× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অনুবাদ গল্প

একটি ইনকা শোকগাথা

ফজল হাসান

প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:০৩ পিএম

আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:৩৪ পিএম

একটি ইনকা শোকগাথা

একটি ইনকা শোকগাথা

আমি একটা দলকে নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলাম, যেখানে ইনকা জাতির শেষ মানুষরা বাস করত। সেই এলাকায় বনের মধ্যে ইনকা নারীরা সবচেয়ে সুন্দরী, যা সব সময় দেখা যায়। সে সময় আমি সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে এসেছি। তবে আমার জন্য সেনাবাহিনী ভালো ছিল। কিন্তু সেখানে অল্প সময়ের জন্য আমাকে নিষ্ঠুর করে তুলেছিল।

আমি যখন মার্কিন দলটি নিয়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ইটের তৈরি বাড়ি দেখতে পেয়েছি। বাড়িটি ছিল সেই জায়গায়, যেখানে আমি পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম। আমি কড়া নেড়েছি এবং একসময় ভেতরে প্রবেশ করেছি। লোকজন সেখানে কেচুয়া১ ভাষায় কথা বলছিল। আমি সেনাবাহিনীতে থাকার সময় কেচুয়া ভাষা শিখেছি। আমি পর্যটকদের দেখিয়েছি কীভাবে শেষ ইনকারা বাস করে। এখানে মাচু পিচুতে ঠিক একই রকম একটি ঘর ছিল। এক কোণে ছিল তাদের শাকসবজি এবং অন্য কোণে ঐতিহ্যবাহী চুলা। ঘরের উঁচুতে তাদের শুকনো ফল ও খড় ছিল। এ ছাড়া তাদের কক্ষগুলোয় চাতাল ছিল। আমি তাজ্জব হয়েছিলাম, তারা এসব ছোট কক্ষে কেমন করে বাস করত। সেখানে তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই ছিল।

পর্যটকদের আশপাশ ঘুরিয়ে দেখানোর সময় আমি লক্ষ করেছি, এক কোণে একজন ইনকা মহিলা। ইটের তৈরি বাড়িটি তার। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং একটা শুকনো ফলের খোসা ছাড়াচ্ছিলেন। তার চোখেমুখে এক ভয়ংকর দুঃখবোধ জমে ছিল। কোনো এক অদৃশ্য কারণে তার সেই অভিব্যক্তি আমার হৃদয় ফুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। আগেই বলেছি, আমি কেচুয়া ভাষায় কথা বলতে পারি।

আমাদের উপস্থিতিতে কি আপনার মন খারাপ হয়েছে?’ আমি তাকে বললাম।

না।

কিন্তু তার পরও মহিলার মুখমণ্ডলে দুঃখবোধ রয়ে গেছে।

আমরা যদি কোনো কারণে আপনাকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে আমি এখনই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনাকে দুঃখ দেওয়া আমাদের আদৌ কোনো ইচ্ছে নেই।

আপনারা আমাকে অপমান করেননি।

পর্যটকদের মধ্যে কেউ কি আপনাকে কিছু বলেছে?’

না।

কেননা তারা যদি আপনাকে অপমান করে, তাহলে এক্ষুনি আমি তাদের বলব এবং তারা এসে আপনার কাছে ক্ষমা চাইবে।

তারা আমাকে অপমান করেনি।

হয়তো আপনার এই একান্ত পরিবেশে আমাদের উপস্থিতি এক ধরনের অপমান। যদি তাই হয়, তাহলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

তখনও তার চোখের ভেতর অপরিমেয় দুঃখ জমে ছিল। আমি অনুভব করতে পেরেছি এবং তা আমার হৃদয় দ্বিখণ্ডিত করেছে। আমি আমাদের ভ্রমণ কাজ চালিয়ে যেতে পারিনি। তিনি এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তার দুঃখ ছিল এক শতাব্দীর ওজনের মতো ভারী। তার মন খারাপের কারণ কী হতে পারে, সেই চিন্তা আমার মনের ভেতর তোলপাড় করছিল। চিন্তাটা আমাকে কিছুতেই সুস্থির থাকতে দেয়নি।

এমন কী হয়েছে, যা আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে? আপনি কি অসুস্থ? আপনি যদি অসুস্থ হন, তাহলে আমাকে বলুন। আমার সঙ্গে সব ধরনের ওষুধ আছে। আপনি সব ওষুধ রাখতে পারেন।

আমি অসুস্থ নই।

তবে কি আপনার টাকাপয়সা লাগবে? আমার কাছে বেশি নেই, কিন্তু যা আছে, আপনি ইচ্ছে করলে সবটুকুই নিতে পারেন।

টাকাপয়সা নয়।

হয়তো আপনার পরিবার। আমি যদি কিছু করতে পারি, তাহলে আমাকে শুধু বলবেন।

ধন্যবাদ। পরিবার নয়।

তখনও আমার মস্তিষ্ক দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। আমি কক্ষটি দেখার জন্য তাড়াহুড়া করি। একসময় তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং তার দুঃখের সমস্ত বেদনা তার চোখ থেকে অলৌকিকভাবে আমার অস্তিত্বের গভীরে ঢুকে পড়ে। ঘটনাটি আমার হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছে। জানি না কেন।

মহিলা একটি কথাও বললেন না। তারপর যেন তিনি কোনো এক কঠিন সংগ্রাম পেরিয়ে এসেছেন। বললেন,

যে কারণে আমার মধ্যে দুঃখ বাসা বেঁধেছে, তা হলো আমার কখনই কোনো সন্তান হবে না।

কেন নয়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। ‘অবশ্যই আপনি সন্তানের মা হতে পারবেন। নিজের দিকে তাকান, আপনি সুন্দরী এবং যুবতী।

তিনি আমার কথায় তার চোখ দিয়ে আমাকে পরিমাপ করলেন।

আপনি কি এ গ্রামে কিছু লক্ষ করেছেন?’

গ্রামের অনেক কিছুই আমার নজরে পড়েছে, তার পরও তিনি অনবরত মাথা নাড়ছিলেন।

কোনো পুরুষ মানুষ নেই,’ তিনি বললেন।

আমি বিষয়টা আমলে নিইনি, তবে লক্ষ করেছি। কথাটা সত্য। গ্রামে একজনও পুরুষ মানুষ নেই।

তারা কোথায়?’

তারা শহরে কাজ করতে গেছে। যেসব পুরুষ মানুষ শহরে যায়, তারা কখনই ফিরে আসে না।

কথাটা আমি শুনেছি। আমি জানতাম না কেন এ বিষয়টি তাকে সন্তান জন্ম দিতে বাধা দিচ্ছে।

দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি একজন পুরুষ,’ আমি আবেগের সঙ্গে বললাম। ‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারি। আমি আপনাকে এখনই বিয়ে করব। আমরা সন্তান জন্ম দিতে পারি।

তিনি আমাকে একটা লম্বা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপহার দিলেন। তার তাকানোর ভঙ্গি ছিল উদ্বেগজনক। যখন তিনি আমার দিকে তাকালেন, আমি নিজেকে প্রায় ছায়া হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সময় ম্লান অনুভব করি। আমি জানি না ঘটনাটি কীভাবে ঘটল। তার আগে, সেনাবাহিনীতে থাকার সময়, আমার মধ্যে নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে এক ধরনের শক্তিশালী অনুভূতি ছিল। আমি জানতাম আমি কে। কিন্তু তার চোখের তারায় তৎক্ষণাৎ অনুভব করলাম, আমার আত্মপরিচয় বিলীন হয়ে গেছে। আমি জানি না কেন।

আপনার নাম কী?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

আমি তাকে আমার তিনটি নাম বললাম। মুখে হালকা হাসির প্রলেপ মেখে তিনি নিচু স্বরে আমার তৃতীয় নামটি উচ্চারণ করেন।

আপনার শেষ নাম থেকে আমি বলে দিতে পারি আপনার ধমনিতে স্প্যানিশ রক্ত রয়েছে।

বিষয়টি সত্য। প্রপিতামহ থেকে আমার দেহে সামান্য পরিমাণে স্প্যানিশ রক্ত আছে।

আমাদের আলোচনার মধ্যে এ বিষয়ের কোনো প্রভাব আমি দেখতে পাইনি।

আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারি না,’ তিনি এমন ভাবে দৃষ্টি ওপরের দিকে তুলে বললেন, যেন তিনি তার ইটের তৈরি বাড়ির ছাদ গলিয়ে পাহাড়ের গায়ে উজ্জ্বল কিছু একটা দেখতে পেয়েছেন।

কেন নয়? আমি একজন পুরুষ মানুষ।

আপনি আমার রক্তের নন। আপনার রক্ত পরিশুদ্ধ নয়। আমি কেবল তাকেই বিয়ে করতে পারি, যার ধমনিতে ইনকা রক্ত রয়েছে।

কিন্তু কেন?’

এভাবেই চলছে। হাজার বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে।

কিন্তু আপনাদের সব পুরুষ চলে গেছে। তারা শহরে আছে। আপনি নিজেই বলেছেন তারা শহরে গেলে আর ফিরে আসে না।

আমি জানি।

আমি একজন পুরুষ। আমাকে বিয়ে করুন এবং সন্তান জন্ম দিয়ে মা হোন। আপনার দুঃখ হাওয়া হয়ে যাবে।

তিনি প্রথমবারের মতো হাসলেন। কিন্তু হাসিটা তার দুঃখের চেয়েও আরও বেশি দুঃখজনক ছিল।

আমি পারব না। এভাবেই চলছে। হাজার বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে।

তাহলে আপনি কী করবেন? আপনি কোনো সন্তান চান না, নাকি আমার মতো কারও সঙ্গে সন্তান চান? আপনি কি একটু ছাড় দিতে পারবেন না?’

আমি পারব না,’ তিনি বললেন।

তারপর তার কাঁধ সামান্য নড়েচড়ে ওঠে এবং আমাদের আলাপ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ছিলেন খুবই সুন্দরী রমণী। সেখানে আমি কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থেকেছি। একসময় আমার মনে হয় আমাদের মাঝে অদৃশ্য পর্দা নেমে এসেছে। এটা ছিল পাহাড়ের গায়ে রাত নেমে আসার মতো। আপনি যখন পাহাড়ি পথে হাঁটছেন, তখন রাত আচমকা এসে হাজির হয়। পরের মুহূর্তে, যদি অসাবধান হন, আপনি পাহাড়ের প্রান্ত কিনারে হাঁটবেন। এভাবেই আমাদের মাঝে রাত উপস্থিত হয়েছিল। তিনি আমাদের মধ্যে যে পর্দা টেনে দিয়েছিলেন, তা বিদীর্ণ করে আমি তাকে আর দেখতে পাইনি।

আমি তড়িঘড়ি ভ্রমণের সমাপ্তি ঘোষণা করি। আমরা যখন ফিরে আসছিলাম, তখন আমি তাকে বিদায় জানাই। তিনি তখনও এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং নড়াচড়া করেননি। তিনি আমার বিদায় জানানোর বিপরীতে কোনো জবাবও দেননি।

এ ঘটনা আমি কেন আপনাকে বলছি? জানি না। কিন্তু মাচু পিচুর এ ঘরটি সেই ঘরের মতো, যেখানে আমরা ছিলাম। ঘরটি আমাকে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তার দুঃখের সমস্ত শক্তি আমার কাছে ফিরিয়ে আনে। এখন আমি তা অনুভব করতে পারি।

অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমরা আমাদের ভ্রমণ অব্যাহত রাখব। আমি এখনই ফিরে আসছি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা