আলফ্রেড খোকন
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০১:৪৩ এএম
আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:৪৮ পিএম
প্রতিদিনের বাংলাদেশ সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি।
একজন সাংবাদিক। একজন সম্পাদক। একজন পিতা। একজন স্বামী। একজন বন্ধু। একজন প্রেমিক। একজন চিত্রশিল্পী। যার নির্বাচিত কবিতার বইয়ের মলাট নাম ‘বিরহসমগ্র’। একটা জীবনের আপাতত অর্ধেক ব্যাপ্তিতে, কবি, সাংবাদিক, সম্পাদক, পিতা, স্বামী, চিত্রকর ও প্রেমিকের নামে যা ছড়ানো হলো বিরহ গীতিতে, তা লীন হতেছে কবিতায়; এর মধ্য দিয়েই তার গভীর জীবনোপলব্ধি ও জীবনপ্রণালি ধরা যায়।
তবু কি আমরা তাকে পুরোপুরি ধরতে পারব? স্পর্শে, ছুয়ে দেখায়? না, সেটা হয়তো সম্পূর্ণ সম্ভব নয়। কেবল তাকে উপলব্ধিতে কাছে পাই। আমরা তার কিছু নিজস্ব শব্দ-বাক্য-বন্ধের ফাঁকে তাকে ধরতে যাই। কারণ সে থাকে দূরে, যেটুকু তাকে কাছে পাই তা তো ওইসব বিশেষণ, একজীবনের খেরোখাতায় টুকে টুকে এসব অর্জন নিয়ে সে পথ হাঁটে। সংসার করে। সম্পাদনা করে। কবিতা লেখে। ছবি আঁকে। আঁকে মানুষের মানবিক মানচিত্র। সাজায় তার আকাঙ্ক্ষার বাড়িঘর। আর সে জানে, ‘কাছে যা দেখিতে পাও, দূরে তার বাড়িঘর।’ সেই দূরের বাড়িকে কাছের কোলে আগলে রেখে চাষ করে মায়া। ‘তার জন্যে দুচোখ মেলে জেগে থাকে দিন, জেগে থাকে নক্ষত্রের রাত’Ñ এ সেই কবি যে তার নামের পক্ষে অনেক বিস্তার, শেষ পর্যন্ত যা তিনি ছাড়িয়ে যান। ছড়িয়ে দেন। যেভাবে তিনি ছড়িয়ে পড়েন, তার ভাষায়Ñ ‘মায়া তো মায়াই, যতো দূরে যায়, ততো তার দীর্ঘ হয় ছায়া।’
তাকে টানে সুরমা, সোনাই, কুশিয়ারার বুক বেয়ে বিস্তীর্ণ সন্ধ্যার পাড় ধরে যে হাওয়া এ নগর পর্যন্ত পৌঁছাতে চেয়েও, না পৌঁছানোর পরম বিরহে পার করে নিভৃত মুহূর্তগুলো। দিনান্তে গোধূলির কস্তাপারে, তাকে টানে হাওরের দিন, হাকালুকির পার। তাকে টানে দুপুরের বিরহী ঘুঘুর সুগভীর ডাক। শৈশব সীমান্ত থেকে উত্তাল যৌবনের এই বেদনানিহিত মায়ায়। তাকে টানে, গভীর ভেতর থেকে কে যেন টান দেয়। তাই সে নির্জনতার সঙ্গে একলা যাবে মেঘদুপুরে। তথাপি ভাবে ‘তাকে’ও নিয়ে যাবে। এই ‘তাকে’ দিয়ে তিনি ধরা দেন তার অধরা মায়ায়। কিন্তু তাকে আর কোনো দিনই নিয়ে যাওয়া হয় না। সে তার গোপনান্তে রুয়ে রাখে আশা। আর গিলে খায় একা একা নির্জনতা। আহা! এরকম একটি লোক যদি বন্ধুও হয়, তাহলে? তার বন্ধুতা এসব নির্জনতা এসব একাকী সংসার। ‘নির্জনতা একলা আমায় একলা ডাকে।’ শুধু এ পঙ্ক্তি নিয়ে রচনা করা যাবে দীর্ঘ দীর্ঘতর পথ। নির্জনতা মানে তো একলা, তাই না? একটি পঙ্ক্তিতে নির্জনতা শব্দটি একবার ব্যবহার করার পর যখন দুবার একলা ব্যবহার হয়, তখন নির্জনতা তিনটি মাত্রায় ছড়ায়। এ অপূর্ব ব্যঞ্জনা তার কবিতায় দেখতে হলে হয়তো আমাদের যেতে হবে সেসব নির্জন গাঁয়। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়! তাই কবিতার ভেতর দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। এক বন্ধু কথাসাহিত্যিক লিখেছেন ‘তবুও কিছু মায়া রহিয়া গেল’। এসব রহিয়া যাওয়া মায়া দেখতে হলে যেতে হবে তার কবিতায় গাঁয়ে।
এতক্ষণ নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, কে সেই কবি? তার নাম বলার আগে আরও যা যা বলতে হবে, তা এমন-
‘লাফিং ক্লাবের পাশে জমা রাখি হাহাকার,
এভাবেই বাঁচি, পাড়ি দেই অদ্ভুত আঁধার।’
কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার সারমর্ম এমন যে, ‘অদ্ভুত আঁধার আজ এসেছে পৃথিবীতে, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে তারা।’ এখানে এসে আমরা একজন কবিকে চিনি। আমাদের সেই অন্ধকার সময়কে কীভাবে আলো জ্বালাল, তা ইতিহাস টুকে রাখছে মহাকালের খাতায়।
এমন তো হয় মধ্যযুগের একজন কবির কথাই যদি বলি, ‘মানব লোহায় গড়া, ভিতরে তাহার পাথরে ভরা/আগে তো জানি নে ছাই, ফিরে যাই ফিরে যাই’। আমরা অনেকেই তার নাম বলতে পারব না। কিন্তু মধ্যযুগ থেকে চরম আধুনিক যুগেও তার বেদনার সুগভীর বিস্তার। তা তো সামান্য নয়! আমরা অনেক গীতিকবির নাম জানি না। কিন্তু যখন তার পঙ্ক্তি শুনি শিহরিয়ে উঠি- কে, কে লিখেছেন এই বাণী? তখন খুঁজতে গিয়ে দেখি তার নাম ‘প্রচলিত’। এ প্রচলিত শব্দের বন্ধনে কত কবি এলো গেল, কত কবি আসবে! কিন্তু সেসব বেদনা কবির নয়। আমরা সময়ের কোরকে তাকে মঞ্চস্থ করি কি না করি, তাতে একজন প্রকৃত কবির কী বা আসে যায়? আমাদের যে ক্ষতি হয়, তা আমরা বুঝি তো!
আরেকটি চরণের কথা বলি। ‘মেঘ তুমি উড়ে যাও পরদেশী মেঘ/তোমার ডানায় বাধা হৃদয়ের আবেগ’। তাই তো, আমরা উড়তে পারি না। অ্যারোপ্লেনে চড়ি, আমরা উড়তে পারি না, ঘুড়ির সুতোয় উড়ি। আমরা উড়তে পারি না তাই মেঘের ডানায় উড়ি। এ কবি জানেন শুধু মেঘ নয়, যেকোনো ডানায় আছে আমাদের হৃদয়ের ওড়ার আবেগ।
আরও অন্যরকম করে বলা যায়Ñ‘পুনর্বার যদি তোমার অশ্রু ছুঁয়ে যায় আমার আঙুল/নিশ্চিত জেনো-মৌন তৃণের ভিড়ে খুঁজে নেবো একটি ঘাসফুল।’ আমার কাছে ঘাসফুল মানে ঘাসের ডগায় একটি শিশিরবিন্দু! অশ্রু আর ঘাসের ডগায় ফোটা শিশিরবিন্দু ফুল আমাদের আক্রান্ত করে। আমাদের মধ্যে মায়া বইয়ে দেয়। মায়া মানে সাঁকো। সাঁকো মানে জুড়ে দেওয়া দিন, জুড়ে দেওয়া রাত। সেখানে ফোটে অশ্রুর ফুল, আনন্দেরও। আমরা মায়া করি, মায়া হই। মায়া তবে সন্ধ্যের এলোচুল, যা রাত হয়ে অন্ধকারে জড়িয়ে থাকে।
তার কবিতায় মায়া কখনও ধূসর ভাঁটফুল। আবার কখনও অচিন নদী। অচেনাকে ধরতে গেলে যায় কি তাকে ধরা? এমন সবিস্ময়ে মায়া দাঁড়িয়ে থাকে তার কবিতার ছত্রে ছত্রে, এমনকি তার উজ্জ্বল অবয়বে। যেহেতু আমি কোনো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ লিখব না। তাই এ কথা বলা খুব দুরূহ, তার কবিতার মায়ার মতোই তার অবয়ব। সেখানে ‘হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা/আজও তবে হেসে যাও... কেঁদো না’। এ পঙ্ক্তি কবি কাজী নজরুল ইসলামের। এখানেও সেই মায়া। কবিতা বা জীবন হচ্ছে মায়ার কারখানা। আর এ কারখানার শ্রমিক একজন কবি।
‘কবির কী এসে যায়, তুমি ছাড়া এই বাক্য প্রচারিত হলে’। কবি সেই আলোÑমাঝরাতে মোম যারা জ্বালে, রোগা পায়ে করে পায়চারি, সৃষ্টির দেয়ালে। এমন একজন কবির নাম মুস্তাফিজ শফি। তিনি সৃষ্টির দেয়ালে নানান ভাবে পায়চারি করে মোম জ্বেলে যাচ্ছেন। তার জন্য সমালোচনা তোলা থাকল, অন্য কোথাও অন্য কোনো দিনÑ নগর অথবা গ্রামে; গঞ্জফেরত সন্ধ্যায়। রাতফেরত মধ্যরাতে। কখনও অপরাহ্ণে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যার আঁধারে!
আমি তাকে কবি মনেই পড়েছি। যে কবি দাঁড়ায় মনস্ক সন্ধ্যা কিংবা দুপুরে। যে কবি দাঁড়ায় মানুষের পক্ষে, জীবনের পক্ষে। সে পক্ষ শুক্ল হোক, হোক না কৃষ্ণ। যেকোনো পক্ষই তো জীবনের, সেই জীবনের কবি মুস্তাফিজ।