× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্নেহপানি

বর্ণিল রোদ্দুর

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:০৭ পিএম

স্নেহপানি

মৃত্যু ব্যাপারটা ভয়ংকর সন্দেহ নেই। সে মৃত্যু যদি হয় অকালের, যদি সে মানুষটা হয় পরিবারের সবচেয়ে দরকারি, বাকিদের জন্য সে মৃত্যুর ধকল কতটা নিষ্করুণ হতে পারে, ভুক্তভোগী বই অন্য কেউ আন্দাজও করতে পারবে না।

রোশনির যেদিন সার্ভিক্যাল ক্যানসার নির্ণয় হলো, আমার জন্য তা ছিল মাথায় দস্তুরমতো আকাশ ভেঙে পড়া। সুউচ্চ দালান থেকে কেউ আচমকা ছিটকে পড়লে ভাসন্ত ক্ষণগুলো তার যেমন দুঃসহ হয়ে উঠবার কথা, আমার প্রহরগুলো হয়ে উঠল তেমন। রোশনির রোগটা এতটা অ্যাডভান্স স্টেজে ধরা পড়ল, ডাক্তাররা কোনো ভরসা দিতে পারলেন না। তার মানে যমদূত যেকোনো সময় তার দাঁতাল ছোঁ নিয়ে রোশনিকে কবজা করতে ভীষণ বাজের মতো অপ্রতিরোধ্য তীক্ষ্ণ গতিতে নেমে আসবে! আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শব্দবন্ধটা আমার কাছে তখন বড্ড ঝুটামাল মনে হচ্ছিল। চতুর্থ মাসে এসে রোশনি দেহ রাখল।

রোশনি নিজের অফিস সামলে ঘরে ফিরে যেভাবে সংসারের কাজগুলো অনায়াসে সারত, তা দেখে আমি তাকে দশভুজা বলে ডাকতাম। রোশনির মৃত্যুতে তাই বিলক্ষণ জেরবার দশায় পড়ে গেলাম। আমাদের সন্তানটার বয়স এখনও সাত, সবে ক্লাস টুতে পড়ছে; অফিস-ঘরকন্নার শত কাজের মাঝেও অর্ককে নিয়ে রোজ পড়ার টেবিলে বসায় কখনও ব্যত্যয় হতো না রোশনির। এখন কীভাবে কী হবে ভেবে আমার দিশাহীন অবস্থা।

একদিন আমার ছোটবোন রমা বলল, দাদা, অর্ককে তুমি আমার কাছে দিয়ে দাও, এত ছোট্ট একটা বাচ্চাকে তুমি সামলাতে পারবে না। আমার বাচ্চাদের সঙ্গে সে স্কুলে আসা-যাওয়া করবে।

বাচ্চাটা সবে মাকে হারাল, এখন বাবার সঙ্গেও বিচ্যুতি ঘটলে সে বাঁচবে কী করে! অন্যদিকে রোশনিটা অমন অকস্মাৎ চলে গেল, এখন অর্কটাও যদি দূরে চলে যায়, আমারও তো পাগল হওয়া ছাড়া জো থাকবে না। রমাকে ফিরিয়ে দিলাম। তবে অর্কের কথা ভেবে রমার বাসার কাছে বাসা নিলাম। আমি যতক্ষণ অফিসে থাকব, অর্ক রমার বাসায় থাকবে। হ্যাঁ, এভাবেই আমি আর অর্ক নিজেদের নতুন বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে লাগলাম। অর্ককে নিয়ে আমিই বসতে লাগলাম পড়ার টেবিলে। কিন্তু সারা দিন অফিস করে এসে এসবে বেশ পরিশ্রান্ত লাগে। রোশনি এতটা স্ট্যামিনা কোথায় পেত, বলা মুশকিল!

মাস দুই কেটে গেল। টের পাচ্ছিলাম অর্কের পড়ালেখায় অযত্ন হচ্ছে। অর্কের জন্য একজন গৃহশিক্ষক রাখার কথা মনে এলো। পরদিন আমার সর্ব-কাজের-কাজি বন্ধুপ্রবর নাদিমকে ফোন করলাম, দোস্ত, একটা ভালো দেখে গৃহশিক্ষক ঠিক করে দেয় তো, যেন অর্ককে যত্ন করে পড়ায়।

পরের সপ্তায় অফিস শেষ করে বাসার কাছে আসতে দেখতে পেলাম, একটা মেয়ে আমার বাসার দোরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হলাম। কে এই মেয়ে, এখানে কী করছে! বছর কুড়ি-বাইশ হবে বয়স। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের মতো চেহারা। পোশাক-আশাকেও তাই। আমায় দেখে মেয়েটা গা-ঝাড়া দিয়ে সটান হলো। আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির মুখে বলল, আমার নাম চাঁপা। নাদিম ভাই আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাদের নাকি একজন গৃহশিক্ষক দরকার।

মেয়েটার এ কথায় আমি মনে মনে নাদিমের ওপর খুব রুষ্ট হলাম। হ্যাঁ, তাকে একজন হাউস টিউটরের জন্য বলেছি ঠিক, তাই বলে একটা মেয়েকে পাঠাবে এ কাজে! তার বিবেচনাবোধের এমন বেহালদশা কখন হলো! একা একটা পুরুষ আমি এ বাসায়, মেয়েটা কি এ বাসায় ততটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে? মেয়েটার আপত্তি যদি না-ও থাকে, দশজনে কী বলবে? একটা ছেলে শিক্ষক হলে সব দিক থেকেই সহজ হয়। কিন্তু এসব কথা আমি এ মেয়েকে মুখের ওপর কী করে বলব। টিভির চ্যানেল পাল্টানোর মতো এ মেয়েকে দৃষ্টিপথ থেকে একলহমায় সরিয়ে দিতে পারলে যেন বেশ হতো।

চাঁপাকে লিভিংরুমে বসালাম। ছুটা বুয়াটা আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি। বাইরের একটা মানুষ বাসায় এলো, একটু নাশতাপানির আয়োজন নিশ্চয় করা দরকার। অগত্যা আমি হেঁশেলে ঢুকলাম। না, এ কাজ আমি একেবারে পারি না, তা নয়। ছুটা বুয়াটা কোনো দিন না এলে সেদিন কাজটা তো আমাকেই করতে হয়।

আমাকে নাশতা-হাতে প্রবেশ করতে দেখে চাঁপা নিদারুণ অপ্রস্তুত, সে কী, সবে অফিস করে এসে এখনই আবার এসব করতে গেলেন কেন!

আমি সহজকণ্ঠে বললাম, অত ভয় পেতে হবে না, অভ্যেস আছে আমার।

চাঁপা নাশতা নিতে নিতে বলল, আমি কি কাল থেকেই অর্ককে পড়াতে আসব?

ভালো ফ্যাসাদে পড়া গেল। একে যে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছি কী করে তা জানাব! আহা, তা মুখের ওপর বলা যায় নাকি! ধীর গলায় বললাম, আমি কাল-পরশু ফোন করে ব্যাপারটা নিশ্চিত করব।

চারদিকটা বাঁচিয়ে এভাবে উত্তর করতে পেরে স্বস্তি বোধ করলাম। কাল-পরশু নাদিমকে দিয়েও সত্যিটা জানিয়ে দেওয়া যাবে। মেয়েটির পানে চোখ যেতে দেখলাম, ওষুধের কথায় শিশুদের চোখমুখ যেমন পাণ্ডুর হয়ে যায়, এ কথায় মেয়েটি তেমন গুটিয়ে গেল যেন। তবে কি এ কথার নেপথ্যগল্পটা সে অনুমান করে নিতে পারল?

রাতে বিছানায় এসে নাদিমকে ফোন করলাম, নাদিম, এটা তুই কী ধরনের ইয়ার্কি করলি রে! তোকে একটা ছেলে শিক্ষকের কথা বলেছিলাম, তুই একটা মেয়েকে কেন পাঠালি?

নাদিম বলল, সুনির্দিষ্ট করে ছেলে শিক্ষকের কথা বলেছিস মনে পড়ছে না। আর যদি বলেও থাকিস, তোর আক্কেল কেমন বাপু! অর্ককেই তো পড়াবে, তাই না? এ বয়সি একটা বাচ্চাকে কী করে কোনো ছেলে পড়াবে? ধৈর্য রাখতে পারবে? অল্পবয়সিদের জন্য মেয়েরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মেয়েরা হচ্ছে মায়ের জাত, ওদের ধৈর্যের শেষ নেই। এ মেয়েটার সম্পর্কে যতটা জেনেছি, অর্কের জন্য ভালো হবে। শোন, একেই রেখে দেয় অর্কের জন্য। যদিও অর্থ নিয়ে তোর সমস্যা নেই, তাও এ কাজে একটা ছেলে যেখানে সাত-আট হাজার দাবি করবে, এ মেয়েকে পাঁচ দিলেই চলবে।

এসব না হয় বুঝলাম। কিন্তু নারীশূন্য একটা বাসায় এ আসবে, আশপাশের মানুষ নিন্দামন্দ করবে না!

গরজটা তোর। তোর আপত্তি না থাকলে, সে মেয়ের আপত্তি না থাকলে, বাইরের লোকের কথায় কাজ কী। প্রথম দিন অর্ককে পড়াতে এসে চাঁপা জানতে চাইল সপ্তায় কদিন আসতে হবে?

সে আপনি আর আপনার ছাত্র বুঝবেন। বললাম আমি।

চাঁপা মৃদু হেসে বলল, আমি তবে সপ্তায় পাঁচ দিন আসব। আপনার ছুটির দিন দুটো আপনাদের বাপ-ছেলের জন্যই বরাদ্দ থাক।

তেমন কোনো গোলযোগ ছাড়া চাঁপা নিয়ম করে অর্ককে পড়াতে আসতে লাগল। আশ্চর্য, কদিনেই অর্ককে চাঁপা আপন করে নিল। অর্ক এখন বেশ খুশিমনেই চাঁপার কাছে পড়তে বসে।

মাসান্তে আমি চাঁপাকে দক্ষিণা হিসেবে একটা খামে পুরে পাঁচ নয়, আট হাজার টাকাই দিলাম। কেবল মেয়ে বলেই একজনকে ঠকাতে হবে, ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না।

পরদিন একই খামটা নিয়ে চাঁপা হাজির। সসংকোচে বলল, দেখুন, গতকাল খামের ভেতর ভুল করে আপনি আট হাজার টাকা দিয়ে ফেলেছেন।

বুঝলাম যে ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে না বললে এ নিয়ে মেয়েটার অস্বস্তিটা কাটবে না। ভেঙে বললাম। শুনে সে কসেকেন্ড আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমায় বোকা হাঁদারাম ভাবল কি না, কে জানে! সত্যি, আমাদের দেশের মেয়েগুলোর এমন বাজে স্বভাব, নিজেদের ন্যায্য দাবিটা চাইতেও তাদের অনর্থক সংকোচ হয়।

এ বাসায় ইতোমধ্যে চাঁপার সাত-আট মাস হয়েছে। আমার বাসায় আমার বড় খালা এলেন একদিন। রাতে অনুচ্চ গলায় বললেন, অরুণ, অর্ককে পড়াতে আসে যে মেয়েটা, কে রে সে? আমি ঝটপট বললাম, কে আবার, অর্কের প্রাইভেট টিউটর। কেন? খালা শঙ্কাপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, বাপরে, দেখে তো এমন মনেই হলো না! মেয়েটা অর্ককে সারাক্ষণÑএটা এভাবে করতে হয় না বাবা, ওদিকে তাকাতে হয় না বাবা। বাবা-বাবা করতে করতে সারা! লোকে এসব দেখলে কী বলবে শুনি? আমি হেসে বললাম, খালা, এটা এমন কিছু বিষম ব্যাপার নয়। বাচ্চাদের এভাবেই আসলে পড়াতে হয়। ওদের ভালোবাসা দিয়ে না পড়ালে ওরা পড়ায় আনন্দ খুঁজে পায় না। খালার কণ্ঠে তাও উদ্বেগ, তা যেমন বলিস, লোকে শুনলে কিন্তু কেলেঙ্কারি রটাবে। আমি এবার কতকটা জেদি গলায় বললাম, খালা, বাইরের মানুষের চেয়ে আমার ছেলের দাবি আমার কাছে বেশি বড়।

স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় অর্ক অন্য যেকোনোবারের চেয়ে এবার ভালো করল। স্কুল থেকে অর্কের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হলো, অর্কের এমনতর পরিচর্যা যেন অব্যাহত রাখা হয়।

অর্কের এমন রেজাল্টের জন্য আমি চাঁপাকে ধন্যবাদ জানালাম। জবাবে সে কৃতার্থ মুখ করে বলল, অর্কের ব্যাপারে আপনি যেভাবে আমার ওউপর আস্থা রেখেছেন, ধন্যবাদ আসলে আমার দিক থেকে আপনার পাওয়া উচিত।

মাস চারেক পরের কথা। সেদিন অফিসের শেষাশেষিতে আমি হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে কলিগরা আমায় দ্রুত হসপিটালে নিল। কী সব চিকিৎসা আমায় দেওয়া হলো জানি না, বোধহয় সেসবের জেরে কখন যেন ঘুম নেমে এলো আমার চোখে। ঘুম ভাঙল রাত ১০টায়। দেখতে পেলাম, আমার শিথানে বাড়তি দুটো মানুষ বসে আছেÑঅর্ক আর চাঁপা। সবটা গুছিয়ে হসপিটাল থেকে বেরোতে আমার আরও ঘণ্টাখানেক লেগে গেল।

রাস্তায় নেমে মনে হলো, চাঁপাকে তার বাসাতক এগিয়ে দেওয়া উচিত। এত রাতে একা পথে ভয় পাবে। সে কথা চাঁপাকে বলতে তখনই বলল, ভয় করার প্রয়োজন ছিল কি না একেবারে বাসায় পৌঁছে তারপর সেটা ভাবতে বসব। মেয়েটার রসবোধে আমার হাসি পেল। আমায় হাসতে দেখে সে বলল, অসুস্থ কাউকে হাসতে দেখলে ভারি ভালো লাগে। শেষটায় আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, একা তবে যেতে পারবেন? চাঁপা বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়। সব ভয়কে প্রশ্রয় দিতে গেলে মানুষের স্বাভাবিক গতিবিধিই যে নষ্ট হয়ে যায়।

গাড়িতে বসে মনে পড়ল, চাঁপার বাসা কোথায় কতটা দূরে জেনে নেওয়া হয়নি। চাঁপার সম্পর্কে আসলে আমি কিছুই জানি না। তার বাবা-মা কে কী করেন? চাঁপারা ভাইবোন কজন? এমনকি চাঁপা কোথায় কোন বিষয় নিয়ে পড়ছে তারও আমি খবর রাখি না। নাদিম নিশ্চয় এসবের খবরাখবর নিয়েছিল। নাদিমের ওপর ভরসা করে আমি আর এসব নিয়ে কখনও জানতে চাইনি।

নতুন বছরে অর্ক ক্লাস ফাইভে উঠল। এর কিছুদিন পর অর্ককে পড়াতে এসে চাঁপা দৈবাৎ বলল, দেখুন, আমার একটা চাকরি হয়েছে। ব্যাংকে। এক তারিখে আমাকে সেখানটায় জয়েন করতে হবে।

বড় স্বার্থপর মন আমার! এ খবরে কোথায় খুশি হব, মন খারাপ হলো। অবশ্য শিগগির আমি নিজেকে ফিরে পেলাম। মেয়েটার পড়ালেখা শেষ হয়েছে; বয়সটাও ঠিক থেমে নেই; ওর তো এখন জীবনটা গুছিয়ে নেওয়া দরকার। হাসিমুখ করে বললাম, আপনি ভারি বেরসিক মানুষ, চাকরি হয়েছে এমন খুশির খবর কেউ এভাবে ফ্যাকাশে মুখ করে দেয়!

চাঁপা সন্দিগ্ধকণ্ঠে বলল, না, মানে আমি ভেবেছিলাম এ খবরে আপনার মন খারাপ হবে। কারণ আমি আর অর্ককে পড়াতে আসতে পারব না।

ও আমরা সামলে নেব। আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা থাকবে। বললাম আমি।

শেষ দিনটাতে বিদায়বেলায় চাঁপা ভারকণ্ঠে বলল, অর্ককে আমি খুব মিস করব।

যথাসাধ্য সহজ গলায় আমি বললাম, এটাই তো স্বাভাবিক। একজন মানুষের সবচেয়ে সুন্দর গুণ, ভালোবাসার মানুষটার আড়াল হতেই সে তাকে মিস করে।

আমি কিন্তু মাঝেমাঝে অর্ককে দেখতে আসব। বলল চাঁপা।

একদম। নিঃসংকোচে চলে আসবেন। প্রত্যুত্তরে বললাম।

চাঁপার আসা বন্ধ হতে অর্কের ছন্দপতন হলো। কিন্তু আমরা বাপ-ছেলেতে পুরোনো পাপী; জানি যে এমন বিপর্যয় কীভাবে কাটিয়ে উঠতে হয়। ভেজা মাটি শুকোতে খানিক সময় লাগে, কিন্তু শুকোয়। ধীরে ধীরে আমরা এবারও নিশ্চয় নিজেদের ফিরে পাব। চট করে অর্কের জন্য নতুন টিচার রাখলাম না। সে আগে একটু স্বাভাবিক হোক। এ কদিন আমি তার কাছে বসব।

দ্বিতীয় সপ্তায় অর্ককে দেখতে এলো চাঁপা। বিদায়কালে হঠাৎ বলল, ঠিক করেছি, ব্যাংকের চাকরিটা করব না।

চাকরিতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে বুঝি?

না, সে রকম কিছু নয়। আমারই মন বসছে না। জানাল চাঁপা। পরক্ষণে বলল, অর্ককে পড়ানোর কাজটাই আমার ভালো ছিল। আমি ব্যাংকের কাজটা ছেড়ে দেব। আপনি প্লিজ অনুমতি দিন, আমি আগের মতোই অর্ককে পড়াতে আসতে চাই।

এমন পাগলও হয় মানুষ! আমি চাঁপার ব্যাপারটা বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম। সচরাচর যে-কারও নতুন চাকরিতে মানিয়ে নিতে সময় লাগে; উপরন্তু চাঁপাকে এখানে অর্কের প্রতি ভালোবাসার দায়ও শোধ করতে হচ্ছে। প্রথমটায় তাকে তো একটু বাড়তি ভুগতে হবেই। আমি এসব কথা চাঁপাকে শুনিয়ে শেষে বললাম, আমি আপনার এ আবেদন রাখতে পারব না। আপনি আমার শত্রু কেউ হলে পারতাম; আপনার ক্যারিয়ার ভেসে যাক, আমার স্বার্থটা রক্ষা হলে হলো। কিন্তু আপনি দু-আড়াই বছর ধরে অর্ককে যেভাবে সন্তানস্নেহে পড়িয়ে এসেছেন; আপনার ক্ষতি হবে এমন কিছুতে আমি সায় দিতে পারব না।

এই একটা চাকরি ছেড়ে দিলে আমার জীবন ভেসে যাবে বলছেন?

নিজেকে ভুলে গেলে তো চলবে না আপনার। একটা কোনো ভালো চাকরি নিয়ে নিজেকে আপনার এখন গুছিয়ে নেওয়ার সময়। বিলম্বে পিছিয়ে পড়বেন।

আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব! উঠতে উঠতে স্বগতকণ্ঠে বলল চাঁপা।

পরের হপ্তায় ফের এসে হাজির চাঁপা। আজ অনেকখানি ধাতস্থ ও ধীরস্থির মনে হচ্ছে তাকে। কিন্তু কথা শুরু করতে সেই আগের চাঁপা, বিশ্বাস করুন, এ চাকরিটায় আমি মোটেও মন বসাতে পারছি না। কখনও পারব, তাও মনে হচ্ছে না। আপনি দোহাই আমাকে অর্ককে পড়াতে আসবার অনুমতি দিন! সেদিন আপনি নিজেই বলেছেন, আমি এ কটা দিন অর্ককে সন্তানস্নেহে পড়িয়েছি, এখন কেন তবে আবার আপত্তি করছেন?

আমি সেদিনের মতোই অপারগতা প্রকাশ করলাম। চাঁপা আমাকে ঊষর কিছু ভাবছে হয়তো, যার ভেতরটায় দয়ামায়া অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আমি নিরুপায়। সেদিনের যুক্তিগুলো আমি আজ আরও একবার চাঁপাকে শোনাতে আরম্ভ করলাম।

সেসব শুনতে শুনতে চাঁপা আচমকা বলল, সাহস দেন তো একটা প্রস্তাব রাখতে চাই। কতজনই তো তাদের সন্তানকে হোস্টেলে রেখে পড়ায়, আপনি অর্ককে আমার কাছেই দিয়ে দিন না! অর্ক আমার কাছে সন্তানের মতো থাকবে।

আমি আলতো হেসে বললাম, ধরুন, দিলাম। কিন্তু আপনার-আমার স্বজনদের কাছে এর কী জবাব থাকবে?

চাঁপা চুপ মেরে গেল। পটের ছবির মতো স্থির-নিস্পন্দ হয়ে রইল। আমাদের দুজনের মাঝে হঠাৎ অর্ক এসে পড়লে চাঁপা তাকে নিজের কাছে টেনে নিল। আমি উঠে রসুইঘরে চলে এলাম।

আমি নাশতা নিয়ে ফিরে আসতে চাঁপা তক্ষুনি বলল, আপনি তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, আমার মঙ্গলই চান, যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আমি আপনার এ বাসায় এসেও উঠতে পারি। সে ক্ষেত্রেও কিন্তু আমার দুই কূল রক্ষা হয়।

এমন বিস্ফোরকমাখা কথা এমন সহজ কণ্ঠে কেউ বলতে পারে আমার ধারণাতীত ছিল। শুনে এবার যেন আমারই জবান বন্ধ হয়ে গেল। এ মেয়ে নিশ্চয় খেপেছে! নয়তো নিজের জীবনটা কেন এভাবে ফাঁসাতে চাইছে।

আমায় চুপ দেখে চাঁপা পুনশ্চ বলল, ভাববেন না এটা চট করে মাথায় এলো বলে বলে ফেললাম। পুরো একটা সপ্তা এ নিয়ে ভেবেছি আমি। এসে বলব যে সাহস করতে পারছিলাম না। প্লিজ!

আমি নঞর্থক মাথা দোলাতে দোলাতে উঠে পড়লাম। তেমন জোরদার বৃষ্টিতে বর্ষাতিতে যেমন তা আটকানো যায় না, এ পাগলের কাছে বসলে আমি নিজেও পাগল হয়ে যাব নির্ঘাত।

লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে আমি শুনতে পেলাম চাঁপা অর্ককে উদ্দেশ করে ব্যাকুলকণ্ঠে বলছে, অর্ক বাবা, আমি তোমার মা হতে চাই, সত্যিকারের মা, তুমি আমায় মা বলে ডাকতে পারবে না!  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা