আবদুস শাকুর শাহ
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:৪৫ পিএম
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে রুখে দাঁড়ানো এবং একই সঙ্গে নির্মমতার এক
দলিল। পরাধীনতার যে গ্রাস তার থেকে মুক্ত হতে এ দেশের মানুষকে অভাবনীয় কষ্ট পোহাতে
হয়েছে। ক্ষুধার্ত, খাবারের কোনো সংস্থান নেই, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়ানো,
গ্রামে-গঞ্জে পালিয়ে গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাÑ মুক্তিযুদ্ধের সময় এগুলো ছিল আমাদের
নিয়তির মতো। সে ব্যাপারগুলো এখন অস্পষ্ট হতে হতে মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছে। এ ভুলে
বসার ব্যাপারটা ঘটতে থাকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা
থেকে সৃষ্ট যে বাংলাদেশ, তার চেহারা পাল্টাতে শুরু করে। আমি একাত্তরে ছিলাম তরুণ, বাস
ছিল রাজধানীর বাইরে, সিলেটে। শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন আগে যোগ দিয়েছি সিলেট ক্যাডেট কলেজে।
তার কিছুদিন পরই শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ।
২৫ মার্চ ঢাকায় গোলাগুলি হয়েছে সে খবর পাই সিলেট থেকেই। পরদিন সকালে
অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা আমাদের কলেজ দখল করে নেয়। এর মধ্যে এক পরিচিত মানুষের সঙ্গে
দেখা। তিনি বললেন, এখানে কী করছেন, এক্ষুনি পালান, নইলে ওরা মেরে ফেলবে। আমি একটা মশারি,
কিছু কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। আমাদের কলেজটা ছিল
শহরের একটু বাইরে। শহরে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল ছিলেন আমার পরিচিত।
বিকালবেলা সেদিকে রওনা দিই। শহর তখন পাকিস্তানি আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সুরমা নদী পার হওয়ার
ঠিক পর, আর্মিরা আমাকে থামায়। জানতে চায় কোথায় যাচ্ছি? বলি, আমার পরিচিত একজনের সঙ্গে
দেখা করব। তিনি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল। আমার কথা শুনে কর্তব্যরত সেপাইরা
বলে, হাত দেখাও। ওরা হাতের কনুই দুটি দেখে। মানে আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে
এসেছি কি না, তা বোঝার চেষ্টা করে। বলে, দেখ, দুজনকে গুলি করে মেরেছি, এখনও লাশ নদীতে
ভাসছে। আমি তাকিয়ে সুরমা নদীতে দুটি লাশ ভাসতে দেখি। তখন মনের অবস্থা যে কী, বলে বোঝানো
সম্ভব নয়। যা হোক, আমাকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিল। কোনোমতে পলিটেকনিকে রাতটা কাটিয়ে পরদিন
এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি।
অসংখ্য মানুষ সুরমা নদী পার হয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। একজনকে দেখলাম
একটা সিলিং ফ্যান নিয়ে নদী পার হচ্ছে। লোকটাকে জিজ্ঞেস করি, এ বিপদে তার সঙ্গে সিলিং
ফ্যান কেন? আমার এমন প্রশ্নে লোকটা কেঁদে ফেলে। জানায়, তার টাকাপয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র
যে বাক্সে রেখেছে সেটা ফেলে ভুলে ফ্যান নিয়ে চলে এসেছে। দেখি অনেক লোক খালি গায়ে গামছা
পরে দৌড়াচ্ছে। বলল, এরা সবাই চোর, বামপন্থি এক নেতা জেলের তালা খুলে দিয়েছেন। এ সুযোগে
তারা পালাচ্ছে। সকাল থেকে সুরমার এক পাশে পাকিস্তানি সেনা, অন্য পাশে বাঙালি পুলিশ
আর ইপিআর গুলি ছুড়ছে। উপায় না দেখে গ্রামের দিকে রওনা দিই। কারও সঙ্গে যোগাযোগের কোনো
উপায় নেই। প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকি।
একাত্তরের নয় মাস সিলেটেই ছিলাম। তার মধ্যে আট মাস শহর থেকে অনেক
দূরের এক গ্রামে, যেখানে দীর্ঘ পথ হেঁটে পৌঁছাতে হয়েছে। গ্রামটা এমন প্রত্যন্ত যে,
পাকিস্তানি বাহিনী যেতে পারেনি কখনও। ওই রকম একটি জায়গায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল জীবন বাঁচাতে।
সেখানে আমি অনেকটা একাই হয়ে গেলাম। আমি এলাকার বাইরের লোক। অন্য সবাই আমার অচেনা। সেখানে
পৌঁছানো ছিল করুণ এক স্মৃতি। একটানা ১০ মাইল হাঁটতে হয়েছিল। গ্রামের আগেই রাস্তার পাশে
ছোট্ট একটা দোকান। দোকানের এদিক-সেদিক দুয়েক জন বসে আছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির
হয়ে আছি। দোকান থেকে মুড়ি-চানাচুর নিয়ে খেলাম। একজন পেঁপে নিয়ে এসেছে। তার থেকে পেঁপে
খেলাম। সেখানে একজন বলল, কোথায় যাবেন? বললাম যাব কোথায়, এখানে তো কাউকেই চিনি না। মনে
মনে ভাবতে লাগলাম সুনামগঞ্জে পরিচিতরা আছে। সেটাও অনেক দূর। সেখানে যাওয়া এখন সম্ভব
নয়। ভারতে যাব তা-ও কোন দিক দিয়ে জানা নেই। বগুড়া হলে কিছু একটা করা যেত। লোকটাকে বললাম,
এসেছি শহর থেকে, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। পালিয়ে আসতে হয়েছে। লোকটা অনেক চিন্তা করে
বলল, ঠিক আছে আমার বাড়িতে চলেন। লোকটার সঙ্গে রওনা দিলাম। কিছুদূর এগিয়ে দেখি ঝাঁকড়া
চুলের একটা লোক বসে আছে। জমির ভেতর রাস্তার পাশে দা দিয়ে বাঁশের কী যেন কাটছে। তখন
আমারও ঝাঁকড়া চুল। লোকটা বলল, থামেন, কোথায় যান। এ কথায় ভয়ে আমার শরীর কাঠ হয়ে গেল।
বললাম, আমার তো থাকার জায়গা নেই। উনি থাকার জায়গা দেবেন বলে নিয়ে এলেন। কোত্থেকে এসেছেন
জানতে চাইলে জানাই, সিলেট থেকে এবং পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল যে আমার
পরিচিত তাও জানিয়ে দিই।
তখন আমাকে নিয়ে আসা লোকটাকে গালি দিয়ে বিদায় করে দেন। আমি ঠিক বুঝে
উঠতে পারি না, কী ঘটছে। তিনি জানালেন, যে লোকটার সঙ্গে যাচ্ছিলেন সে চোর। বাসায় নিয়ে
রাতে সবকিছু রেখে সকালে বের করে দিত। আমি তার এ কথায় আশ্বস্ত হতে পারলাম না। হাতে দা,
বড় ঝাঁকড়া চুল, দেখতে ঠিক ডাকাতের মতোই।
তিনি বললেন, আমিও পালিয়ে শহর থেকে এসেছি। এখানে আমার শ্বশুরবাড়ি।
আপনাকে থাকার জায়গা ঠিক করে দিচ্ছি। যত দিন দেশে শান্তি ফিরে না আসবে, তত দিন এখানে
থাকবেন। আমার শ্যালককে বলে দিচ্ছি। কিছু পয়সা দেবেন, ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। গরু
রাখার ঘরের পাশের একটি কক্ষ দেখিয়ে বলল, আমার সঙ্গে এখানে থাকবেন। আমি এতেই রাজি হয়ে
গেলাম। জীবন তো বাঁচাতে হবে। আমার আর কোনো পথ খোলা নেই। এখানে সকালে একটু চা-নাশতা
দেয়। দুপুরে ভাত দেয়। রাতেও খাবার দিত। সিলেট অঞ্চলের রান্না খেয়ে অভ্যস্ত নই, তবে
বিপদে সবই সম্ভব।
সেখান থেকে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। আমরা চার বা পাঁচজন ছিলাম।
সঙ্গীদের সবাই নানা পেশার, আমার সঙ্গে ঠিক যায় না। তার পরও সিদ্ধান্ত নিই যাব। আমরা
দলবেঁধে সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখি ডাকাতি হচ্ছে। যাকে পাচ্ছে, তার
সব কেড়ে নিয়ে ওপারে পাঠাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না। আমাদের সঙ্গে যে কটা
টাকা আছে তা নিয়ে নিলে খাব কী, থাকব কোথায়? যারা বর্ডার পাহারা দিচ্ছে তারা বলল, গেলে
এখন ডাকাতের কবলে পড়বে, বরং ফিরে যাও। যাওয়ার যখন সময় হবে আমরা তোমাদের খবর দেব। আমার
বন্ধুবান্ধব অনেকেই ভারতে গেছে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। আমার ছাত্ররাও গেছে। আমার পরিচিত
সিলেট যুগলীগের সভাপতি, সেও গেছে। আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
এরই মাঝে দুয়েক বার শহরে যাওয়া হলো। শহরে অনেক ঘটনা দেখেছি। নিজেরও
অনেক ঘটনা আছে। তখন তো চিঠিপত্র যায়ও না, আসেও না। পোস্ট অফিসে গেলাম খবর নেওয়ার জন্য,
চিঠি যায় কি না। যায় জানতে পেরে ঢাকায় আমার বড় ভাইয়ের কাছে একটা চিঠি পাঠাই। চিঠিটা
ফেলে বের হওয়া মাত্র আর্মির গাড়ির ওপর থেকে একটা বিহারি ছেলে লাফ দিয়ে নেমে এসে আমার
পথ আটকে দাঁড়ায়। বলে, তুমি এই পাঞ্জাবি কেন পরেছ? আমি জানতে চাই, পাঞ্জাবির দোষটা কোথায়,
এটাতো ইসলামি পোশাক? সে তখন ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে, না, তোমার এটায় হাত ঢোলা, ঝুল বেশি;
তুমি তোমাদের নেতা শেখ মুজিবের অনুসারী। না হলে এ পাঞ্জাবি পরতে না।
আমি অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে কিছুতেই মানতে রাজি
নয়। গাড়িতে বসা আর্মির মেজর তখন ছেলেটাকে ডাকে। আমি কালবিলম্ব না করে দৌড়ে পোস্ট অফিসে
ঢুকে পড়ি। আমার সঙ্গে তখন আরও একজন ছিল, সেও ভয়ে কাঁপছে। পোস্ট অফিসের পেছনের দরজা
দিয়ে বেরিয়ে ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকি। পদে পদে এরকম ঘটনার
মুখোমুখি হতে হয় আমাকে।
দুই.
আমাদের প্রিন্সিপাল সাহেব ছিলেন মুসলিম লীগের সাপোর্টার। তার ভাইও
মুসলিম লীগার। তখন ক্লাস বন্ধ। অনেকে যাওয়া-আসা করে বটে। প্রিন্সিপালের ভাই জানাল,
যার যা কিছু আছে এখান থেকে সরিয়ে নাও। আমরা কয়েকজন, তার মধ্যে তিনজন কম বয়সি শিক্ষক।
এর মধ্যে একজন হিন্দু। প্রিন্সিপাল আমাদের নিয়ে গেল গাড়িতে করে। পথে পথে চেকপোস্ট।
হাত দেখে পা দেখে। আর্মিরা ক্যাডেট কলেজকে ক্যান্টনমেন্ট বানিয়েছে। প্রিন্সিপাল একটা
অনুমতি বের করে দেয়। আমরা ভয়ে ভয়ে কলেজে ঢুকি। কখন কাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে। ক্যাডেট
কলেজের গেট পর্যন্ত যাওয়ার পর এক মেজর আমাদের আটকে দেয়। তারপর ধাক্কা দিয়ে দিয়ে দেয়ালের
পাশে নিয়ে যায়। আমরা সাত-আট জন। দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াতে বলে। আমার মনে হয়, জীবন এখানেই
শেষ। দেয়ালের পাশে নেয় সাধারণত গুলি করতে। কিন্তু আমাদের গুলি করল না। আমরা দুজন উঁকি
দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি আশপাশে কী হচ্ছে। আমাদের মারবে না, অন্য কোনো ধান্দা আছে। দেখি
একটা মৃতদেহ বের করছে। তার ওপরে পাকিস্তানি পতাকা। এবার আমরা মনে হলো কোনো জেনারেল
হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেছে। আর্মির কোনো বড় অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে
প্রাণ হারিয়েছে। সিলেটে বেশি যুদ্ধ হয়েছিল জৈয়ন্তাপুরে। সেখানেই হয়তো মারা গেছে। ওকে
বের করে পাকিস্তানে পাঠাচ্ছে। বের করে গাড়িতে তুলল। হয়তো এয়ারপোর্টে নিয়ে বিমানে পাকিস্তান
পাঠাবে। তারপর আমাদের ডাকল। আমরা বললাম আমাদের জিনিসপত্র নিতে এসেছি। তরুণ এক ক্যাপ্টেন
বলল, এত দিন পরে এখানে কোনো জিনিস থাকে? তোমাদের কি কোনো বিবেকবুদ্ধি নেই। যেখানে প্রতিদিন
পাখির মতো গুলি করছি।
আমার ছাত্রজীবনের সব পেইন্টিং, স্কেচ ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলাম। রুমে
গিয়ে দেখি কিছুই নেই। এরপর নিয়ে গেল লাইব্রেরিতে। সেখানে আমাদের নির্দেশ দিল ঘর খালি
করার জন্য, সব বই নামিয়ে ফেলার জন্য। প্রিন্সিপালসহ সবাই মিলে বই নামানো শুরু করলাম।
ওই মেজর হুট করে বলল, তোমরা হিন্দু। এই কৃত্তিবাসী রামায়ণ কেন? তোমরা মোসলমানদের রামায়ণ
পড়াও? তোমাদের বিচার হবে। আমরা সবাই কাঁপতে শুরু করেছি ভয়ে। কোনোমতে বই নামাতে গেছি
অমনি বইয়ের পেছন থেকে শাড়ি, ব্লাউজ, সায়ার একটি পোঁটলা আমাদের সামনে মেঝেতে পড়ল। মেজর
তো আরও গরম হয়ে গেল। বুঝলাম কোনো মেয়েকে অত্যাচার করে হয়তো মেরে ফেলেছে। সে কাপড়ই এখানে
রেখেছিল। এসব বের হলো কেন? মেজর আমাদের গালিগালাজ করে গুষ্টি উদ্ধার করল। বই গাড়িতে
তুলে দিয়ে আমরা চলে আসি। প্রিন্সিপালকে বলি, আপনার কাণ্ডজ্ঞান নেই। আমরা এখানে মারা
যেতে পারতাম। সারা দেশে যুদ্ধ চলছে আর আমরা আসছি জিনিস নিতে!
যুদ্ধের সময় ছবি আঁকা হয়নি। নিজের জীবন, বাবা-মা কীভাবে আছেন সে চিন্তায়ই
প্রতিনিয়ত দিন পার করতে হতো। খাওয়া নেই, কলম নেই, কালি নেই, কাগজ নেই। মানুষ এমন হয়েছিল,
কোনো কিছু দেখলে নিয়ে যেত। ভয়, সব সময় ভয়। সে সময় আঁকাটা কঠিন ছিল। তবে তার মধ্যেই
মুক্তিযুদ্ধ বিষয় করে কিছু কাজ করেছিলাম পেনসিলে। পরে সেগুলো ১৯৭৬ সালে অঙ্কন করি।
সে সময়ের একটা ছবিই আছে। জলরঙের মতো করে একটি কাগজে করেছিলাম। একটি বাস্তব দেখা বিষয়।
ধর্ষিত একটি মেয়ে পালিয়ে রাস্তায় বসে আছে। এরকম দৃশ্য আমার চোখে পড়েনি। তবে এমন ঘটনা
প্রচুর শুনেছি। আমাদের ক্যাডেট কলেজের দেয়ালের পাশে মাথার খুলি, চুল, কাপড় দেখেছি।
মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। সরাসরি আমার চোখে পড়েনি। আমি ওই থিমটা নিয়ে কাজ করেছি। আমার
ছবির বেশিরভাগই এসেছে মানুষের কষ্ট। নয়টা মাস যে কষ্ট মানুষ করেছে আমার বিশ্বাস সব
কষ্টের কথা পুরোপুরি আসেনি। মানুষের শত রকম কষ্ট ছিল। কেউ অসুস্থ, চিকিৎসা নেই। কেউ
খাবার পাচ্ছে না। কেউ বাজারে যেতে পারছে না। কেউ ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। যারা সরকারি
চাকরি করত তারা বেশি বিপদে ছিল। না এদিক, না ওদিক। মরবে না বাঁচবে। আরেকটা হলো ব্যবসায়ীরা।
দোকান রেখে পালাবে, না দোকানদারি করবে। এতসব মালপত্র রেখে কোথায় যাবে সে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল কিছু একটা ঘটছে। শুনতে
পাচ্ছিলাম, ভারতের সেনারা ঢুকে পড়েছে। পাকিস্তানি সেনারা রাগান্বিতভাবে পিছু হটছে।
ভারতের হেলিকপ্টার দিয়ে বোমা ফেলা হচ্ছে। প্যারাসুট দিয়ে সেনা নামছে। এটা আমরা দেখতে
পাচ্ছি। আশপাশের সব এলাকা খালি হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা স্বাধীন হলো। কিন্তু সিলেট স্বাধীন
হলো না। স্বাধীন দেশেও পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল বর্ডার এলাকায়। আমাদের
সাহস হলো। আমরা শহরে ফিরে এলাম। সিলেটে কয়েক দিন পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ
করল। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এলো। এভাবেই আমরা একটা স্বাধীন দেশের জন্ম হতে দেখলাম চোখের
সামনে।