প্রদর্শনী
মীর রবি
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৩ ১২:০৪ পিএম
আপডেট : ০৪ মে ২০২৩ ১২:০৪ পিএম
লক্ষ্মীকান্ত
বিশ্বাস কর্তৃক প্রচলিত পাঁচালি গানের ভিন্ন আঙ্গিক দান করেছিলেন কিংবদন্তি নাট্যকার
সেলিম আল দীন। যে গান একসময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন আখ্যানের বিষয়বস্তু হয়ে পরিবেশিত
হতো, সেই গানকেই মানব আখ্যানে অন্য এক রূপ দেন তিনি। নাট্যরূপে তারই উজ্জ্বল উদাহরণ
পাঁচালিজাত নাটক ‘প্রাচ্য’। প্রাচ্য
নাটকে উঠে এসেছে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবনাখ্যান।নাট্যকারের বয়ানে তাদের সংস্কার
ও সংস্কৃতির চিত্র নিগূঢ় বাস্তবতায় ধরা দিয়েছে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে সমাজের শাসক বা
ধনিকশ্রেণি কর্তৃক নিম্নশ্রেণির মানুষের শোষণ ও নির্যাতনের চিত্রও। বাদ যায়নি নিম্নশ্রেণির
মানুষের সৌন্দর্যবোধ, ক্ষোভ, ক্ষমার প্রেক্ষাপটও। নাট্যরূপে সেলিম আল দীন বাংলার এই
প্রাচীন লৌকিক সংগীতকে যেভাবে লোকজ জীবনাখ্যানে নাগরিক জীবনে প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল,
ঠিক সেভাবেই যেন শিল্পের অন্য এক আঙ্গিকে আবারও প্রাসঙ্গিক করে তুললেন শিল্পী তামিমা
সুলতানা। তামিমা সুলতানার শিল্পিত চোখ ও রঙতুলির আঁচড়ে জীবন্ত রূপ পেয়েছে প্রাচ্য নাটক।
চিত্রভাষায় ‘প্রাচ্য ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ প্রদর্শনী
তারই উদাহরণ হয়ে থাকবে।
নোলক-সয়ফরের বিয়ের ঘটনা দিয়ে সেলিম আল দীনের প্রাচ্য-এর নাট্য-কাহিনী শুরু হয়েছে। বাংলার চিরপরিচিত গ্রামীণ আবহে ফাল্গুনের এক শেষরাতে নোলক ‘নাক-চোখের মিলিত পানিতে’ স্বামী হিসেবে সয়ফরকে কবুল করে। এখানে নাট্যকার অসাধারণভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিয়ের দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। আঞ্চলিক ভাষায় বর্ণনার মাধ্যমে দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করেছেন নাট্যকার। এসব ঘটনাবৃত্তান্ত, আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সমাজ মূর্ত হয়ে ওঠে। ঠিক একইভাবে শিল্পী তামিমা সুলতানা চিত্রভাষায় তা তুলে ধরেছেন। তার প্রতিটি চিত্রকর্মে প্রাচ্যের নাট্য-কাহিনী চিত্রায়িত হয়েছে লোকজদৃশ্যে।
শিল্পী তামিমা সুলতানা নাট্যকার সেলিম আল দীনের শিল্পতত্ত্ব ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ আত্মস্থ করে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী জীবন ও তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন চিত্রকলায়। শিল্পীর রঙ, রেখা ও চিত্র কাঠামোয় সয়ফর ও নোলকের মাধ্যমে জীবন ও মৃত্যুর অভেদ্য দর্শন, অভেদাত্মরূপ, সৌন্দর্যবোধ ও প্রকৃতির সঙ্গে একীভূতিকরণে প্রাচ্যের শাশ্বত বাণী তুলে ধরেছেন সচেতনভাবে। শিল্পসত্তায় দৃশ্যায়িত ৪ পর্বে বিভক্ত এই প্রদর্শনীতে শিল্পী দেখিয়েছেন মানব জীবন, শ্রেণিশোষণ, বঞ্চনা, যৌনতা, ভালোবাসা, লোভ, ক্ষমা ও অন্ধকারের প্রকৃতি এবং সাপের বিচিত্র সৌন্দর্য। চিত্রভাষ্যে এসব দৃশ্যকল্প তুলে ধরতে শিল্পী মিক্সড মিডিয়া ও অ্যাক্রেলিক এই দুই মাধ্যমই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ৫৬টি চিত্রকর্মের মধ্যে মিক্সড মিডিয়ার কাজই বেশি।শিল্পীর কাজ দেখে মনে হবে অ্যাক্রেলিক বা শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের থেকে মিক্সড মিডিয়াতে কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। মিক্সড মিডিয়ার আধিক্য থাকলেও তা শিল্পের মূল পাঠ থেকে কোনো ধরনের বিচ্যুতি ঘটায়নি। বরং তা আরও উজ্জ্বলতর ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে রঙের সামঞ্জস্য ব্যবহারে। মানব অবয়ব চিত্রায়ণে শিল্পীকে এস এম সুলতানের চিত্রকলা দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়। প্রতিশোধের নেশায় মত্ত সয়ফরের চিত্রে শিল্পী পেশিবহুল ও সুঠাম দেহের পুরুষ অবয়ব এঁকেছেন। বংশপরম্পরায় লাঠিয়াল সয়ফরের এমন রূপ প্রকৃতার্থে সেদিকটাই ইঙ্গিত করে।বলার অপেক্ষা রাখে না চিত্রের বিষয় হিসেবে হাজির করিয়েছেন প্রাচ্য নাটকের সয়ফর-নোলকের জীবন আখ্যান। এই আখ্যানের মাধ্যমে তিনি নিম্নবর্গের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন।
চিত্রভাষায়
‘প্রাচ্য ও
দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে দৃশ-১ থেকে দৃশ্য-৪ ঘুরে দেখা
যায় শিল্পী তামিমা সুলতানা শুধু চিত্রই আঁকেননি, চিত্রকলার পাশাপাশি তিনি প্রাচ্য নাট্য-কাহিনীর
বিভিন্ন দৃশ্যকল্পের বয়ানও বর্ণিত করেছেন। কিছু কিছু চিত্রতে প্রাচ্যের কথ্যরূপও দৃশ্যায়িত
হয়েছে লিপিভাষ্যে। তার চিত্রভাষায় বাংলার লোক-সংস্কৃতি, ইতিহাস, লোক-বিশ্বাস ও লোকজের
সরল জীবনকথা সরলভাবেই রেখাবদ্ধ হয়েছে। এসব চিত্রকর্মে বাঙালির হাজার বছরের গ্রামীণ
জীবনাচরের রূপ পরিস্ফুটিত হয়েছে দেশীয় চিত্র ভঙ্গিমায়। ঠিক যেমন অগ্রজ শিল্পী কাইয়ূম
চৌধুরী তাঁর চিত্রকলায় বৃহৎ বাংলার রূপ ধরেছিলেন, ঠিক তেমনি প্রাচ্যের চিত্রভাষ্যে
তামিমা সুলতানাও বৃহৎ বাংলাকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন।চিরায়ত বাংলার নারী-পুরুষের
যে গড়ন, গ্রামীণ অবকাঠামো, জীবনযাপনের উপকরণ ঠিক সেভাবে ধরা দিয়েছে তার চিত্ররেখায়।
এ ক্ষেত্রে শিল্পী আফজাল হোসেনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘শিল্পী তামিমা
সুলতানা সাম্প্রতিক ‘প্রাচ্য ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ প্রদর্শনীতে
যে সকল চিত্রকলা উপস্থাপন করেছেন তা ভাবনা, অনুভবের বিচারে বিশেষ। সেলিম আল দীন, তাঁর
রচনা, বোধ-বিবেচনার মধ্য থেকে রস, রঙ গ্রহণ করে সংলাপ, দৃশ্যসমূহকে মুখর চিত্রকলায়
রূপদান অনন্য ঘটনা।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করা যায় যে,
সেলিম আল দীনের মহাকাব্যিক নাটক প্রাচ্যের দৃশ্যপট, সংলাপে যেভাবে চিত্রকল্পের দেখা
মেলে তারই সবিস্তার দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে শিল্পী তামিমার চিত্রভাষ্যে। নাট্য-কহিনীর সয়ফরের
জমি বন্ধকের টাকায় কেনা শাড়ি, নোলকের উষ্ণ নারী শরীর, কাল-সাপের দংশন, সয়ফরের ভিটে-মাটি
খুঁড়ে সাপের খোঁজ করা, হন্তারক সাপের মুখোমুখি হয়ে সাপকে হত্যা না করাসহ প্রতিটি চিত্রকল্পই
চিত্রকলায় রূপ পেয়েছে স্বমহিমায়। শিল্পী তামিমা সুলতানা ‘প্রকৃতির সৌন্দর্য,
হিংস্রতা ও স্বাভাবিকতার অধিকারে আপন বিবরে চলে যায়’ বলে যে প্রকৃতিচেতনা
রয়েছে তারই পক্ষে নিজের চিত্রভাষ্য দাঁড় করিয়েছেন প্রাচ্যের দ্বৈতাদ্বৈতাবাদে। ঢাকার
আর্ট গ্যালারি কলাকেন্দ্রে ২৮ এপ্রিল শুরু হওয়া একক প্রদর্শনীতে এমন চিত্রই দেখা যায়
শিল্পীর শিল্পকর্মে। প্রদর্শনীটি শেষ হয় ৩ মে।