নাসির আহমেদ
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:০৯ পিএম
বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে প্রবলভাবে উপলব্ধি করা যায় যে তিনটি ঋতু তা হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা
আর শীত। অন্য যে তিন ঋতু অর্থাৎ শরৎ, হেমন্ত ও বসন্তের উপস্থিতি ততটা প্রবল নয়। শেষের
তিন ঋতুর একটা স্নিগ্ধতা বা কোমলতা আছে, যা নেই তা হলো তীব্রতা। তবে বাংলাদেশে প্রতিটি
ঋতুরই আলাদা সৌন্দর্য আছে। ব্যক্তিগতভাবে ভালোলাগার কথা বললে বলতে হবে, হেমন্ত, শরৎ
ও বসন্ত আমার প্রিয়। বসন্ত যেন অস্তিত্বের মর্মমূল ধরে নাড়া দিয়ে যায়।
বসন্ত বা ফাল্গুনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমর একুশের রক্তস্নাত স্মৃতিময়
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। জীর্ণ, রিক্ত, পাতাঝরা শীতের শেষে পুষ্পশোভিত দখিন হাওয়ার
আন্দোলনে আগুন রঙের বসন্ত সত্যি নব উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। শরৎ আর হেমন্তে তাতে বড়
একটা মোটা দাগের পার্থক্য চোখে পড়ে না। এক ধরনের পেলব স্নিগ্ধতার সঙ্গে কাশফুলে সেজে
ওঠা প্রকৃতি ডাক দেয় শারদ উৎসবের।
ফসলহীন হেমন্তের শূন্য মাঠ কবি জীবনানন্দ দাশের চেতনায় যতই দুঃখের
জাল বুনে যাক না কেন, না শীত না গরম এ সময়টা আমাদের বেশ লাগে। বিশেষ করে বর্ষার প্রবল
বৃষ্টি শেষে শরৎ আসে অনেকটাই যেন লাজুক তরুণীর মতো মৃদু পায়ে, আসে হালকা কুয়াশার
আমেজ ছড়িয়ে। হেমন্ত আসে শীতের আবাহনী গান গেয়ে, প্রীতিকে নতুন করে বিন্যস্ত করতে।
তাই বাংলা কবিতায়, গানে শরৎ-হেমন্তের বন্দনা খুব কম হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ঋতু
পর্যায়ের গানে শরৎ-হেমন্ত বন্দনা করেছেন দেবী দুর্গার প্রায় সমান্তরালে। সাহিত্যে
কত ভাবেই না বাংলার ষড়ঋতু বন্দিত হয়েছে বাঙালির কাব্যে, গানে আর লোকায়ত সংস্কৃতিতে।
বাংলা কাব্যের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে আছে ষড়ঋতুর বহুমাত্রিক জলছবি।
তবে দুঃখের বিষয়, এখন আর ঋতুর বৈচিত্র্য তেমন একটা চোখেই পড়ে না। বিশেষ করে কাব্যে,
সংগীতে আমরা যে ঋতুচিত্র দেখি আজকের বাংলাদেশে বাস্তবে সেই দৃশ্য নেই। কারণ আমাদের
সবারই জানা। আমরা সবাই মিলে যেন নিজেদেরই অজান্তে হত্যা করেছি আমাদের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি
আর নিসর্গকে। নিরন্তর গাছ কেটে বসতি গড়েছি প্রয়োজনের তাগিদে। অথচ একটি গাছ কাটলে
যে আরও দুটি লাগানো উচিত, সেই সত্য যেন আমরা এখানে সবাই বিস্মৃত! এখন কেউ ১০টি গাছ
কাটলেও একটি লাগায় না। এ কারণে আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ঋতুবৈচিত্র্য
হারিয়েছে স্বাভাবিক গতি। বর্ষায় বৃষ্টি নেই, অথচ অসময়ের বৃষ্টিতে বন্যায় ফসলহানি,
কৃষকের দুর্ভোগ। শীত মৌসুমে শীত নেই, আবার অকালের শীতে নষ্ট হচ্ছে ফসল।
তার পরও ষড়ঋতুর এ বঙ্গদেশে লোকায়ত সংস্কৃতিতে বেঁচে আছে আমাদের
প্রতিটি ঋতু। আমাদের সাহিত্য-সংগীতের ঐতিহ্য এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে প্রতিটি ঋতুকে। সেই
বিবেচনা থেকেই সম্ভবত এখনও এ দেশের পত্রপত্রিকা বিভিন্ন ঋতু নিয়ে বিশেষ পাতার আয়োজন
করে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এ আয়োজন সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।
শীত নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই আমাদের প্রধান তিন কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল
ও জীবনানন্দ আমাদের অবচেতনেই যেন চলে আসেন চেতনালোকে!
রবীন্দ্রনাথ তার গানে-কবিতায় এমনকি নাটকে পর্যন্ত শীতকে নানাভাবে
ব্যবহার করেছেন। কখনও শীত কুয়াশা-শিশির জড়ানো সৌন্দর্যে, কখনও বা মানুষের দুঃখকষ্টের
অনুষঙ্গে, এমনকি শিশুকিশোর পাঠ্য কবিতা লিখেছেন অনেক।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়ার আগে এ লেখার শিরোনামের
কথা বলতে হয়। জীবনানন্দ দাশ বেশ কিছু উজ্জ্বল কবিতা লিখেছেন, তারই একটি ১৯৪৪ সালে
প্রকাশিত মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থের শীতরাত।
শীতরাত শিরোনামে কবিতাটির প্রথম স্তবকেই বাক্যবন্ধুটি রয়েছে :
এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো। ...
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ শুধু নন, অবিভক্ত বাংলার প্রধান-অপ্রধান
প্রায় সব কবিরই রয়েছে শীত বিষয়ক কবিতা। সেসব কবিতা পড়লে প্রধান যে সুরটি বেজে ওঠে
আমাদের মনোলোকে, সেই সুর বেদনার, রিক্ততার, পাতাঝরার আর্তনাদের।
রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন :
‘আরম্ভিছে শীতকাল, পড়িছে নীহার-জাল,
শীর্ণ বৃক্ষশাখা যত ফুলপত্রহীন;
মৃতপ্রায় পৃথিবীর মুখের উপরে
বিষাদে প্রকৃতিমাতা শুভ্র বাষ্পজালে গাঁথা
কুজ্ঝটি-বসনখানি দেছেন টানিয়া;
পশ্চিমে গিয়েছে রবি, স্তব্ধ সন্ধ্যাবেলা,
বিদেশে আসিনু শ্রান্ত পথিক একেলা।’Ñ তখন সেই রিক্ততার আর্তনাদই যেন
প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। নজরুল ও জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিদের কবিতায় এই বিষাদের তীব্রতা
নানাভাবে ঝংকৃত হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথের শীতের বৈচিত্র্য আছে। রিক্ততার হাহাকার যেমন
আছে, জগৎ এবং জীবনের প্রতীকী ভাষ্যে এই ক্ষণকালীন পৃথিবীর অনুষঙ্গে যেমন শীত এসেছে,
শীতের নবান্ন এবং নতুন শস্যের আশাজাগানিয়া গানের কবিতাও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
তার যে বিখ্যাত গানÑ পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে... কিংবা
শীতের হাওয়ায় লাগল কাঁপন... তাতে সুর ছাপিয়ে ওঠে শীতের নতুন শস্যের
ছবি, নতুন কিছু প্রাপ্তির ছবি!
‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয় আয় আয়/ ডালা যে তার ভরেছে
আজ পাকা ফসলে মরি হায় হায়।।
হাওয়ার নেশায় উঠলো মেতে/ দিকবধুরা ধানের খেতে/ রোদের সোনা ছড়িয়ে
পড়ে আটির আঁচলে/ মরি হায় হায় হায়।।’
কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের শীত কোনো আশা জাগায় না। শীতের সিন্ধুর
মতো প্রেমের কবিতাতেও শীত আসে বেদনাবিরহের দীর্ঘশ্বাস হয়ে : ‘থর থর কাঁপে আজ শীতের
বাতাস/ সেদিন আশায় ছিল যে দীর্ঘশ্বাস/ আজ তাহা নিরাশায় কেঁদে বলে হায়/ ওরে মূঢ়
যে যায় সে চিরতরে যায়। ...সে ফুল ফুটিবে না রে আজ শীতরাতে/ দু ফোঁটা শিশির আর অশ্রুজল-পাতে...।’
তার যে বিখ্যাত গান
পউষ এলো গো... সেখানে বেদনা আরও গভীর।
‘রবীন্দ্র-নজরুলের সৃষ্টি থেকে শীতের কবিতা গানের বহু উদ্ধৃতি দেওয়া
যায়। উদ্ধৃতি বাড়িয়ে লাভ নেই। বাংলার এই দুই কবি শীতকে কতভাবে যে দেখেছেন, তার পর্যালোচনা
করতে গেলে আলাদা একটি প্রবন্ধই হতে পারে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকেই এই লেখার শিরোনাম।
তার কবিতায় শীত পেয়েছে অন্য মাত্রা।
...এদিকে কোকিল ডাকছেÑ পউষের মধ্যরাতে;/ কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?/তুমি স্থবির কোকিল নও?
কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে/ যেতে দেখেছি, তারা কিশোর নয়,/ কিশোরী নয় আর;/ কোকিলের গান
ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।/ চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে/ মৃত মাছের
পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারি যায় সব।...
হে পৃথিবী,/ হে বিপাশামদির নাগপাশ,Ñ তুমি/ পাশ ফিরে শোও,/ কোনোদিন
কিছু খুঁজে পাবে না আর। (শীতরাত)। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শীত এতটাই প্রতীকী এবং বহুমাত্রিক
অর্থ নিয়ে উপস্থিতিতে বিস্ময় জাগে বৈকি!
ধূসর পাণ্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থের মৃত্যুর আগে শিরোনামের কবিতাটি থেকে
একটু বড় উদ্ধৃতি নিই : ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়/, দেখেছি
মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল/ কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়/
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল/ জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে মাঠে ফসল
নাই তাহার শিয়রে/’
বাংলা কবিতার পরতে পরতে শীত এতভাবে এসেছে যে এর বৈপরীত্যও কম বিস্ময়ের
নয়। শীত আমাদের সমাজে ধনীগরিব ভেদে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান থেকে আসে। শীতের শাকসবজি,
জিয়লমাছসহ নানারকম মজাদার খাবার, শহুরে উচ্চবিত্তদের দামি দামি শীতবস্ত্রের বছর বছর
পরিবর্তন, শীতে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে পর্যন্ত আনন্দভ্রমণ এবং বড় বড় রেস্তোরাঁয় হোটেলে
খাবারদাবারের এন্তার আয়োজন যেমন বাস্তবতা, তেমনি বিপরীত বাস্তবতাও নির্মমভাবেই আমাদের
সমাজে বিদ্যমান।
ন্যূনতম শীতবস্ত্রের অভাবে শীতমৌসুমে ঠকঠক করে কাঁপে শিশুবৃদ্ধসহ
হাজার হাজার মানুষ। উত্তরবঙ্গের অবস্থা তো শোচনীয় ছিল এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত। রাজধানীর
সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন ঘটেছে অনেক ক্ষেত্রে। কর্মসংস্থান করার
পথ সহজ হয়েছে। তারা রাজধানী পর্যন্ত ছুটে আসতে পারছে। দারিদ্র্যের তীব্রতা কমেছে।
শীতবস্ত্র সহজলভ্য হয়েছে গার্মেন্টসশিল্পের ব্যাপক বিকাশের ফলে। এসব কারণে দরিদ্র
জনপদে শীতের নির্মমতা আগের মতো নেই বটে কিন্তু এখনও বহু মানুষ যারা দারিদ্র্যসীমার
নিচে বাস করেন তাদের জন্য শীত অভিশাপ হয়ে আসে।
পাকিস্তানি আমলে চরম দারিদ্র্যপিষ্ট পূর্ব বাংলার গ্রামজনপদের ভয়ংকর
শীত দেখে আমরা যারা বড় হয়েছি, তারা শীতের ভয়াবহ রূপ যতটা উপলব্ধি করতে পেরেছি আজকের
দিনে তা উপলব্ধি করতে পারবেন না যারা ওই পরিস্থিতি দেখেননি। দরিদ্রদের জন্য শীতবস্ত্র
দুর্লভ ছিল প্রায়। শীতের ছোবলে অনেক মানুষ মরে গেছে। শীতের তীব্রতায় পুষ্টিহীন বহু
মানুষ চরম ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে, স্যালাইন আবিষ্কৃত হয়নি তখনও। সেই শীতের কোনো
তুলনা হয় না।
শীতে মানুষ কষ্ট পেয়েছে এ কথা সত্য, তবে শীতের সৌন্দর্য তাতে ম্লান
হয়নি। বিলের পর বিল হলুদ সর্ষে ফুলের আশ্চর্য লাবণ্য, খালি বিলে পথের ধারে বর্ষাÑ
শেষের নীলশাদায় শোভিত কচুরিপানার বাহারি ফুল কী আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য হয়ে উঠত! কুয়াশাভেজা
শীতের কত ছবি! আমন ধানের সোনালি থোকায় জমে থাকা শিশির-রোদের ঝিকিমিকি! শীতের এই সৌন্দর্য
তো অনির্বচনীয়! অসংখ্য খেজুরগাছে ঝুলন্ত রসের হাঁড়ি। রাতে গাছপাড়া খেজুর রস কিংবা
ভোরবেলায় কুয়াশা ওরা খেজুর রসের পায়েস যেন সেই স্বাদ আজও প্রবীণদের ঠোঁটে লেগে আছে!
শীতের শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিং, মাগুর, কৈ মাছসহ রকমারি
পিঠাপুলি আর বাহারি খাবার সেকালে ছিল, আজও আছে। এখন গ্রামবাংলা আধুনিক নগর সভ্যতার
অনেক সুবিধা পেয়ে গেছেÑ এ কথা ঠিক, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে তার অনেক ঐতিহ্যÑ অনেক লোক-ঐতিহ্য
আনন্দের উপকরণ। দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কাবাডি, কুস্তিসহ কত রকমের খেলা হতো গ্রামবাংলায়।
এমন গ্রাম বাকি ছিল না যেখানে রাতে যাত্রাপালা হতো না। কালের বিবর্তনে এবং উগ্র ধর্মান্ধতার
ছোবলে যা আজ অন্তর্হিত প্রায়।
আমি মনে করি ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো যাত্রাপালাসহ লোকসংস্কৃতির বিষয়গুলো
গ্রাম জনপদে চালু রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত এক্ষেত্রে থানা বা উপজেলা পর্যায়ের
জনপ্রতিনিধি এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে পারেন।