তাদের কিছুই বলার নেই। সব বলবে পুরুষ। কাজেই ওইসব আন্দোলনে পৃথিবীকে মুক্ত করবার আন্দোলনে, নারীর যেন কিছু বলার নেই। বামপন্থি পুরুষরা দেখা যায় নারীদের প্রতি বেশ শত্রুতামূলক কাণ্ডকারখানা করে বসে। তারা তখন নারীদের বিদ্রুপ আর বকাবকি করে। প্রথম নারীদের আন্দোলন হয়েছিল ভিনসেনজে। একদল পুরুষ একটা ঘরের ভেতর ঢুকে চিৎকার করে বলছিলÑ ক্ষমতা থাকে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগে। তারা তখন নারীদের মনে করিয়ে দেয় তাদের পুরুষাঙ্গের ক্ষমতার কথা। ওরা নারী, স্বাধীনভাবে কিছু করবে, তা সহ্য করতে পারে না।

 

এই যে নতুন নারীবাদিতার কথা বলা হয়, সেখানে আপনার ভূমিকা কী? তাদের এসব কথাবার্তায় মনে হয় পুরুষ সে সময় যে ভূমিকা নিয়েছে তাতে নারী যে অনেক দূর যেতে চায়, তা মেনে নিতে পারে না।

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আপনি জানেন যে অন্তত আমেরিকায় এ ঘটনা বেশ এগিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেটি ফ্রিডম্যানের স্কাম-এর কথা মনে পড়ে গেল। S C U M কথাটির অর্থ সোসাইটি ফর কাটিং আপ ম্যান। ফ্রান্সে আরও কিছু আছে। সেখানে আরও নানান প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আমি বলব নারীমুক্তির সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রামকে একসঙ্গে বেঁধে ফেলতে হবে। নারীমুক্তির এ সংগ্রাম নারীর একার নয়। এখানে পুরুষের ভূমিকা আছে। অনেক সময় তারা এ সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেয়। আমি মনে করি নারীমুক্তির এ সংগ্রামে পুরুষকে পরিহার করবার কোনো মানে নেই।

 

আপনি কি মনে করেন এ সংগ্রাম কেবল একটি গ্রুপ বা একটি দলের ব্যাপার; না বেশিরভাগ নারী এ সংগ্রামে থাকবে?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : নারী সংগ্রামের এটি একটি স্টেজ। পুরুষকেও এ দলে টানতে হবে। যদিও এতে কী হতে পারে, তা ভেবে নিতে হবে। পুরুষের স্বভাব কমান্ড করা বা কিছু চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাকে আমাদের বুঝতে হবে। আর এ কারণে নারী নিজেকে ইনফেরিওর বা পুরুষের চেয়ে নিজেদের ছোট মনে করতে পারে। তারা সবটা বলতে পারে না, কখনও লজ্জায় মনের সবকিছু প্রকাশ করতে পারে না। অনেকে পুরুষের সামনে তারা কী পেতে চায় তা খোলাখুলি আলোচনা করতেও পারে না। তারা বুঝতে চেষ্টা করে, যেসব পুরুষের সঙ্গে তারা জীবন ভাগ করে নেয়, তাদের কাছ থেকে দূরে যেতে হবে কি না। তারা চায় ওইসব পুরুষের থেকে মুক্ত হতে। নিজেকে মুক্ত করতে এবং তাদের যে জোর করে একটা সীমার ভেতরে রাখার চেষ্টা করা হয়, সেটা থেকেও তারা মুক্তি চায়।

 

নারী ও পুরুষ একসঙ্গে একটা গ্রুপ হয়ে সবকিছু আলোচনা করতে পারে না? পুরুষকে সরিয়ে দিয়ে চিন্তা করা এটা এক ধরনের রাজনীতির বিষয়। ওরাই তো কোনো সিস্টেম বা নিয়মের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা নানাভাবে নারীকে যন্ত্রণা দেয়, তখন নারী কি মনে করে তাদের প্রধান শত্রুই হলো পুরুষ?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : মার্কস মনে করেন এই পুঁজিবাদী সমাজে তারাই ভিকটিম। মনে করা ভালো কতগুলো সিস্টেমই কিছু মানুষের কারণে কঠিন অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপ নেয়। তখন এই নারী-পুরুষের বিভেদের কারণে পুরুষকেও দোষ দেওয়া হয়। কারণ সিস্টেম যা-ই হোক, এখানে কেউ লাভ করবে আর কেউ ভিকটিম হয়ে যাবে। যদিও এসব নিয়মরীতি আপনি নিজে তৈরি করেননি। এ সময়ে কোনো পুরুষ পার্টয়ারকাল বা পুরুষতন্ত্র তৈরি করেনি, তবে এটা চলছে এবং পুরুষ তার সুবিধা নিতে চায়। পুরুষ এর নিন্দা বা সমালোচনা করতে পারে এবং একে হজমও করতে পারে। আমরা এ নিয়মের সমালোচনা করতে পারি। তার পরও পুরুষের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে চলা আমাদের উচিত হবে না। আমাদের সবকিছু তারা গ্রাস করে নেবে, এমন ভাবাও ঠিক নয়। যদি দেখা যায় পুরুষও নারীবাদিতায় সায় দেয়, তার পরও ভাবতে হবে, আমাদের সমস্ত সম্ভাবনা তারাই শাসন করবে, কন্ট্রোল করবে এবং নারীকে শাসন করতে তারা তাদের সীমা লঙ্ঘন করবে। যখন দেখা যায় পুরুষ বেশ দরদি মনোভাব নিয়ে নারীর জন্য নানান কিছু ভাবছে, তার পরও আমাদের দূরে থাকতে হবে, তাদের পিতৃতন্ত্র থেকে সাবধান থাকতে হবে। তাদের জন্য ইকুয়ালিটি বা সমতা মঞ্জুর করা মেনে নেওয়া যাবে কি? তাদের এ সমতা দেওয়ার দয়াকে মানতে হবে, মনে করতে হবে তারা এক বিশেষ শ্রেণির, তারও কোনো মানে নেই। নারীকে সমতায় আনতে একই রকম জীবনযাপন তৈরি করে নিতে হবে।

 

আপনি কি কখনও পুরুষের এ সমতা দেওয়ার অধিকার মানেন? আপনি কি পুরুষকে ঘৃণা করেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : না। আমি পুরুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারি। আমি জানি অনেক নারী যারা আর একজন নারীর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, তারা পুরুষকে যে সবসময় ঘৃণা করে তা নয়। তারা বিচক্ষণতা দেখাতে পছন্দ করে। এক ধরনের মনোভাব যা অন্য একজনকে সবসময় খেয়ে ফেলতে পারে এমনটাও কিন্তু নয়।

 

আপনার কি মনে হয় নারীরা রাজনীতির ক্ষেত্রে আরও দূর এগিয়ে যাবে?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : এমন হতে পারে। তবে মনে হয় কিছু নারী আমাদের সমাজের নারী কাঠামো একেবারে বদলে দিতে চাইবে। তারা চাইবে পুরুষ ছাড়া সবকিছু করতে। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ পুরুষের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারে। তখন কিছু নারী কিছু পুরুষের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারে মানে নারীর পুরুষের মতো কাজের ক্ষমতাকে মেনে নেওয়া।

 

নারীবাদীদের ঝগড়ায় কিছু হোমো সেক্সুয়াল ঘটনা ঘটতে দেখা যেতে পারে। নারীতে নারীতে এক ধরনের যৌন সম্পর্ক। আপনার কি মনে হয় নারীতে নারীতে এ যৌনমিলন পুরুষকে আমাদের চাই না, এমন ঘটনা থেকেও হতে পারে? এটা কি একটা রাজনীতি?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আমি এভাবে ভাবিনি। যদি এমনটা হয়, তাহলে মনে করতে হবে কিছু নারী ভয়ানকভাবে নারী অবকাঠামোর পরিবর্তন চায়। এমন হলে তারা হয়তো বহুগামিতাকে এই জাগরণের ভেতর থেকে বের করে দেবে। তাদের যৌনাঙ্গ নিয়ে ভাবনা, কী হতে পারে, না পারে এবং নারী তার এ চাহিদা নিজেরাই মেটাতে পারে, এমন সব অদ্ভুত ভাবনা একেবারে বোরিং এবং বিরক্তিকর, বাজে, অশ্লীল।

 

যদি নারী বলে পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কই অত্যাচারের আর এক রূপ তাহলে কী হবে? যদি বলে এ কারণেই তারা এসব থেকে দূরে থাকবে তাহলে ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : এটা কি ঠিক নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক মানেই অত্যাচার? এটা খারাপ? সবসময় নয়। মনে হয় এ সম্পর্ক থাকবে তবে এর মধ্যে যতটা অত্যাচার তা বন্ধ করতে হবে। এমন ভাবনাÑ নারী-পুরুষের সব যৌন সম্পর্ক বা মিলনই ধর্ষণ, আমি তা মেনে নেব না। এমন ভাবনা আমাকে আঘাত করে। আমি এমন কিছু বিশ্বাস করি না। তাহলে কি বলতে হবে, পুরুষের যৌনমিলন এক ধরনের তলোয়ারবাজি? তাহলে যাকে অত্যাচার মনে হয় না, নারী-পুরুষের এমন কোনো সম্পর্ক নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।

 

আপনি কথা বলেছিলেন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে। আপনি সেকেন্ড সেক্সে বলেছিলেন এসব নারীবাদীর ধারণা সবসময় আপনাকে স্পর্শ করেনি। বলেছেন এটা অনেক সময় নিরপেক্ষ নয়। এমন একটি ব্যাপার সবসময় ঠিকও নয়। আপনি কি কখনও মনে করেন একজন নারী তার যাতনাময় জীবন থেকে পালাতে পারে? যদি এ পালানো তার চাকরি জীবন নিয়ে এবং অন্যদের ক্ষেত্রে নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি নিয়ে হয়?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : একেবারে পলায়ন? না, আমি এমন মনে করি না। আমার ভেতরে যে নারী আছে তার কাজ তো আমাকে করতেই হবে। তবে আমি বেশ লাকি বলব নিজেকে। নারীর নানান যাতনাময় এবং তাদের কম্পালসারি কাজ থেকে আমি দূরে থেকেছি। যেমন সন্তান উৎপাদন, বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম। তবে আমার সময়ে নারীর এসব নিয়ে পড়াশোনা বা কথা বলা খুব একটা হয়নি। তখন নারীর কাজ কতটা বা একজন নারী কতটা করবেন, সে নিয়ে তেমন কোনো সময় বা নীতি নির্ধারিত হয়নি, মানে এমন যে হতেই হবে তা ভাবা হয়নি। মনে হয় আমাকে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবে দেখানো হয়েছে এবং ওইভাবেই আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার মতো একজন কৃতকার্য নারীকে বেশ মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে। এখন অনেক নারী পড়াশোনা করছে, এতে পুরুষ ভাবছে নারী তাদের সব জায়গা নিয়ে নিল। আমি যা বিশ্বাস করি হয়তো আপনি তা করেন না। নারী যে কেবল বিয়ে করবে এবং সন্তান উৎপাদন করবে এটা ঠিক নয়। একটি সুখী জীবনের জন্য এসবের কি খুব দরকার? অনেক নারী তার দাসত্ব জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে অন্যভাবেও সুখী হতে পারে।

 

আপনি বলেছেন আপনার জীবনের বড় সাফল্য সার্ত্রে।

সিমোন দ্য বোভোয়ার : হ্যাঁ। ঠিক তাই।

 

তবে আমরা জানি আপনার জীবনের বড় অর্জন আপনার ব্যক্তিস্বাধীনতা। নারী ও পুরুষের সমতার জীবন বা সমান অধিকারের জীবন প্রতিষ্ঠিত করা বেশ কঠিন। আপনি কি তা স্বীকার করেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : করি। তবে আমার ও সার্ত্রের ভেতরে এমন কোনো গোলমাল ছিল না। তিনি নারীদের দমন করতেন না। আমার যদি ওকে ছাড়া অন্য কাউকে পছন্দ হতো, ও তা নিয়ে গোলমাল করত না। আমি কিছু নারীকে জানি স্বামীর এ মনোভাব থেকে তারা বেরিয়ে আসতে কেউ কেউ বেশ একটু সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে পুরুষের সঙ্গে। আবার কেউ পুরুষের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য সম্পর্ক তৈরি করে। আমাদের জীবন ঠিক তেমন নয় যেমনটি আমরা চাই। তার ফলেই এসব হয়।

 

আপনি নারীদের অভ্যন্তরীণ বা ভেতরের ক্লাস বলে মনে করেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আমি ক্লাস বলি না। বলি কাস্ট। সেকেন্ড সেক্সে বলেছি তারা বেশ একটু নিচু জাতের কাস্ট বা জাত বলে বিবেচিত হয়। এ জাত হলো সেই ব্যাপার। আপনি এর ভেতরেই থাকবেন এবং এর ভেতর থেকে বেরোতে পারবেন না। আর যদি ক্লাস বলা যায় তাহলে বলতে হবে সেটা এত বেশি কঠিন নয়। তবে একজন নারী সে চিরকালই নারী। কখনও সে পুরুষ হতে পারবে না। তার ফলে আপনি তখন হয়ে যান নারী জাতি। তারপর রাজনীতি, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবনে তাকে এমনভাবে দেখা হয় মনে হবে আপনি পুরুষের চাইতে নিচু জাতের একজন।

 

আপনি পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজবাদীদের ঝগড়া কীভাবে মেলান?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : মনে হয় না হুট করে এর একটা উত্তর আমি দিতে পারব। এখনও জানি না আমাকে কী করতে হবে। এটা এমন একটা বিষয়Ñ পুঁজিবাদ ও নারীবাদ এ দুই ইস্যু নিয়ে আমাকে অনেক ভাবতে হবে। অনেক কিছু মাথায় রাখতে হবে। এখন এ বিধিব্যবস্থার ভেতরে নারীর জন্য যে যাতনা তার চেহারা একরকম নয়। নারী যে কাজ করে সেখানে কোনো বিশেষ আয়ের ঘটনা ঘটে না। এটা শ্রমিকদের কাজের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এ দুই শ্রেণির কাজের ভেতরে মিল কোথায়। কাজেই নারী কী করবে, কতটা করবে এটা নির্ভর করছে এ দুই বিষয়ের সমন্বয়ের ওপর। কেউ কেউ বাইরে কাজ করেন। তারা তাদের কাজের মূল্য পান না। আর যে নারী বাড়িতে কাজ করেন, কিছু পান না তাদের দুজনের কাজের চেহারা আলাদা।

 

যে নারী বাইরে কাজ করে সে কি পুরুষের সমান বেতন পায়? একই রকম কাজ, নারীর বেতন কম। পুরুষের বেতন বেশি।

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আপনি ঠিকই বলেছেন, নারী-পুরুষ কখনও সমান বেতন পায় না; যদিও তারা একই ধরনের কাজ করে। এটা কোনো বইয়ে ভালোভাবে পড়ানো হয়নি। আমি কেট মিলেট ও জারমেন গ্রিয়ারের ফায়ারস্টোন খুব ভালোভাবে পড়েছি। তেমন কিছু পাইনি।


ওনারা নতুন কিছু আনেননি। বিশ্লেষণ করে তেমন কিছু পাওয়া যায় না।

সিমোন দ্য বোভোয়ার : ঠিক। মিলেট বা গ্রিয়ার নতুন কিছু বলেননি। ফায়ারস্টোন কেবল ডায়ালেকটিকস অব সেক্সে নতুন কিছু বলেছেন। তারা যেটা করেছেন সেটা আর কিছু নয়। তারা নারীমুক্তির সঙ্গে শিশুদেরও নানান প্রসঙ্গ এনেছেন। কথা সত্যি! নারীমুক্তি হয়তো তখনই আসবে যখন শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব সুন্দরভাবে সমাধা হবে। আর শিশুরাও বড়দের অহেতুক মাতব্বরি থেকে মুক্তি পাবে।

 

মে ৬৮-এ আপনি বেশ একটু কঠিনভাবে ক্লাস বা শ্রেণি সমস্যার ভেতরে আত্মনিয়োগ করেন। আপনি এজন্য রাস্তায়ও নেমেছেন। আপনি এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তখন যৌন সমঝোতা বা সমতা বা শ্রেণিগত সমাধান দেখতে পেয়েছিলেন কি?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমার ভূমিকা এখানে কী হতে পারে। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম নারীর মুক্তি এই শ্রেণিসমতায় সব উত্তর দেয় না। সেই মাওবাদ বা ট্রটস্কিবাদ বা কমিউনিজম সবখানেই নারীদের ছোট করে দেখা হয়েছে। বুঝতে পেরেছিলাম নারীদের নারীবাদী হতেই হবে, না হলে সমাধান কোথায়? এখানে দেখেছি নারীর কাজ ও পুরুষের কাজের ভেতর চিরকালই বৈষম্য থাকে। কখন নারীমুক্তি খানিকটা উন্নত হতে পারে তা-ও বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। ঠিক কী করলে নারীর মুক্তি সত্যিই সম্ভব হবে, তা বুঝতে পারিনি। মনে হয় এ কাজ এখনও ঠিকভাবে সমাধা হতে বাকি আছে। তখন জেনেছি, পুরুষশাসিত সমাজে নারী কতখানি মুক্ত হতে পারে! পরিবার থাকবে এবং সমস্যাও থাকবে। মনে হয় পরিবারের গঠন কতটা উন্নত হতে পারে। চীনেও নারীর অধিকারের উন্নতি তত বেশি হয়নি। জমিদারি প্রথার এই ভয়াবহ নিয়মকানুন বদলাতে হবে। নারীমুক্তি কীভাবে আসতে পারে। আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারি না নারীমুক্তি কতটা সম্ভব। তখন মনে হয়েছে পরিবার ও নারীর জীবন হয়তো নতুন কোনো ধ্যানধারণায় বদলে যেতে পারে।

যদি নারীবাদিতা কোনো বড় কিছু চায় বা দাবি করে, তাহলে হযতো নারীমুক্তির কথা, এ নিয়মরীতিকে বিপন্ন করতে পারে। এ নিয়ে বড় কোনো সমাধানের কথা আমরা জানি না। উৎপাদন বা নারীর ক্ষমতায়নÑ এমন একটা ব্যাপার, যা বুর্জোয়া সমাজে সম্ভব। এই যে ভোটাধিকার সেখানেও নারী পিছিয়ে আছে। এখানে অর্থনীতির পরিবর্তন নিয়েও ভাবতে হবে। মানুষজন মার্কসিস্ট ফরমুলা নিয়ে ভাবছে, যদি সোশ্যালিজম বা সমাজবাদ খানিকটা সঠিক পথ ধরে তবেই হয়তো নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা ভাবা যেতে পারে। যখন আমি সেকেন্ড সেক্স লিখি সেটা বামপন্থিরা ঠিক বুঝতেও পারেনি, ঠিকভাবে নিতেও পারেনি। কিছু ট্রটস্কিবাদী বলেছিলেনÑ নারীর এই সমস্যা যা বিশাল কিছু মনে করা হয়, আসলে এটা একটা মিথ্যা আন্দোলনের ব্যাপার। তারপর যদি সত্যিকারের বিপ্লব হয় তখন হয়তো নারী তার সঠিক জায়গা পেতে পারে।

তখন অনেক কমিউনিস্ট এ আন্দোলন নিয়ে হাসিতামাশা করেছে। তারা তখন তাদের রচনায় বা আর্টিকেলে লিখেছিল বিলান কোর্ট এ বিষয় নিয়ে ভাবেও না। নারীদের অধিকার নিয়ে একবারই এসব প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, উই গিভ এ ড্যাম। অ্যাবাউট হট। যখন এ আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে তখন হয়তো নারীর কিছুটা উন্নতি হবে। প্রশ্ন এইÑ তবে নারীর ভাগ্য কি এ আন্দোলনের পর ঠিক হবে?

 

সেকেন্ড সেক্স শেষ হওয়ার পর সবাই বলেছিল আপনি তো তেমন কোনো পথ বলেননি। কোনো ট্যাকটিসও দেননি। কেবল এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।

সিমোন দ্য বোভোয়ার : এটা সত্যি। আমি তেমন কোনো পথ বাতলে দিইনি, যাতে নারী খুব তাড়াতাড়ি উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারে। আমি কেবল আশা করেছিলাম সোশ্যালিজম বা সমাজবাদ একটা কিছু করবে।


আর এখন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : এখন আমি কিছুটা বদলে গেছি। আমি চুপ করে কেবল রেভুলিশন এবং সোশ্যালিজম নিয়ে বসে নেই।

 

নারীমুক্তির জন্য কী ধরনের সম্ভাবনা আপনি দেখতে পান? ব্যক্তি নারী ও সমবেত নারী নিয়ে আপনি কী ভাবেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : ব্যক্তি নারীর জন্য আমি বলব তাকে কাজ করতে হবে। যদি সম্ভব হয় বিয়ে না করা। আমি যদি চাইতাম সার্ত্রেকে বিয়ে করতে পারতাম। এখন মনে হয় বিয়ে না করে আমরা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছি। যখন কোনো নারী বিয়ে করেন, তখন মনে করা হয় তিনি বিবাহিত। একটা লেবেল এটে চলতে হয় তাকে। মেয়েটিও মনে করে সে বিবাহিত। আর সমাজেও তখন সে একজন মার্কমারা বিবাহিত নারী। তার অনেক ডুস অ্যান্ড ডোন্টস থাকে। আমার মনে হয় বিয়ে একজন নারীর জন্য ভয়ানক।

এসব বলার পরও বলব, তবে বিয়ে করবারও যুক্তি আছে। যদি বাচ্চাকাচ্চা চায় তাহলে তো বিয়ে করা ভালো। যেসব বাবা-মায়ের বিয়ে হয়নি, তাদের সন্তান পৃথিবীতে এলে নানান প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়। যদি স্বাধীনতা চাও তাহলে উচিত হবে বিয়ে না করা। কাজ কর, নিজের মতো থাকো। এ উপদেশ আমি সব নারীকে দিয়ে থাকি। তারপর বিয়ের পর যখন দরকার ডিভোর্স নিতে পারো। কারণ একসময় নিজেকে জানা বা নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন আসতে পারে। তবে কাজই একজন নারীর সবকিছুর সমাধান নয়।

 

যাদের বিয়ে হয়েছে বা সন্তান আছে তাদের কী অবস্থা?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আমার মনে হয় কোনো কোনো নারীর এ ব্যাপারে আর কোনো কিছু করবার নেই। একজন নারীর বয়স যদি হয় ৩৫ এবং তার যদি চারটি সন্তান থাকে তাহলে নারীমুক্তির সব পথ বন্ধ। আমার মনে হয় সেসব নারীরই মুক্তির কথা বলা যাবে বা তাদের মুক্তির দরকার, যদি সত্যিই এ সমাজে তাদের কিছু দেওয়ার থাকে।

 

তাহলে যেসব নারী মুক্তির কথা ভাবছেন তারা কি একা থাকবেন বা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকবেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আমার মতে, তারা সমবেত হয়ে থাকবেন। আমি এখনও তা করিনি। কারণ আমি জানি না এমন কোনো দলের কথা, যাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারি। তবে সেকেন্ড সেক্স লেখার পর যে প্রচার হয়েছে সেটাই বিরাট কাজ। আমি বইটা লিখেছিলাম, কারণ আমার আশা ছিল এ দিয়ে নারীদের একটা কিছু হবে। ও দিয়ে আমি অন্য নারীদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। ওদের বলেছিলাম জানো এবং বোঝো তোমাদের অবস্থা।

আমি এ বই লেখার পর অনেক চিঠি পেয়েছি। সবাই বলেছে এ বই তাদের অনেক সাহায্য করেছে। ওরা সংগ্রাম করতে শিখেছে, ওরা ডিসিশন নিতে চেয়েছে। আমি খুব সাবধানে ওদের চিঠির উত্তর দিয়েছি। ওদের অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি। চেষ্টা করেছি ওদের কষ্টের সময় পাশে দাঁড়াতে।

 

এই যে নারীদের জীবনের ইভুলেশন আস্তে আস্তে উন্নতি বা মুক্তি সেটা আপনি কীভাবে দেখেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : এই ধীরে ধীরে জেগে ওঠা বা বিদ্রোহ আরও দীর্ঘদিন ধরে অগ্রসর হবে। পৃথিবীর আর সব দেশের মতো ফ্রান্সের নারীরাও খুবই কনজারভেটিভ। ওরা চেষ্টা করে মেয়েলি হতে। এখন যন্ত্রপাতির যুগে নারী অনেক কিছু পেয়েছে, যা দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সমাধা করতে পারে। তবে তারা বিদ্রোহ করতে শিখে গেছে। কিন্তু যতদিন পুরুষের কাজের সুরাহা না হবে ততদিন তারা ভালো কাজ পাবে না। এটা হলো ক্যাপিটালিস্ট কান্ট্রির নিয়ম। যদি কেউ এমন নিয়ম করে যতদিন নারী ঠিকমতো কাজ পাবে না ততদিন পুরুষকেও কাজ দেওয়া হবে না, তাহলে হয়তো কিছুটা উন্নতি হতে পারে। যেমন ছাত্রছাত্রীরা নানান কারণে ধর্মঘট করে, তেমন করে তাদের ধর্মঘট করতে হবে, কাজের জন্য এবং অন্য সবকিছুর জন্য। তারপর সারা দেশে দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট চলতে থাকবে। ওরা যদি কাজের ভেতর যেতে পারে, তাহলে অনেক কিছু বদলাতে পারবে। অনেক জায়গা, যেমন ফ্রান্স বা ইউরোপে নারীদের জন্য খুব বেশি কাজ থাকে না।

 

এখন এই সংগ্রাম কোন জায়গায় বা স্টেজে আছে?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : সবকিছু একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। যখন নারী ফাক্টরিতে ধর্মঘট করে তারা জানে পোস্টারে তারা কী লিখছে। ওরা তাদের শক্তির কথা জানে।

 

আপনার কি মনে হয় এ সংহতি আরও জেগে উঠুক, আরও উন্নত হোক?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : মনে হয় ব্যক্তিগত মুক্তির চিন্তা সবকিছু নয়। আমাদের সমবেতভাবে কাজ করতে হবে এবং শ্রেণিসংগ্রাম, তাকেও সঙ্গে রেখে। যারা নারীমুক্তির জন্য সংগ্রাম করে তারা অনেক নয়। তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে বামপন্থিরদেরও। কারণ সমাজতন্ত্র নারী-পুরুষকে যদি একতা বা সমতা না এনে দেয় তাহলে কিছুই হবে না। ইতিহাসে প্রথম দেখা গেছে নারীদের সংগ্রাম বা আন্দোলন এভাবে হয়নি। তারা বিশ্বাস করে নারীর সবকিছু বদলাতে গেলে সমাজ বদলাতে হবে। আমি একবার স্লোগানে শুনেছিলামÑ কোনো সংগ্রামই নারীমুক্তিকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। সংগ্রাম করে নারীমুক্তি আনতে হবে।

 

সেকেন্ড সেক্সে আপনি রিমবোকে কোট করেছেন। যিনি একটা কোটেশনে বলেছেন, ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে নারীমুক্তির। আপনার কি সেই নতুন পৃথিবী নিয়ে কোনো ধারণা আছে? নতুন পৃথিবী বলতে আপনি কী বোঝেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : রিমবো কল্পনা করেন যখন নারী পুরোপুরি মুক্ত হবে তারা এ পৃথিবীর জন্য নতুন কিছু আনবে। আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যদি তাদের মধ্যে একতা আসে তাহলে মানবিক গুণাবলির প্রসার হবে বা নারীর মূল্যবোধ বদলে যাবে। ওনারা বলেন তখন পুরুষোচিত গুণাবলি মেয়েদের হবে। আমি অবশ্য তা মনে করি না। পুরুষোচিত গুণাবলির কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি কালচার, সভ্যতা আন্তর্জাতিকতা; প্রলেতারিয়েত যেমন করে। বুর্জোয়া শ্রেণিতে মাতব্বরি বিশ্বাস করে না। তেমনি করে নারীকে নিতে হবে তার ক্ষমতা, যেমন করে পুরুষ ক্ষমতা গ্রহণ করে। এখানেও কখনও দেখা যায় কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না, এবং একদল আরেক দলের ওপর চোখ রেখেছে।

আন্তর্জাতিকতা বিশ্বাস করতে গেলে একটা আন্তর্জাতিক অঙ্কের নিয়ম থাকতে হবে। মনে হয় অনেক জায়গায় নারী যে পারবে সেটা তারা মেনে নেয়নি। মনে হয় এই আন্তর্জাতিক শব্দটি উচ্চারণ করার সময় তারা এক পেশিবহুল নারী কল্পনা করে। তাদের পুরুষালি শক্তি, পেশি এসব থাকতে হবে। খুঁজতে হবে ভেজালটা কোথায়। নারী এটা পারবে সে কথা মানে না তারা। তবে পুরুষশাসিত সমাজকে আমরা কীভাবে অস্বীকার করব, কারণ এ পৃথিবী তো আমাদের।

আমার বিশ্বাস স্বাধীন নারী পুরুষের মতো অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারে। তবে তারা কি নতুন কোনো মূল্যবোধের ধারণা আমাদের দেবে? তাদের আর সবকিছু জানার আগে তাদের নারীত্ব বিষয়টি যে কী তা জানতে হবে। আমি অবশ্য নারীত্বকে বারবার অস্বীকার করেছি। আমি ঠিক বিশ্বাস করি না যে স্বাধীন নারী পুরুষ আর মেয়েদের নতুন সম্পর্ক তৈরি করবে। নারী ও পুরুষ তখন হয়তো বদলে যাবে। যদি নারী সত্যি সত্যি একজন মানুষ হয়, তাহলে হয়তো কিছু একটা হতে পারে। পুরুষ ও নারীতে যে পার্থক্য তা মেনে নেওয়াই ভালো।

 

আপনি কি নারীদের মুক্তির প্রয়োজনে তাদের সহিংস হওয়াকে ঠিক বলে মনে করেন।

সিমোন দ্য বোভোয়ার : বর্তমানে যা চলছে তাতে মনে হয় আমি বলব সহিংস হতে পারে। কখনও কখনও পুরুষই তো নারীদের সঙ্গে নানান কথাবার্তায় সহিংস হয়ে ওঠে। তারা নারীদের আক্রমণ করে। ধর্ষণ করে। অপমান করে। তারা তাদের আক্রমণ করে। এ কারণে নারীদের রক্ষা করার জন্য তাদেরও সহিংস হতে হয়। অনেকে এ কারণে ক্যারাতে শেখে বা অন্য কোনো প্রতিরোধ করার কথা জানে। কাজেই শরীর রক্ষা করতে তারা যদি সহিংস হয় কে তাদের দোষ দেবে।

 

আপনি মাঝে মাঝে আমেরিকান নারীদের কথা বলেন। আপনার কি ওদের সঙ্গে অনেক জানাশোনা আছে?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : আমি প্রথমত ওদের জানি বই থেকে। এমন অনেক আছে। যেমন কে মিলার, জি গ্রিয়ার। তারা অবশ্য আমেরিকান ফায়ারস্টোন নয়। আমি ওদের কিছু বই পড়েছি যা ফরাসি নারী এখনও লেখেননি। ওনারা আমাকে আমেরিকা যেতে আমন্ত্রণ করেন। তখন আমি উত্তর দিইÑ আমি এখন ফরাসি নারীদের নিয়ে কাজ করছি। ঘরের কাজ আগে।


আপনি তো নিজেকে মনে করেন একজন নারী মিলিটারি, কাজেই ভবিষ্যতের জন্য কী ভাবছেন?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : একটা প্রজেক্টে আমি একদল নারীর সঙ্গে কাজ করছি। এ ছাড়া কোনো দিন কোনো নারীর প্রতি কোনো অপরাধ হলে সেটা নিয়ে আমরা নানান কাজ করি। প্রথম দুই সেশনে আমরা মেটারনিটি, জন্মনিরোধ বটিকা, গর্ভপাত নিয়ে কথা বলেছি। এরপর কিছু নারী মানে এক ডজন নারী নিয়ে এসবের খোঁজখবর করব। এখানে নানান বায়োলজিবিশারদ, সমাজবিদ, মানসিক রোগীর ডাক্তার, ডাক্তার, দাই এদের সহায়তায় নানান কিছুর অনুসন্ধান করি। ওরা যে নারী এবং এ কারণে ভুগছে সেটা নিয়েও কথা বলি। তারপর কথা বলা হয় নারী আর কোন উপায়ে সন্তান উৎপাদন করতে পারে। তাদের মা হয়ে ওঠার যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিয়েও কথা হয়। তারপর মায়েরা যখন কাজ করে তাদের শিশুদের জন্য খেলার ব্যবস্থা করা। যেন শিশুর জন্ম মায়ের হাতে থাকে। হুট করে কেউ যেন সন্তান সম্ভাবনায় না পড়ে। আমরা উৎসাহ দিই কে মা হতে পারবেন-না পারবেন বা কে চাইবেন বা চাইবেন না। জোর করে সন্তান উৎপাদনের মেশিন তাদের বানানো যাবে না।

 

মেয়েদের সংগ্রাম এবং গর্ভপাত অনেক সময় একই কারণে হয়। আপনি কি এর চেয়ে বেশি কিছু করতে চান?

সিমোন দ্য বোভোয়ার : অবশ্যই। মেয়েদের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমি আরও নানান কাজ করি। আমরা কেবল বিনা পয়সার গর্ভপাতের জন্য সবকিছু করি না। আমরা জন্মনিরোধ বটিকা দিয়ে থাকি, এসব নিয়ে অনেক কিছু আলোচনা করি, এরপর অ্যাবরশন নিয়েও কথা বলি। জন্মনিরোধ এবং গর্ভপাত নারীদের একটু মুক্তির পথ দেয়। তারপর যেসব নারীর কাজ নিয়ে নানাভাবে তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করা হয় তা নিয়েও কথা বলি। এরপর অন্যান্য দিনে তাদের যেন নানাভাবে কাজে লাগানো না হয় বা নানাভাবে ব্যবহার করা না হয় সেসব নিয়েও কথা বলি। 

 

[সিমোন দ্য বোভোয়ারের এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়া জার্নালে, ১৯৭২ সালে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এলিস শোয়ার্জার]

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা