নাজমুল হক তপন
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:৩৮ পিএম
হুমায়ূন আহমেদ
ক্রিকেট খেলা বুঝতেন না, কিন্তু পাগলের মতো ক্রিকেট পছন্দ করেন, এমন কথা প্রায়ই বলতেন জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। এটা কীভাবে সম্ভব? এক সাংবাদিক জানতে চান লেখকের কাছে। উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ক্রিকেটে এক ওভারে ছয়টি বল করা হয়। বল করা মাত্র গল্প শুরু হয়। নানান সম্ভাবনার গল্প। ব্যাটসম্যানকে আউট করার সম্ভাবনা, ছক্কা মারার সম্ভাবনা, শূন্য পাওয়ার সম্ভাবনা। ছয়টি বল হলো ছয়টি সম্ভাবনা গল্পের সংকলন। এবার বুঝেছ? আরও বললেন, পৃথিবীতে কবিদের একটা বড় অংশ ক্রিকেট পছন্দ করে। কারণ কবিদের কাজ হচ্ছে ছন্দ নিয়ে। ক্রিকেট ছন্দময় বলেই কবিদের পছন্দের খেলা। খেলাধুলা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের আসক্তি আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই। তার অনেক লেখায়ই এসেছে খেলাধুলার প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোনো ম্যাচ থাকলে, সব কাজকর্ম বন্ধ রেখে খেলা দেখতেন।
দেশের কোনো ব্যাটসম্যান চার-ছক্কা মারলে কিংবা কোনো বোলার উইকেট পেলে শিশুদের মতো হাততালি দিতেন, আনন্দে লাফালাফি করতেন। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের খেলা ভীষণ পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ। সাকিবকে একটা বইও উৎসর্গ করেন হুমায়ূন আহমেদ। বইটির নাম ‘ফাউন্টেনপেন’। উৎসর্গপত্রে লেখেন, ‘ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই তরুণকে চিনি না। কিন্তু মুগ্ধ হয়ে তার ক্রিকেট খেলা দেখি।’ হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর এ প্রসঙ্গে সাকিব বলেন, ‘হুমায়ূন স্যারের বই উৎসর্গ আমার জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। স্যারের সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। স্যারকে বলতে চাই, জোছনারাতের তারা হয়ে যদি কোনো দিন তিনি আমাকে দেখতে পান, নিশ্চয়ই শুনবেন আমার কথাটাও। স্যার, আমি সাকিব। আপনার লেখার একজন ভক্ত।’ কেন ফাউন্টেনপেন বইটি সাকিবকে উৎসর্গ করার জন্য নিলেন, তাও প্রকাশককে জানান হুমায়ূন আহমেদ। বলেন, ‘সাধারণ বলপয়েন্ট কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে আর লেখা যায় না। কিন্তু ফাউন্টেনপেনের কালি শেষ হয়ে গেলে কালি ভরে আবার লেখা যায়। সাকিব হচ্ছে আমাদের ফাউন্টেনপেন। সবাই থেমে গেলেও সাকিব থেমে যায় না। ছেলেটা অদম্য, অফুরন্ত।’ সাকিবের জন্য একটি ধাঁধাও দেন হুমায়ূন আহমেদ। তার ভাষায়, ‘সাকিবের জন্য ধাঁধা। আচ্ছা ক্রিকেট কেন ১১ জনের খেলা? ১০ কিংবা ১২ জনের নয় কেন?’ বোধকরি এর উত্তরটা খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
সাকিব দলে থাকলে বাংলাদেশ পরিণত হয় ১২ জনের দলে। আর সাকিব না থাকলে? দুজন কম নিয়ে খেলার চাপ অনুভব করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার গৌরব অর্জন করে ২০১১ সালে। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ ঘিরে আপ্লুত হয়ে পড়েন হুমায়ূন আহমেদ। জার্সির অর্ডার দেন। গ্রুপ পর্বে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলেন মাঠে। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচটিতে একটা পর্যায়ে হারের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এ চাপ আর নিতে পারছিলেন না তিনি। কাউকে না বলেই মাঠ থেকে ফিরে আসেন। ম্যাচে শেষ পর্যন্ত জেতে বাংলাদেশ। এ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ যা লিখেছিলেন তার মূল কথা হলো, ম্যাচের শেষ পর্যন্ত তার মাঠে থাকা উচিত ছিল। দর্শক হিসেবেই তিনি এ চাপ নিতে পারেননি। তাহলে প্লেয়ারদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়? বিশ্বের যে প্রান্তেই গেছেন, সেখানেই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার ক্রিকেটপ্রেম কোন মাত্রার তা অনুধাবন করার জন্য একটা একটা উদাহরণই যথেষ্ট। স্মরণ করা যাক ‘দেখা না-দেখা’ বইটি। মূলত বিদেশে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে বইটি লেখা। দলবলসহ সুইজারল্যান্ডের রুখতেনস্টাইন শহরে হুমায়ূন আহমেদের অবস্থানকালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যাচ ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। বাকিটা দেখা না-দেখা বই থেকে হুবহু উদ্ধৃত করা হলো : শুটিংয়ের শেষে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। আমি ঘোষণা দিলাম, আগামীকাল অফ ডে। আমরা কোনো শুটিং করব না। হাসানের মুখ শুকিয়ে গেল। শুটিং অফ মানে আরেক দিন বাড়তি থাকা। বাড়তি খরচ। বাড়তি টেনশন। আমি হাসানকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, তুমি টেনশন করো না। আমরা এক্সট্রা কাজ করে আগামীকালের ক্ষতি পুষিয়ে দেব। আগামীকাল কাজ করবেন না কেন? আগামীকাল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা। আমি ক্রিকেট খেলা দেখব। কাহীন বলল, ক্রিকেট খেলা দেখা যাবে না। কেন দেখা যাবে না? কাহীন বলল, এখানকার কোনো বাঙালির বাড়িতে ডিশের লাইন নাই। খরচের ভয়ে তারা ডিশ লাইন নেয় না। আমি বললাম, রেস্টুরেন্টগুলোতে খেলা দেখার ব্যবস্থা নাই? সুইসরা ক্রিকেট ভক্ত না। তারা ফুটবল ছাড়া কোনো খেলা দেখে না। আমি হাসানের দিকে ফিরে বললাম, তোমার দায়িত্ব কাল আমাকে খেলা দেখানো। হাসান বলল, অবশ্যই। পাঠকরা ভুলেও ভাববেন নাÑ আমি ক্রিকেটের পোকা, কে কয়টা ছক্কা মেরেছে, কে কতবার শূন্যতে আউট হয়েছে, এসব আমার মুখস্থ। আমি শুধু বাংলাদেশের খেলা থাকলেই দেখি। অন্য খেলা না। বাংলাদেশের কোনো খেলা আমি মিস করি না। ঐ দিন আমার সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ। বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় যখন চার মারে, আমার কাছে মনে হয় চারটা সে মারেনি। আমি নিজে মেরেছি। এবং আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
বাংলাদেশের কোনো বোলার যখন কঠিন বল করে, তখন আমার মনের ভাব হচ্ছে- ‘বলটা কেমন করলাম, দেখলিরে ছাগলা? কলজে নড়ে গেছে কি-না বল? আসল বোলিং তো শুরুই করিনি। তোকে যদি আজ পাতলা পায়খানা না করাই, আমার নাম হুমায়ূন আহমেদই নয়। আনন্দে চোখে পানি আসার মতো ঘটনা, আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। যে কবার বাংলাদেশ ক্রিকেটে জিতেছে, প্রতিবারই আমার চোখে পানি এসেছে। বাংলাদেশি ক্রিকেটের দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। তারা চোখভর্তি পানি নিয়ে আসার মতো আনন্দ একজন লেখককে বারবার দিচ্ছেন। পরম করুণাময় এইসব সাহসী তরুণদের জীবন মঙ্গলময় করুক, এই আমার শুভকামনা। ক্রিকেট খেলা দেখার কোনো ব্যবস্থা হাসান করতে পারল না। তাকে পরাজিত ও বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। সে আমাদের বাসে করে নিয়ে গেল জুরিখে। জুরিখে অনেক বাঙালি। তাদের কারো বাসায় স্টার স্পোর্টস কিংবা ইএসপিএন তো থাকবেই। কাউকে পাওয়া গেল না। আমরা পাবে পার্কে ঘুরতে লাগলাম। সাধারণত পার্কগুলোতে খেলা দেখানো হয়। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।’ অনেক ঘুরে শেষ পর্যন্ত একটা অস্ট্রেলিয়ান পাবে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের খেলা দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর জন্য ওই পাবের মালিককে অনেক অনুরোধ করে রাজিও করাতে হয়েছিল। ক্রিকেট আর বাংলাদেশের তারুণ্যকে এক করে দেখতেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড বিশ্বকাপের খেলা। খেলা ঢাকায়। সস্ত্রীক মাঠে গেলেন। স্টেডিয়াম এলাকায় অনেকেই রঙতুলি নিয়ে ঘুরছে। হুমায়ূন আহমেদ স্ত্রীকে বললেন, আমার বাঘ সাজতে ইচ্ছে করছে। তোমার আপত্তি আছে? স্ত্রীর কাছ থেকে সম্মতিও পেলেন। কিন্তু তিনি বাঘ সাজার পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন। স্ত্রী এর কারণ জানতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বৃদ্ধ বাঘ সেজে মাঠে ঢোকার কোনো মানে হয় না। মাঠে ঢুকবে তরুণ বাঘ ও বাঘিনীরা। হুমায়ূন আহমেদের মনন-মগজ জুড়ে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট। সর্বশেষ তিনটি বিশ্বকাপে হুমায়ূন আহমেদ নেই। এই সময়ে অনেক আনন্দ-বেদনার গল্প লিখেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। জিতেছেন অনেক ম্যাচ। প্রতিটি জয়ে অলক্ষে থেকেই যেন উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলছেন, আমি জিতেছি। আমি হুমায়ূন আহমেদ। আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের গর্বের অংশ।