আমিরুল আবেদিন
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৩:১৮ পিএম
১৮৮৯ সাল।
সেন্ট রেমি প্রদেশের সেন্ট পল দে মুসোলি মানসিক হাসপাতালে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ ভর্তি
হলেন। জন্মগত প্রতিভা বলতে যা বোঝায়, ভিনসেন্টকে ঠিক তা বলা যাবে না। শিল্পকর্ম সম্পর্কে
তার অগাধ জ্ঞান ছিল। কিন্তু অস্তিত্বসংকট তাকে সব সময় বিচলিত রেখেছে। পল গগ্যার সঙ্গে
কিছুদিন থাকার পর তিনি একিউট ম্যানিয়ায় আক্রান্ত হন। মাঝে মধ্যে মানুষের কণ্ঠস্বর তাকে
শঙ্কিত করে। মাঝে মধ্যে অদ্ভুত হ্যালুসিনেশন তাকে পাগল করে তুলতে চায়। এই অদ্ভুত কণ্ঠস্বরের
ফিসফিসানি সহ্য করতে না পেরে একদিন নিজের একটি কান কেটে ফেলেন। জীবন তাকে বিষণ্নতা
ছাড়া কিছুই দেয়নি। সে জন্য তুলির আঁচড়ে যে পথ গড়ার ক্লান্তিকর প্রচেষ্টা তার, সেখানেও
বিষাদের গাঢ় রঙ। সুস্থতার জন্যই মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুরুতে
ভেবেছিলেন মার্সেই শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত পাবলিক ইনস্টিটিউশনে যাবেন। পরে মত বদলালেন।
যদি শেষ মুহূর্তে মত না বদলাতেন, তাহলে পুরো পৃথিবী ভয়ংকর সুন্দর একটি চিত্রকর্ম দেখার
সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো।
সেন্ট রেমিতে
ভ্যান গগ বাদে আরও ৪১ জন মানসিক রোগী ছিলেন। রোগীদের যেন কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়
তা নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন চিকিৎসক থেকে শুরু করে নিম্নপদস্থ কর্মীরা। রোগীদের
মধ্যে ভ্যান গগ কিছুটা ব্যতিক্রমই। কেমন যেন শান্তশিষ্ট। তবে তাকে দেখলে একটি কথাই
মাথায় আসে, বিষণ্নতার মোড়কে আবদ্ধ কেউ। কয়েকদিন এই অদ্ভুত রোগীকে পর্যবেক্ষণের পর তারা
বুঝলেন ভ্যান গগ এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত। এ ছাড়াও তিনি এমন এক মানসিক রোগে আক্রান্ত,
যাকে আধুনিক মনোরোগের ভাষায় বাইপোলার ম্যানিয়াক এপিসোড বলা হয়। তারা বুঝলেন, এই রোগীকে
সুস্থ করতে হলে ছবি আঁকার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। শিল্পই তার জীবনীশক্তি।
কিন্তু এ জন্য তো বিশাল খরচের ব্যাপার। ভ্যান গগের চিকিৎসার দায়ভার নিয়েছিলেন তার ভাই
থিও।
রাতের গাঢ়
অন্ধকারে থমথমে পরিবেশ খান খান হয়ে যায় রোগীদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে। তাদের সামাল দিতে
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন হাসপাতালের কর্মীরা। ব্যতিক্রম ওই ভ্যান গগের রুমটি। কেউ নজর
দিলে দেখবে, নিবিষ্টমনে ভ্যান গগ ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে ধরে রাখা তুলিটা
উদ্যত, যেকোনো মুহূর্তে একটি আঁচড় বোলানোর বিন্দুটি খুঁজে খুঁজে হয়রান যেন- তবু ভ্যান
গগের মুখ অবিচলিত। জেগে থাকলে এক মুহূর্তও সে অপচয় করত না। মদ্যপানের বদভ্যাসটা গেছে।
নারীসঙ্গের কু-অভ্যাসটি থাকার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, খাওয়া-দাওয়ায় যে অনিয়ম করতেন
তা আর হচ্ছিল না। মানসিক হাসপাতালে কাটানো একটি বছর তাকে সুস্থ করে তুলছিল। সুযোগ পেলেই
তিনি ছবি আঁকতে বসে যেতেন। আর একবার বসলে তার খুব বেশি সময় প্রয়োজন হতো না। কয়েক ঘণ্টার
ব্যবধানে ল্যান্ডস্কেপের ছবি এঁকে শেষ করতেন। জীবনে এই প্রথম একাকিত্ব তার জন্য ইতিবাচক
পরিবর্তন নিয়ে আসে। চিত্রকর্ম থেকে অন্যমনস্ক হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় নিজের সবটুকুই
ঢেলে দিতেন ক্যানভাসে। যেকোনো চিত্রশিল্পীর ক্ষেত্রেই বিরল ঘটনা। অবশ্য ভ্যান গগ ব্যতিক্রমী
শিল্পী। ৩০ বছর বয়সে প্রথম তুলি ধরেছিলেন। পরবর্তী চার বছরে তিনি চিত্রকর্মের নিজস্ব
এক ধরন তৈরি করে নেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ওই এক বছরে ভ্যান গগ অন্তত ১৫০টি তৈলচিত্র
এঁকেছিলেন। এই ১৫০টি তৈলচিত্রের মধ্যে সবগুলো কালের পরীক্ষায় টেকে থাকেনি। কিন্তু একটি
তৈলচিত্র ভ্যান গগকে অবিস্মরণীয় করে তোলে।
ভিনসেন্ট হকুসাইয়ের
‘দ্য গ্রেট
ওয়েভ’ চিত্রকর্মের
পাড় ভক্ত ছিলেন। ‘স্টারি নাইট’ ছবি আঁকার
সময় যে আকাশ এঁকেছেন ওই আকাশে হকুসাইয়ের ঢেউয়ের প্রভাব অনেকেই খুঁজে পান। তবে ছবিটি
আঁকার বিষয়ে ভ্যান গগ তার ভাইকে লেখা এক চিঠিতে জানান- ‘ভোরের অপেক্ষা
করছিলাম আমি। সূর্য ওঠার তখনও অনেক সময় বাকি। আকাশে শুকতারা তখনও জ্বলজ্বল করছে। এত
বড় শুকতারা আমি কোনোদিন দেখিনি।’ অনেক দিন ধরেই ওপরতলায় তার ঘর থেকে
যতটুকু আকাশ দেখা যায় তার একটি ছবি আঁকার পরিকল্পনা করছিলেন। ডজনখানেক ছবি এঁকেও ফেলেছিলেন।
কিন্তু এবার আঁকলেন রাতের আকাশের ছবি। এতদিন রাতের আকাশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারছিলেন
না। ছবি তো আঁকতেন দিনে- স্মৃতির ওপর ভর করে যতটুকু আঁকা যায়। এবার আর দিনের অপেক্ষা
নয়। তুলি হাতে এঁকে ফেললেন ‘স্টারি নাইট’। ‘স্টারি নাইট’-এর ক্যানভাসে
আলপাইলস পর্বত থেকে দৃশ্য তির্যকভাবে হেলে নিচে নামছে। পাইনগাছ, গমের ক্ষেত কিংবা জলপাইয়ের
বাগানগুলো তাই ভীষণ ছোট দেখায়। সেই তির্যক বাঁকের ওপর গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে ফুটিয়ে তোলা
নীল এক আকাশ, তবুও সময়টা রাত। অনেক বিশ্লেষক এই ছবিতে মেডিটেরিনিয়ান অঞ্চলের চিত্রকর্মের
মিল খুঁজে পান। তির্যক বাঁকে ল্যান্ডস্কেপকে ছোট করা এবং রঙের ব্যবহার মৃত্যুর প্রতীকী
অর্থ বহন করে। আলপাইলস পর্বত আর ভূপৃষ্ঠের পাইনগাছ যেন আকাশ ভেদ করে স্বর্গ ও মর্ত্যের
সংযোগ স্থাপন করে চলেছে। কিন্তু ভ্যান গগের এই চিত্রকর্মের মূল আকর্ষণ ওই এক আকাশ।
রঙ দিয়ে এমন এক আকাশ আঁকলেন, যাকে ধরাছোঁয়া সম্ভব নয়। ওই আকাশে এক চাঁদ আছে। তার সমান্তরালে
শুকতারা আরও বেশি জ্বলজ্বলে। আকাশের মাদকতা আমাদের কল্পনায় যেমন রূপ নেয়, ঠিক তেমনটাই
আঁকলেন। বাস্তবের সঙ্গে মিল নয়, ভোর এবং শেষরাতের গাঢ় অন্ধকারের এমন সমন্বয় আধুনিক
চিত্রকর্মের পথ সুগম করে। মোটা তুলির দাগে আঁকা চোখ ধাঁধানো ওই আকাশ এখনও মানুষকে মুগ্ধ
করে। চিত্রকর্ম তাকে মুক্তি দিয়েছিল। ফিসফিসানি সুরকে নীরব করেছিলেন ছবি এঁকে। ছবিটি
নিয়ে একবার মন্তব্যও করেছিলেন, তারা আর মাথার ওপর অসীম আকাশের দিকে খোঁজ রাখলে কেউ
কি দিশেহারা হতে পারে! সেটাই তো! না হলে কে ভেবেছিল- ক’দিন আগেও যে
লোক টার্পেন্টাইন রঙ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন, ওই একই রঙ ব্যবহার করে তিনি
এক মাদকতাময় আকাশ এঁকে ফেলবেন?