লুৎফর রহমান মণ্ডল
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:০০ পিএম
ঘরঘেঁষা জমি ধরে সবুজ শরীরের তিসি, কাউনের ডালগুলো ঢোলের শব্দ আর
নদের বুক থেকে আসা বাতাসের মাতৃস্নেহের পরশে অনবরত দোল খায়। শজনে চিকন পাতায় বাতাস
আঙুল বোলায় হারমোনিয়ামের। মন খেয়ালের সঙ্গে একটা গান ধরলে সুর তোলার জন্য আলাদা করে
লয়, তাল, মন্দিরা ঠিক করতে হয় না। বুক জমে যাওয়া পানিতে মৃদু তরঙ্গে নর্তকী নদের তানপুরা
বাজায়Ñসেই সুর বাতাসে মিশে পুরো খরকটিয়া চরে ছড়িয়ে পড়ে। পেঁপে গাছে চোঙা ডালে বসে থাকা
শালিক পাখিটি ডানা ঝাপটায়। ঢোল-শঙ্খের শব্দ আরও বেড়ে ঘর বিরানে পৌঁছালে সুবেছান বেওয়া
ঘর থেকে উঠোনে আসে। চোখে পড়া রোদ হাত দিয়ে ঢেকে ধরে জিজ্ঞেস করেÑ
Ñতা কোন চরের তোমরাগুলা।
Ñবিলঘড়িয়া। নেমাই ঘোষের বাড়ির।
কালী সাজা ছেলেটি ককসিটের সাজানো খড়্গ নিয়ে তিড়িংবিড়িং করে। পুরো
কালোয় মিশে যাওয়া রঙমাখা দুজনের খেলতামাশার খড়্গ যুদ্ধ চলছে উঠোনে।
Ñতা কাকি তোমারে নিমতন্ন করতে আইলাম। মেছের কাকা কম করেনি গো ভাগ্যপোড়াদের
জন্যি। আমরা তো তোমার জন্যি কিছুই করতে পারি নাই।
Ñতোমার বেটা হাফিজ ভাই গেছে কনে?
Ñদিঘর চরে গেছে সাজবিয়ানে। নতুন বাদাম, ভুট্টা বুনতে।
ষাট ছুঁয়ে যাওয়া সবেছান বেওয়া সময় নেন।
Ñতা তোমরা জিরোও। পানি-মুড়ি খাও।
Ñআরও ছুটতে হবে মা লক্ষ্মী। সাজাই বাজারে মেলা। এসো নিকি।
সবেছান বেওয়া ঘর থেকে একটালা তিসি আনলে খড়্গওয়ালা কালিমাখা ছেলেটি
বস্তার মুখ খুলে ধরে। টানা ঘোড়ার গাড়ি চেপে সাজসজ্জার মেলা আয়োজনের দলটি বিলঘড়িয়ার
দিকে যাত্রা ধরে।
বিলঘড়িয়া, সাজাই বাজারের কয়েক ঘর হিন্দু পরিবার। চরখরকটিয়ার ভেতরের
এই একমাত্র সন্ধ্যা বাজারের ও উত্তরের বিলঘড়িয়ার আশপাশে কয়েক পরিবার হিন্দু কীভাবে
এসে পড়ল তা কোনো লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায় না। তবে লোকমুখে প্রচলিতÑ দেশ স্বাধীনের
সময় এখানে কয়েকজন হিন্দু এসে মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। দেশ স্বাধীন হলেও তারা আর
অন্য খানে ফেরেনি। ফেরেনি মানে সবার তো আর ফেরার আশ্রয়ও থাকে না। আবার অনেকে বলে, দেশভাগের
সময়, কেউ বলে দাঙ্গার সময়, কেউ বলে দিঘরের আশ্রমের লোকজন এসব এলাকায় এসেছিল। সব উৎসকথা
আনুমানিক। কোনো লিখিত বা অকাট্য প্রমাণ নেই। দিন বদলে সবকিছু ছেড়েছুড়ে অনেকেই কাইমডাঙায়
এসে থিতু হয়। নদের ভাঙনের পরও আবার কেউ কেউ আগের বসতভিটার মাপে জায়গা চরে ঠাঁই নিয়েছে।
মেছের দস্তিগার হিন্দু পরিবারগুলোকে খুব যত্ন করতেন। সাজাই বাজারে দুর্গাপূজা-কালীপূজার
সময় মেলার আয়োজন পড়লে পুরো খরখটিয়ার সবাই এগিয়ে আসে। চরের মেঘের ভেলার মতো অস্থায়ী
জীবনে তারা আপস করেছে। বছরান্তে এ টুকরো আয়োজনে পুরো চরে বেশ হইহইরইরই বিরাজ করে।
মেছের দস্তিগারের একমাত্র মেয়ে সবেছান বেওয়া। জোতদার বাপের মেয়ে দোচালা
টিন ঘরে দিন গুজরান করে। পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা দুই ঘরের বাড়িতে হাত দশেক উঠোন। কোনায় ধানখড়ের
গাদি। পাটকাঠি বেড়া ধরে কয়েক ডজন বিচিকলার ধর। উঠোনে দুয়েকটি বনজ-ফলদ বৃক্ষ ক্রমান্বয়ে
মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে। বছর তিনেক হলো নদ বিলঘড়িয়া থেকে এদিকে আর ভাঙছে না। সেই সুযোগে
কিছুটা থিতু হওয়া ভিটায় বৃক্ষগুলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে। সে স্বস্তি এবার বর্ষা
এলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে খরখটিয়া চরের কেউ জানে না।
গল্প তো জীবনের কথা বলে। জীবনে যে কত রকমের গল্প থাকতে পারে তা কোনো
মানুষের গল্প না শুনলে বোঝা যায় না। এই যে সবেছান বেওয়ার গল্প আমি লিখছি তাকে দেখলে
চরের আর আট-দশ জন নারীর মতো মনে হবে। মনে হবে শিক্ষাদীক্ষায়, সুযোগসুবিধায়, জীবনযাপনের
সব স্তরে পিছিয়ে পড়া এক নারী। কিন্তু যখন তার ফেলে আসা পুরো জীবনের গল্প শুনব তখন তাকে
হয়তো আর গড়পড়তা একজন চরের যাপিত নারী হিসেবে মনে হবে না। সময়, ভাগ্য, স্থান অনেক ক্ষেত্রে
পক্ষে থাকে না। বিপক্ষে গিয়ে পুরো জীবন দুর্ভাগ্যের পক্ষে নিয়ে দাঁড় করায়। সবেছান বেওয়ার
উঠোন থেকে নেমে যাওয়া জমি ধরে কিলোখানিকের কম দূরত্বে বর্তমান নদের ধারা। দিনের বেলা
সে নদের শোঁ শোঁ-সাঁই সাঁই শব্দ অতি সহজে কানে আসে। একটু রাত হলে সে শব্দ আরও বাড়ে।
কোনো অতিথির কাছে নিছক শব্দ হলেও সবেছান বেওয়ার কাছে ধ্বংস দৈত্যের তীব্র হুংকার মনে
হয়।
দুই.
এখন পুরো এলাকা চরখরকটিয়া নাম হলেও আগে এটি চর ছিল না। উত্তর থেকে
খাড়া চলে আসা ব্রক্ষপুত্রের স্থূল শরীরে উদোম প্রবাহ নিয়ে খেমটা নাচে মিশেছে তিস্তা।
অন্য দিক থেকে আসা ছোট নদ ঘাঘট, দুধকুমারের সঙ্গে মিলিত মোহনা। সব স্রোত জোর দিয়ে ছুটে
চলে ব্রহ্মপুত্র ধরে। মোহনার তীর থেকে ভূমিরূপ ধরে ঘাট লাল চামার, উত্তরে বিলঘড়িয়া,
মাঝখানে সাজাই বাজার, দক্ষিণ-পশ্চিমে কনকসা, কামারজানি। সেই লাল চামারের ঘাট এখন কামারজানিতে
এসে ঠেকেছে। ভাঙনপিষ্ট পুরো এলাকাটি চরখরকটিয়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। চরখরকটিয়ার বুকে
ভাঙাগড়ার মাঝে নামমাত্র টিকে আছে বিলঘড়িয়া, সাজাই বাজার। পশ্চিম দিকের কনকসায় জোতদারি
ছিল সবেছান বেওয়ার বাপ মেছের দস্তিগারের। ছোটখাটো জোতদারি ছিল তার। শানবাঁধানো পুকুর,
নারকেল গাছে ঘেরা ঘর চৌহদ্দি, গোয়ালের গরু, গোয়ালঘরের চালা ভর্তি দেশি কবুতর। শত চড়ুই
পাখির সঙ্গে সেই বাড়িতে মানুষজন লেগেই থাকত। বাড়ির সামনে কাচারিঘরে খাতির-আপ্যায়নের
ব্যবস্থা ছিল অতিথিদের। এখন যেখানে নৌকাঘাট তার একটু ভেতরে নদের বুকে সেসব মিশে গেছে।
কোনো নামগন্ধ নেই। ব্রহ্মপুত্র তখন এখনকার থেকে আরও প্রমত্ত। কোন বছর কোন দিকে থাবা
দেবে আগে থেকে আঁচ করা যায় না। কনকসা থেকে অনেক দূর ছিল ব্রহ্মপুত্র। পাকিস্তান আমলের
বাঁধ ছিল পুরো বিলঘড়িয়া, লাল চামারের সীমানা দিয়ে। সেই বাঁধে বাবার হাত ধরে বেশ কয়েকবার
গিয়েছিল সবেছান বেওয়া। বাঁধ ধরেই ছিল লাল চামারের ঘাট। সেখান থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী
আর জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের ঘাটে যাওয়া যেত। সারিসারি পালতোলা নৌকা অপেক্ষায় থাকত যাত্রীর।
নদের বুক ধরে ঢাকার অনেক যাত্রী এ পথে পার হতো। পাবনা-আরিচা দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এ পথে
ব্রহ্মপুত্র পার হলেই জামালপুর; সেখান থেকে লোকাল বা মেইল ট্রেনে ঢাকা। এখন সেসবের
আর কোনো চিহ্ন নাই। খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র পুরোনো সব মানচিত্র নিজের মতো করে এঁকে নিয়েছে।
নদের পারের ছবি স্থির নয়; সময়-অসময় পাল্টায়। সে পাল্টানো জীবনও পাল্টে দেয়।
তখন কার্তিকের শেষের দিক। উত্তর থেকে আসা হালকা বাতাসে শীত শীত আমেজ।
রাতভর গাছের পাতায় জমা নতুন শীত জল হয়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টিনের চালায় টুপটুপ করে
পড়ে। লাল চামারের ঘাট থেকে বাবার আনা কোয়েল পাখিটার রাতভর কোত কোত শব্দে ঠিকভাবে ঘুম
আসে না সবেছান বেওয়ার। ভোরসকালে উঠলে মনে হয় আমন ধানের বিস্তর পাকা ক্ষেত জুড়ে শিমুল
তুলা উড়ছে পূর্ণিমারাতের খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের মতো। এমন তোলা চাদর গায়ে মোড়ানো সময়ে
সবেছান বেওয়ার বিয়ে হয়। পাত্র দিঘর এলাকার। দিঘর মোটামুটি সম্ভ্রান্ত এলাকা। ময়মনসিংহের
জমিদার সূর্যকান্ত এখানে আসতেন শিবপূজা করার জন্য। জমিদার বহর বলতে কথা। বছরের সব সময়
দিঘর থাকত সরগরম। রাজার আয়োজনে ঘাটতি বলতে কিছু থাকত না। দিঘরের শৈব দিঘির পারে দোতলা
সমান শিবমন্দির। সাদা মারবেল পাথরের মাটি ধরে ওপরে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। মন্দিরের মেঝে
থেকে পুকুর অবধি আরও দুটি সিঁড়ি, মাথায় চারটি রত্নচূড়া। মন্দিরের ভেতরের তাকে শোভা
পায় মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কার মহাভারত, রামায়ণ। মন্দিরের গা-জুড়ে পশুপাখি, দেবদেবীর
ছবিচিত্র, পোড়ামাটির ফলক। সামনের ঢোকা পথের দুই ধারে একটি শিউলি আর একটি ফুলমাখা বকুল
গাছ। সে আয়োজনে দূর থেকেও অতিথি হতেন সম্মানিত অনেকে। দিনাজপুরের কান্তজির এলাকার জমিদার
ভুবনবাদ্য, শিলিগুড়ির রাজা ভামস, জলপাইগুড়ির শিবঠাকুর, তাজহাটের মহারাজা গোপাল লাল
রায়, পুঠিয়ার জগমোহনসহ অনেকেই। মাসব্যাপী চলত কাঙালিভোজ-সাধনভজন। সবেছান বেওয়ার বিয়ে
সেই এতিহ্যবাহী দিঘরেই। লাল চামারের ঘাট ধরে ওপারে দিঘর। তার যখন বিয়ে হয় তখনও দিঘরে
নানা জায়গার মানুষের আসা-যাওয়া। জমিদারের শিবমন্দির-পুকুর এখন সবই স্মৃতি। খরকটিয়ার
ঘরের উঠোনে আসে সবেছান বেওয়া। পুবাকাশে পানির বুকে মিশে যাওয়া দিঘরের ওপর রক্তবর্ণ
সূর্য মুখ তুলছে। একটু পরে আগুন গলাবে মুখ থেকে। সেই দিঘরে রাজা-প্রজাদের আনাগোনা নেই,
আছে শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস। রাজা, মন্দির সবই স্মৃতি। শত কিউসেক পানি নিয়ে সেসব এখন মাটির
নিচে চাপা পড়া ইতিহাসের খাদ্য।
বিয়ের পরের বছর বর্ষা দানব হয়ে আসে। ঘরগেরস্থি তার তেমন হয়ে ওঠে না।
আকাশ ভেঙে সে বছর বৃষ্টি নামতে থাকে। কনকসা, দিঘর ঘর অবধি পানির প্রবাহ আসতে থাকে।
তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রে পৃথিবীর সব পানির প্রবাহ নেমে আসে। সে কি স্রোত আর ঘূর্ণপাক।
নির্দয় বৃষ্টির সঙ্গে উজান থেকে আসা পানিতে নদ রাক্ষুসে হয়ে ওঠে। উন্মাদ দেবতার মতো
বিধ্বংসী জলস্রোত দুই কূল ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। এক রাতেই বাঁধ ভেঙে নদ পুবে দিঘর
অবধি চলে আসে। রাজার আরামপ্রসাদ, শিবমন্দির, মন্দিরের দুয়ারে ফুলশোভিত বকুল আর শিউলি
গাছ সপ্তাহখানেকেই মিশে যায় নদে। নদ আরও খিদে নিয়ে পশ্চিমে চলে যেতে থাকে। পশ্চিমে
কনকসা, উত্তরে বিলঘড়িয়া, মাঝের সাজাই বাজার নদের বুকে টেনে নামাতে সপ্তাহ দুয়েক নেয়।
কোথাও নিস্তার নেই। মুহূর্তে জোতদার ফকিরে পরিণত হয়। জায়গা হয় সরকারি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।
সে এক মহাপ্রলয়ের ঘটনা। সদ্যবিবাহিতা সবেছান বেওয়ার সংসারই চেনা হয়নি। কোন ঘরের দরজা
কোন মুখে দিনসকাল না হলে সে বলতে পারে না। সে কি জলযুদ্ধ! সবেছান বেওয়া ভাবছিল নুহু
নবীর আলামত শুরু হলো হয়তো। নির্দয়ভাবে নদ ভাঙছে। চোখের পলকে আবাদি, বসতবাড়ি, পুকুর,
বনজ-ফলদ, গাছগাছালি ডুবে যাচ্ছে নদে। গোয়ালঘরের দড়িসমেত গরু, আদরের ছোট্ট শিশু, অশীতিপর
বৃদ্ধবৃদ্ধা, কুকুর-বিড়াল লাশ হয়ে ভেসে এসে নদের পাড়ে আটতে থাকে। মানুষ মাছ না খুঁজে
মানুষ খোঁজে কবর, সৎকার করার জন্য। চারদিকে জলসমুদ্র। জনমের অভুক্ত গোগ্রাসে গিলছে
সবকিছুÑ ধানের জমি, গরু-মহিষ, মাছ-পুকুর, শতবর্ষী পাকুড় গাছ, কনকসার জামে মসজিদ। দিন
পনের লাগেনি ওপারে দিঘর আর এপারে লাল চামারের ঘাট, বিলঘড়িয়া, সাজাই বাজার থেকে কনকসা,
নদের বুকে বিলীন করে কামারজানিতে গিয়ে কিছুটা শান্ত হয়। লোকজন চোখের পলকে নিঃস্ব হয়ে
আশ্রয় নেয় ত্রাণশিবিরের উজান বাঁধে।
তিন.
সেই শুরু এক ভাঙাচোরা জীবনের। যে জীবনে কোনো স্থায়িত্ব নেই, জোর নেই,
পায়ের তলায় স্থায়ী মাটি নেই। ভূমিপুত্র থেকে ভূমিহীন। আগুনে সব পুড়লেও তো মাটিটুকু
থাকে, নদী ভাঙনে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সবেছান বেওয়ারও কিছুই রইল না। পানি নামার
আগে বাপটাও হঠাৎ মারা গেল। জোতদারি বাপের জায়গা হলো অন্যের দেওয়া মাটিতে, পানিভর্তি
বাথটাবের মতো কবরে। স্বামীর সম্পর্কের দিক থেকে এক আত্মীয়র জমিতে ঠাঁই হয় তাদের। বছর
দুয়েক পর সাজাই বাজারের চর জাগলে সেখানে থাকতে শুরু করে। চর এই জাগে তো পরের বছর আবার
ভাঙে। আবার নতুন জাগা চরে মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজা। তখন দিঘরের দিকে কেবল চর জাগতে শুরু
করেছে। চিকচিকে রাশিরাশি বালুতে বনেদি দিঘর মাথা নাড়ছে। সেখানে থাকতে স্বামীকে হারায়
সবেছান বেওয়া। কোলের সন্তান হাফিজকে নিয়ে দিঘর ছেড়ে সাজাই বাজারে আসে। আশ্বিন-কার্তিকে
নদের খোলায় বোয়াল মাছের বৈত নামে। শৈবিন্দু কৈরাল, উমেশ, ইউনুস, মৈ জালালের বাপ, ছপিয়াল,
দবির সোনামুখী ব্রহ্মপুত্রের বোয়াল সৈনিক। সাজাই বাজারে সাজ সকালে যে বোয়াল ওঠে এরাই
রাতে ধরে সেগুলো। কিনার ধরে যেদিকে নদের চোয়াল চর ছুঁয়েছে সেদিকে বোয়াল ছোটে। টোপ বড়শি
দিয়ে বড় বড় বোয়াল ধরে তারা। বোয়ালের আদার করা হয় চ্যাপা, মলা, চলা ও চাপিলা প্রজাতির
ছোট মাছ দিয়ে। বাঁশের চোঙায় পচানো এসব মাছ আর গাছ জামলা ডিম দিয়ে লেই বানানো হয়। সেগুলো
টোপ বড়শিতে গেঁথে বাঁশখুঁটিতে বেঁধে গেড়ে দেওয়া হয় নদের কিনারে। টোপ খেতে এসে বড়শি
গিলে আটকে যায় বোয়াল, নলাই বোয়াল। সাজাই বাজারে কিছু বিক্রি হয়, আরেকটু লাভের আশায়
ছুটতে হয় কামারজানিতে। দূর থেকে লোকজন আসে সেখানে। ব্যাপারীরাও আসে। নদের মাছের বেশ
টান থাকে। কিন্তু সেই বাজার অবধি নিয়ে যাওয়াই কষ্ট। কাইম রাস্তা নেই। চরের বুকজমিন
ঠেস দিয়ে যেতে হয়। কখনও হেঁটে কখনও ঘোড়ার গাড়িতে। চর পার হয়ে কনকসা ঘাট, সেখান থেকে
নৌকায় ঘণ্টাখানেকের পথ পেরিয়ে কামারজানি। বেশ হাঁপিয়ে উঠতে হয় যেতে-আসতে। তা-ও যেতে
হয়। জীবন নিয়ে যায়। পৃথিবী কাউকে বুক দেখায়, পিঠ নয়। আবার কাউকে পিঠ, বুক নয়। অথচ কত
কম দূরত্ব অবস্থানের। কারও পৃথিবী তাবৎ যুদ্ধক্ষেত্র, কারও কাছে ভোগের, উল্লাসের। আমরা
এ খরকটিয়া চরের সাজাই বাজার, কনকসাকে আলাদা গ্রহ-উপগ্রহ ভাবতে পারি। পৃথিবী থেকে কাছের
মঙ্গল বা আরও দূরের ইউরেনাস বা বৃহস্পতি। ওপরে কত স্থির অথচ ভেতরে কত ধাবমান স্রোত।
সবেছান বেওয়ার পুরো জীবন স্থির। তার ভেতরের স্রোত হয়তো কোনো উচ্চ ভূমিরূপে ধাক্কা খেয়ে
গতিপথ পরিবর্তন করেছে, এমনটাও হতে পারে স্রোত-উৎস আর নেই। পানিচক্র নদকে প্রবহমান করে,
দুঃখচক্র মানুষকে স্থির, শান্ত, ভাবলেশহীন করে।
শীত শুরু হয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে উত্তরবঙ্গে শীত বেশি
পড়ে, আগেই পড়ে। চরেও শীত পড়েছে কোমরবেঁধে। শীতের দলা সাদা ধোঁয়ার মতো উড়ে বেড়ায়। হাঁটাপথের
চরটুকু সন্ধ্যায় যেতে ধরলে পথ ভুলতে হয় যে-কারও। অনেকে কনকসা থেকে পথহাঁটা শুরু করে
আবার ঘুরে কনকসাতেই চলে আসে। শীত এলে হাঁপানির ব্যামোটা বেড়ে যায় সবেছান বেওয়ার। একলা
বাড়িতে ছেলে দিঘর থেকে মাঝে মাঝে আসে, তার প্রয়োজনীয় কিছু দিয়ে আবার দিঘরে যায়। আলু,
বাদাম, ভুট্টার মৌসুমে দিঘরে কামলা খাটে সে। এ চরের অনেকেই হাফিজুরের সঙ্গে নদ পার
হয়ে দিঘর চরে যায় শ্রম দিতে। এবার এক সন্ধ্যায় বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে সবেছান বেওয়া। ঘোর
হয়ে আসা চোখে তার বাপকে দেখে তাদের সেই নদের বুকে বিলীন হওয়া বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে
আছে। স্বামীকে দেখে নতুন বধূ সেজে ছইঘেরা নৌকায় দিঘরের দিকে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। ঘি-রঙা
স্বামীর শরীরে সাদা রঙের শেরওয়ানি।
সবেছান বেওয়া লজ্জাবনত মাথা না তুলতে চাইলেও ফিরে পাওয়া স্বামীকে
সে ছুঁয়ে দেখতে চায়। চোখ বেয়ে কান্নার জল বুক ভাসিয়ে দেয় তার, লাল মেহেদিরাঙা হাতে
প্রাণের স্বামীর মায়াবী মুখটা বারবার আলগোছে তালুবন্দি করে।
Ñআপনে সত্যিই আছেন? আমারে এতকাল একা রাখপের পারলেন!
দিঘরের শিবমন্দির, শৈব পুকুর, রাজাদের বছরান্তে সাধনভজন চলছে। সব
যেন ফিরে পায় সে। ঘোরের মধ্যে নিজেই নিজেকে চিমটি কাটতে চায়।
Ñকোন উত্তর আসে না নিশ্চুপ স্বামীর কাছ থেকে। শুধু ইশারা দিয়ে মাঝিকে
দ্রুত নৌকা এগোতে বলে।
শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কাশিটাও বেঘোরে বাড়তে থাকে তার। অদূরে থাকা কয়েক
ঘর প্রতিবেশী জড়ো হয় খবর পেয়ে। সময়ের সঙ্গে অসুস্থতা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
এ কনকনে শীত রাতে চোখমুখ বের করাই কষ্ট। সাজাই বাজার থেকে একজন পল্লীচিকিৎসকও আসে।
চোখের পর্দা টেনে, হাতের নাড়ি দেখে তিনি বিচলিত হন।
Ñঅবস্থা বেশি ভালা না। সদর হাসপাতাল যাওন লাগব।
সঙ্গে থাকা প্রতিবেশীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। একা মানুষটার রাতেই আবার
কী না কী ঘটে! কিন্তু এখান থেকে সদরে যাওয়া মুখের কথা নয়। সুস্থ মানুষ যেতেই হাঁপ ছাড়তে
হয়। একদিকে অসুস্থ তার ওপর ঠেসে পড়া শীত। কোনো উপায় না পেয়ে সাই বানানো হয়। খবর পেয়ে
আরও কয়েক যুবক চলে আসে। সাইয়ে করে শুইয়ে কাঁধে নিয়ে রওনা দেয় ঘাটমুখে। একটু পরপর ঘাড়
পাল্টায় কাঁধে সাই বহন করা যুবকরা। কত ভার তারা বহন করে। কিন্তু মানুষের এই সাই বহন
যেন অনেক ওজনের। কাঁধপিঠ লেগে আসে বারবার। একটানে সাজাই বাজার পৌঁছায় তারা। সেখানে
আরও কয়েকজন যোগ হয় সাইবহনে। কাঁধ লেগে এলে পরিবর্তন হয় লোক। কনকসা ঘাট যেন লাখো মাইল
দূরের পথ হয়েছে আজ। ফুরাতেই চায় না। এমন এক জনপদ চিকিৎসা নেই, শিক্ষা নেই, যোগাযোগ
নেই। শুধু কিছু দলছুট মানুষ আছে এখানে যাদের মাথায় কোনো ছায়া নেই। প্রসূতির বাড়িতে
খালাস না হলে এ সাই-ই ভরসা। প্রসূতির কষ্ট দেখলে পৃথিবী গুমোট হয়ে আসে। কত মায়ের মৃত্যু
হয়েছে এ সাইয়ে তার হিসাব কে রাখে?
সাইয়ের ওজন ক্রমেই যেন বাড়তে থাকে। এতটুকু মানুষের কতই বা ওজন! ঘাটে
পৌঁছালে বুড়ির কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। হাত-পা আরও ঠান্ডা হয়ে আছে। নদের ঢেউ আছড়ে
পড়ছে ঘাটপাড়ে। ছোটবড় ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে পাড়ে বেঁধে রাখা নৌকাগুলো। সঙ্গে আসা পল্লী ডাক্তার
হাতের নাড়ি টিপে দেখে। শ্মশ্রুমণ্ডিত চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার।
Ñফিরতি পথে সাই ঘোরাও। আর যাওয়ার কাম নাই। হাফিজরে তাড়াতাড়ি খবর দিয়া
আননের ব্যবস্থা করো।