× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মেতিসের নীলসাগর

সঞ্জয় দে

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:৫২ পিএম

মেতিসের নীলসাগর

রেনোয়ার বাড়িটি থেকে এখন যেখানে যাব, সেটি কারুর বাসস্থান নয়। একটি প্রার্থনা-মন্দির। নাম ‘শাপেল দু হুসে মেতিস। গির্জা বা মন্দিরের মতো ঐশ্বরিক স্থাপনাগুলোর নাম সাধারণত হয় দেবতাদের নামে, সাধু-সন্তদের নামে। কিন্তু শিল্পীর নামে নামকরণের নজির কিন্তু খুব একটা দেখা যায় না। অথচ এসব স্থাপনায় ভক্তের সঙ্গে ঈশ্বরের মেলবন্ধনের মূল কাজটা অগোচরে কিন্তু করেন শিল্পীরাই। সেদিক দিয়ে এ চ্যাপেলটি ব্যতিক্রমী তো বটেই! কারণ এ চ্যাপেলটি তাকেই উৎসর্গ করা হয়েছে যিনি নিজ জীবনে অজ্ঞেয়বাদী হয়েও জনমানুষের ঈশ্বরসাধনার ঘর তৈরিতে নিবেদন করেছেন নিজের জীবনের চারটি বছর। জীবনের প্রদীপ নিভুনিভু তখন। ক্যানসার আক্রান্ত। দাঁড়াতে পারেন না। হাত কাঁপে। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেছে মনও। ইতি ঘটেছে একচল্লিশ বছর যে স্ত্রীর সঙ্গে ঘর করেছেন, সে সম্পর্কের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। নাৎসিদের হাতে প্রাণ গেছে পরিবারের বেশকিছু মানুষের। নিস শহরে মুহুর্মুহু বোমা ফেলছে মিত্রবাহিনী। বোমা থেকে বাঁচতে আর হয়তো নিজের চিরচেনা পরিবেশ থেকে পালাতে তিনি এলেন নিস থেকে একটু দূরের এই গ্রাম ভেন্সে। একটা বাড়ি কিনলেন। নাম দিলেন ‘ল্য রেভ’–স্বপ্ন। ১৯৪৩ সালের কথা সেটি। একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূরে হাঁটতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল মনিকের সঙ্গে।

মনিক মানে মনিক বুজয়া। এর বছর কয়েক আগে নিসে থাকাকালে মেতিস যখন খুব অসুস্থ, দেখভালের জন্য একজন রাত্রিকালীন নার্স প্রয়োজন হয়ে পড়ল। নিসের নার্সিং স্কুলে তিনি বিজ্ঞাপন দিলেন, একজন কম বয়সি সুন্দরী নার্স প্রয়োজন। হ্যাঁ, নিজের ইচ্ছার ব্যাপারে কোনো লোকদেখানো রাখঢাক তিনি করতেন না। পাহাড় আর সমুদ্রের পর তৃতীয় যে বিষয়টি তাকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করত তা হলো নারী। সুন্দরী নারী। আর তাই নারীকেই তিনি বারে বারে এঁকেছেন পটে। নারীর ঠোঁটে দিয়েছেন চেরি টমেটোর লাল প্রলেপ আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বারে বারে টেনে এনেছেন প্রিয় রঙ নীল। বিভিন্ন ধরনের নীলসাগর নীল, মেঘ নীল।

মেতিসের সেই বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির সন্ধানে উপস্থিত হলেন মনিক। নার্সিংয়ের ছাত্রী। মনিকের সঙ্গে বেশ একটা ভাব হয়ে গেল মেতিসের। মনিকের বেশকিছু ছবিও এঁকে ফেললেন তিনি। মনিকের সঙ্গে মেতিসের ভাবটা ঠিক কোন পর্যায়ের ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এ নিয়ে মেতিস মৃত্যুর কিছুকাল আগে নিজেই বলেছিলেন, ‘আমাদের মাঝে যা ছিল, তা ছিল কেবলই একরাশ ফুলের ফল্গুধারা। আমরা দুজন দুজনের দিকে কিছু গোলাপের পাপড়ি ছুড়ে দিয়েছি মাত্র।

মেতিসের সেই প্রিয়পাত্রী মনিক এখন ভেন্সে। যেন মেতিসকে অনুসরণ করেই তার আগমন। যদিও সেটি অনুসরণ ছিল না। মনিক তত দিনে যক্ষ্মায় আক্রান্ত। ভেন্সের একটি কনভেনটে ভর্তি হয়েছেন আরোগ্যলাভের আশায়। এখানে অবস্থানকালেই মনিক সিদ্ধান্ত নেন বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন ‘নান হিসেবে। এ কনভেনটেরই নান হিসেবে।

মেতিস তাকে অনেক বোঝালেন এ পথ থেকে ফিরে আসতে। এমন এক সুন্দরী তরুণী বাকি জীবনটা অমন শুষ্ক ফুলের মতো করে কাটিয়ে দেবেন, এ কেমন কথা! কিন্তু মনিক সিদ্ধান্তে অচল।

ভেন্সের সেই কনভেনটে তখন নতুন করে দীক্ষিত নানদের জন্য একটি চ্যাপেল নির্মাণের প্রয়োজন। প্যারিস থেকে নকশাবিদরা এলেন। যখন তারা শুনলেন মেতিসের মতো শিল্পী এ তল্লাটেই আছেন আর তিনি মনিকের পূর্বপরিচিত, মনিকের ওপর ভার পড়ল মেতিসকে এ চ্যাপেলের অঙ্গসজ্জার দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত করবার।

এমনিতেই তিনি মনিকের এ নান হওয়ার বিষয়ে প্রীত ছিলেন না, তার বাদে নিজে অজ্ঞেয়বাদী হয়ে কি না আঁকবেন চ্যাপেলের দেয়াল? পাগল! কিন্তু যার দিকে একবার ছুড়ে দিয়েছেন গোলাপের পাপড়ি, তার অনুরোধই বা উপেক্ষা করেন কী করে! মেতিস রাজি হলেন। নিজের মনকে বোঝালেন, ‘গত পঞ্চাশ বছরে আমি কখনও থেমে যাইনি। আজ থামব কেন? কর্মই যে সব জরার প্রধান উপশমকারী মহৌষধ!’

দায়িত্ব তো নিলেন, কিন্তু সেই সত্তর পেরোনো বয়সে তো আর মই বেয়ে কিংবা মাচায় উঠে দেয়ালে ছবি আঁকা যায় না। ক্যানসারে তিনি চলনশক্তিহীন। বাধ্য হয়েই এক বুদ্ধি বাতলালেন। হুইলচেয়ারে বসে একটা লম্বা লাঠির মাথায় চারকোল বেঁধে দেয়ালে ছবি আঁকবেন। সহকারীরা পরে সেই ছবিতে হয়তো দেবেন কিছুটা রঙের প্রলেপ। এভাবেই চ্যাপেলের কাচের দেয়াল, মূল বেদির পেছনকার অঙ্গসজ্জার কাজ; এমনকি যাজকের পরনের আলখাল্লার নকশাও তিনি করে দিলেন।

চ্যাপেলের কাজ একদিন শেষ হলো ভালোভাবেই। পত্রপত্রিকায় চ্যাপেলের উদ্বোধনের খবরের পাশাপাশি মুখরোচক গপ্পো এলোমনিক নামক গির্জার এক নানের সঙ্গে গোপন সম্পর্কের হেতু ধরেই মেতিস এ চ্যাপেলের কাজ সম্পন্ন করেছেন। সে অপবাদ মাথায় নিয়েই মেতিস গত হলেন; এর ঠিক কিছুদিন বাদে।

পড়ন্ত দুপুরবেলায় আমরা সেই চ্যাপেলের সামনে এসে দাঁড়াই। পাহাড়ের কোণে লটকে থাকা স্থাপনা। ইউরোপের পুরোনো চার্চ কিংবা চ্যাপেলে যেমন ঢোকার মুখে রিলিফের কারুকাজ থাকে, এখানে তেমন কিছুই নেই। সাদামাটা একটি বাড়ি। টালির ছাদ। সদর দরজার ওপর মেতিসের নিজস্ব কায়দায় আঁকা দুটি মানব মুখাবয়ব। সেখানে কোনো দৃষ্টি নেই, ভাবলেশ নেই, অনুভূতি নেই।

ভেতরটা আরও সাদাসিধে। সাদা টাইলস। দেয়ালের টাইলসে মেতিসের আঁকা যাজকের অবয়ব। সচরাচর চ্যাপেল কিংবা গির্জায় যিশু বা মেরির যে কাতর দৃশ্যপটগুলো দেখা যায়, এখানে তার কিছুই নেই। ভাস্কর্য নেই। তেলরঙে আঁকা বিশাল আইকন নেই। কাঠের নকশাদার মঞ্চ নেই। দুই দিকের দেয়ালে লম্বাটে কাচ। ছাদ থেকে নেমে এসেছে মেঝে অবধি। সেখানে হলুদ, নীল আর কালচে সবুজ পাতার কারুকাজ। ওরই মাঝ দিয়ে সূর্যের আলো পথ করে নিয়ে ঢুকছে এখানে। চ্যাপেলের সঙ্গেই ছোট্ট একটি সংগ্রহশালা; সেখানে মেতিসের আঁকা কিছু স্কেচ।

সাগর আমার সঙ্গে চ্যাপেলের ভেতরে ঢোকেনি। ও বলছিল, আশপাশের পাড়ায় একটু হেঁটে দেখবে। আমি চ্যাপেল থেকে বের হয়ে ওকে খুঁজে পাই না। রোদের তেজ এখন অনেকটাই কমে গেছে। কিছুক্ষণ দূরের কিছু সাইপ্রেস গাছের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, গাড়িটা যেহেতু চ্যাপেল চত্বরে পার্ক করা আছেই, আমিও একটু আশপাশে হেঁটে এলে মন্দ হয় না। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা