× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রেখো, মা, দাসেরে মনে

রফিকউল্লাহ খান

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:৪৭ পিএম

রেখো, মা,  দাসেরে মনে

আধুনিককালের মহাকাব্য রচনায় মানুষের প্রবহমান চেতনা প্রকাশের যে ক্ষেত্র মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্যে সৃষ্টি করলেন, তাকে বৈপ্লবিক বললেও কম বলা হয়। শব্দ হচ্ছে কবিসত্তার আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা, গভীরতর সমাজজ্ঞান, অস্তিত্ব-ধারণা, উল্লাস কিংবা ক্রন্দনÑ সবকিছুই শব্দের মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়। এ-কাব্যে মধুসূদনকে স্বতন্ত্র করে চেনা যায় তাঁর শব্দতরঙ্গে, নতুন শব্দ সৃষ্টিতে, উপমাশৃঙ্খলায় এবং বিভিন্ন প্রতীকের নবমাত্রিক ব্যবহারে। অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্বভাব নিরূপণে এ কাব্যের ছন্দকে আমরা বলতে পারি অমিল, প্রবহমান, যতিস্বাধীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। কাব্য-চৈতন্য নিরূপিত ছন্দরীতিও বলে দেয় বাংলা সাহিত্যের একমাত্র সার্থক মহাকাব্যের জৈবসমগ্রতা।

 এক.

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে মেঘনাদবধ কাব্য যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, তখন বাঙালির সাহিত্যপাঠের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশে মধ্যযুগীয় রূপ ও রীতির মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় আধুনিক চৈতন্যের যে ক্ষণিক উদ্ভাসন লক্ষ করি, সেখানে আধুনিক চৈতন্যের পরিচয় তেমন পাওয়া যায় না। সময়ের গতি, সমাজ ও জীবনের পরিবর্তনশীলতার অনুভূতি এবং উপনিবেশিত ব্যক্তিসত্তার মধ্যবিত্তসুলভ দ্বন্দ্ব ও যন্ত্রণাবোধ ঈশ্বর গুপ্তকে আধুনিক রুচির অনেকটা নিকটবর্তী করে তুলেছিল। কিন্তু যে অর্থে কোনো ভাষার সাহিত্য আধুনিকতার চিরায়ত মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারে, বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে তার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বহুকৌণিক দায়বদ্ধতা থেকে মধুসূদন তাঁর এ যুগান্তকারী সৃষ্টিশীল কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এ কাব্য রচনাকালে তিনি বাঙালির সমাজসংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যেমন অঙ্গীকার করেছেন, তেমনি পাশ্চাত্য সাহিত্যপাঠের সুগভীর জ্ঞান ও অনুশীলনকে তার সঙ্গে সমন্বিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যে কারণে মেঘনাদবধ কাব্য পৌরাণিক মহাকাব্যের উপাদানকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক মনের পরিবর্তিত রুচি ও মূল্যবোধে জাগরণের মধ্য দিয়ে শিল্পরূপ লাভ করেছে। সমাজজীবনের জটিল ও দ্বন্দ্বময় বাস্তবতা অঙ্গীকারের সমান্তরালে মধুসূদন আঙ্গিকের পরীক্ষানিরীক্ষা ও তার মান প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁর কাছে বাংলা কবিতার ইতিহাসের এক অসম্পূর্ণতার যন্ত্রণাও বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। উনিশ শতকের সাহিত্যের প্রধান প্রবণতা ছিল রোমান্টিক কাব্য আন্দোলন ও তার অনুসরণ। ওই সময়ের পাশ্চাত্য, বিশেষ করে ইংরেজি কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করলেও এ সত্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে।

কালের রুচি ও চাহিদার প্রতি মধুসূদন দায়বদ্ধ ছিলেন। আবার বাঙালি জীবনে ক্লাসিক সাহিত্যের অসম্পূর্ণতার যন্ত্রণাও তাঁকে নাড়া দিয়েছিল গভীরভাবে। অর্থাৎ রোমান্টিক চেতনার অঙ্গীকার যেমন মধুসূদনের জন্য অনিবার্য ছিল, তেমনি বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিক রীতির নবপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাও তাঁর চেতনাকে আলোড়িত করেছে। এ কারণেই মেঘনাদবধ কাব্যের রোমান্টিক আয়োজন ক্লাসিক গঠনে পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মহাকাব্যসমূহের রূপ ও রীতির অনুধ্যান ও অনুশীলনের পরিচয় মেঘনাদবধ কাব্যে আদ্যন্ত সুস্পষ্ট। এ কাব্যে প্লটবিন্যাস, চরিত্রায়ণ, ভাষারূপ, শব্দচেতনা ও ছন্দবিন্যাসে মহাকাব্যের সংহতি, বিপুলতা, গাম্ভীর্য ও গভীরতার জৈবিক ঐক্য (Organic wholes) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহাকাব্য পাঠের রুচি ও রসবোধ থেকে এ কাব্যে অনুপ্রবেশ এক নতুন শিল্প-অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর বিস্ময় হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর মধ্যে সংস্কৃত, ইংরেজি, গ্রিক, ইতালিয়ান, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতির অধ্যয়ন ও অনুশীলন মধুসূদনের শিল্পচেতনায় যে সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতা এনেছিল, মেঘনাদবধ কাব্যে তার বহুমুখী প্রতিফলন ঘটেছে। কখনও প্রাচীন চিরায়ত কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা, কখনওবা এলিজাবেথান যুগের ইংরেজি সাহিত্যের ট্র্যাজিক চৈতন্যের অঙ্গীকার, আবার কখনওসখনও ইউরোপের রোমান্টিক কাব্যধারার মুক্তচেতনা মধুসূদনের মনকে পরিপুষ্ট ও পরিপূর্ণ করে তুলেছিল। এসব বহুবিধ ধারা অভিন্ন একক আঙ্গিকে রূপদানের সক্ষমতা মধুসূদনের আগে ও পরে আর কোনো বাঙালি কবির মধ্যে দেখা যায় না।

 দুই.

মেঘনাদবধ কাব্যের ঘটনাংশ বা প্লট গৃহীত হয়েছে প্রাচীন ভারতের জাত মহাকাব্য রামায়ণ থেকে। এ বিচারে কাব্যের উপকরণ নির্বাচনের প্রশ্নে মধুসূদনের মৌলিকত্বের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। মধুসূদন নিজেও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। মধুসূদন হয়তো অনুভব করেছিলেন, বাঙালির কাছে যে গ্রন্থটি ধর্মশাস্ত্রের সমতুল্য পঠিত ও চর্চিত হয়েছে, সেই রামায়ণী উপাদানই হতে পারে বাঙালি জীবনের অন্তঃপুরে প্রবেশের অন্যতম পন্থা। উল্লেখ্য, কৃত্তিবাস বাঙালিকে যে রামায়ণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, চেতনাগত দিক থেকে বাল্মীকি-রামায়ণ অপেক্ষা তা বহুলাংশে স্বতন্ত্র। কৃত্তিবাস সংস্কৃত রামায়ণকে বাঙালি পাঠকের উপযোগী করে পুনঃসৃষ্টি করেছিলেন। এ রামায়ণকথাই মেঘনাদবধ কাব্যে সিপাহি-বিদ্রোহ পরবর্তী বাঙালি জীবনের নবচেতনা ও প্রতিবাদী বক্তব্যের বাহন হয়ে উঠেছে। রামায়ণের ঘটনাংশ জাত মহাকাব্যের (Epic of Growth) স্বভাব থেকে উদ্ভূত। মহাভারতের ঘটনাও মানবজীবনের দীর্ঘ পরিসরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। অন্যদিকে হোমারকৃত ইলিয়াড এবং ওডেসিও প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের জাত মহাকাব্যের দুই অনন্য নিদর্শন। মেঘনাদবধ কাব্যের ঘটনাংশ বা প্লট পরিকল্পনায় এ চার মহাকাব্যের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব আবিষ্কার করা সম্ভব। উল্লেখ্য, মহাকাব্যের ঘটনা বিবৃত হয় চরিত্রের আচরণের অনুকরণের মধ্য দিয়ে। এ কাব্যে মধুসূদনের প্লটবিন্যাস কৌশলের মধ্যে ঘটনাংশের সঙ্গে চরিত্র, চরিত্রের আচরণ, উচ্চারণ, সময়সংহতি এক গভীর অন্তঃশৃঙ্খলায় পরিণত। রামায়ণ-মহাভারত কিংবা ইলিয়াড-ওডেসির সময়শৃঙ্খলা মেঘনাদবধ কাব্যের কালের পাঠকের কাছে, এমনকি পরবর্তীকালের পাঠকের কাছে যে গ্রহণযোগ্য হবে না, মধুসূদন তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। যে কারণে ঘটনা বা সময়ের অভিন্ন বিন্দুতে বসে মধুসূদনের মানসসন্তান রাবণের অনুভূতি একই সঙ্গে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে স্পর্শ করে। যেমন কাব্যের প্রথম সর্গে পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর রাবণের যে যন্ত্রণা, ক্রন্দন ও অনুভূতি সেখানে অতীতের ঘটনা ও ক্রিয়ার উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি বর্তমান যন্ত্রণার সমান্তরালে ভবিষৎ ট্র্যাজেডির আশঙ্কাও ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে। মহাকাব্যের এই জীবনধর্ম জাত মহাকাব্যসুলভ নয়, ইউরোপীয় রেনেসাঁ-উত্তর সাহিত্যিক মহাকাব্যের স্বভাবজাত। পুরাণের সৃষ্টি থেকে পুরাণের পুনঃসৃষ্টির শুরু রেনেসাঁসের কালে। সমষ্টি ও সময়ের যন্ত্রণাকে ব্যক্তির আয়তনে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তির বাইরের আচরণ নয়, অন্তর্জগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদিক থেকে বাইবেলিক পুরাণকথা অবলম্বনে জন মিল্টন রচিত প্যারাডাইস লস্ট (১৬৬৭)এর সঙ্গেই কেবল মেঘনাদবধ কাব্যের চরিত্রভাবনা ও জীবনাদর্শের তুলনা করা যেতে পারে। লুসিফার বা শয়তানের যন্ত্রণাবোধ ও সর্ববিদারী হাহাকারের সঙ্গে রাবণচরিত্রের সাদৃশ্য কল্পনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিশয়োক্তি মনে হয়। কারণ প্যারাডাইস লস্টের প্রায় ২০০ বছর পর উপনিবেশিত সমাজের জীবনবাস্তবতা, পরাভবচেতনা এবং ব্যক্তিসত্তার যন্ত্রণা ও ক্রন্দন এ কাব্যকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্য শুরুতেই বর্তমানের ঘটনার সীমা অতিক্রম করে অতীতের ঘটনা ও ঘটনার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে; এবং আত্মকৃত মানবিক বিচ্যুতির উল্লেখ রাবণচরিত্রকে মহিমান্বিত করেছে,

                     হায়, শূর্পণখা,

কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী

             কাল পঞ্চবটীবনে কাল্কূটে ভরা

  এ ভূজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী)

পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি

             আনিনু এ হৈম গেহে?

এভাবেই ক্রমান্বয়ে রাবণ তার অনুভবকে কেবল অতীত ঘটনা ও তার বর্তমান প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে গেছে (হব আমি নির্ম্মূল সমূলে এর শরে!)। এভাবেই সমগ্র মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণের ক্রিয়াত্মক উচ্চারণ কেবল বর্তমানতাকে নয়, তার পরিণামেরও ইঙ্গিত দিয়েছে। যেমন কাব্যের সপ্তম সর্গে পুত্র মেঘনাদের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর ‘রণমদে মত্ত’ রাবণের যন্ত্রণাকাতর অভিব্যক্তি,

যতনে সতীরে তুলি, কহিলা বিষাদে

রক্ষোরাজ বাম এবে। রক্ষঃ-কুলেন্দ্রাণি,

আমা দোহা প্রতি বিধি! তবে যে বাঁচিছি

এখনও, সে কেবল প্রতিবিধিৎসিতে

মৃত্যু তার! যাও ফিরি শূন্য ঘরে তুমি;...

রণক্ষেত্রযাত্রী আমি, কেন রোধ মোরে?

বিলাপের কাল, দেবি, চিরকাল পাব!

সময়ের আয়তনের দিক থেকে মোট তিন দিন এবং দুই রাতের ঘটনা নিয়ে মেঘনাদবধ কাব্য রচিত হয়েছে। প্রথম সর্গের শেষে অস্তাচলগামী দিবসের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ প্রথম সর্গের ঘটনা দিনের। এরপর দ্বিতীয় সর্গ থেকে চারটি সম্পূর্ণ সর্গ এবং আরেকটি সর্গের অনেকটা অংশ ব্যয়িত হয়েছে রাতের ঘটনার বিন্যাসে। দ্বিতীয় সর্গ থেকে ষষ্ঠ সর্গে মেঘনাদের মৃত্যু পর্যন্ত সময়সীমা এক রাতের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। এরপর ষষ্ঠ সর্গের শেষাংশ এবং সপ্তম সর্গে দিনের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। পুরো অষ্টম সর্গই আমাদের প্রাত্যহিক রাত অপেক্ষা গভীরতর রাতের অন্ধকারে নিয়ে যায় পাঠককে। নবম সর্গে মেঘনাদের শেষকৃত্য, মৃতস্বামী মেঘনাদের সহগামী হয়ে প্রমীলার যাত্রা এবং রাবণের বিশ্বমর্মমূল চূর্ণ করা আর্তনাদ ও হাহাকার দিবালোকের সুস্পষ্টতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এ থেকে আমরা বলতে পারি, মধুসূদন প্রথাগত মহাকাব্যের ঘটনাবিন্যাসের শৃঙ্খলা অনুসরণ করেননি। অর্থাৎ ঘটনাংশ বা প্লট তাঁর কাব্যে নবোদ্ভূত চেতনার বহুমুখী বিস্তারেরই নামান্তর। মধুসূদনের মহাকাব্যিক জীবনোপলব্ধির বিপুল অথচ সংহত এ বিন্যাস শিল্পকৃতির দিক থেকে নিঃসন্দেহে অনন্য।

 তিন.

মেঘনাদবধ কাব্য গঠনগত দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী ও অভিনব সংযোজন। কেননা মধ্যযুগের আখ্যানধর্মী কাব্যপাঠের যে অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে, সেখানে শিথিল ঘটনাবিন্যাসের সঙ্গে মন্থর শব্দবিস্তার প্রাধান্য পেয়েছে। আখ্যানকাব্যের গঠনরীতি সম্পর্কে সচেতনতা বাংলা কবিতার ইতিহাসে মধুসূদনপূর্ব আর কারও মধ্যে দেখা যায় না। মধুসূদনের অব্যবহিত পূর্ববর্তী রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরবর্তী নবীনচন্দ্র সেন ও হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আখ্যানধর্মী কাব্যসমূহ বিশ্লেষণ করলে এ ধারণার প্রমাণ মিলবে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য মহাকাব্যের পরিকল্পন বা ধরন (paradigm) অনুসরণ করে মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করেনÑ এ ধারণা বাঙালি সাহিত্য সমালোচকদের মজ্জাগত। এ ধারণা অংশত সত্য। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, মধুসূদন যে যুগে মহাকাব্য রচনা করলেন, তার বহু আগেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়ে গেছে। মধুসূদনের মতো পরিশীলিত, পরিপূর্ণ ও ঋদ্ধ প্রতিভার পক্ষে উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মহাকাব্য রচনা তাৎক্ষণিক কল্পনাবিলাস ছিল না। অত্যন্ত পরিকল্পিত ও পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করেছিলেন। বাঙালির সাহিত্য-ইতিহাসে মহাকাব্য না-থাকার অপূর্ণতাবোধ মধুসূদনের মতো বড় মাপের প্রতিভার মধ্যে যে সৃষ্টি-যন্ত্রণার সূত্রপাতÑ এ কাব্য তারই শিল্পরূপায়ণ। যে কারণে কাব্যের চেতনা ও গঠনরীতিতে অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করে মধুসূদনকে অগ্রসর হতে হয়েছে। মোহিতলাল মজুমদার যথার্থই বলেছেন, ‘মহাকাব্য বা দীর্ঘ কাহিনী-কাব্যের যে গ্রন্থন নৈপুণ্য সর্ব অঙ্গের বিন্যাস-পারিপাট্যে কাব্যের যে সংহতি সুষমাÑ তাহা বোধ হয়, আমাদের সাহিত্যে মেঘনাদবধ কাব্যেই প্রথম।’ সঙ্গত কারণেই ক্ষেত্র গুপ্তও বলেন, ‘মধুসূদনের মেঘনাদবধের গঠনে নিপুণতা আছেÑ সে নিপুণতার ইতিহাস-নিরপেক্ষ রসাবেদন আছে। আবার কাহিনী-কাব্যের এ-জাতীয় নিপুণতা বাংলা কবিতার রাজ্যে অদৃষ্টপূর্ব।’

 চার.

চেতনা ও আঙ্গিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম সর্বাঙ্গীণ আধুনিক সৃষ্টি। এ কাব্য প্রকাশের পর সার্ধশতাব্দীর অধিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সময়ের এ দীর্ঘ দূরত্ব সত্ত্বেও বিষয়বস্তুর চিরন্তনতা ও শিল্পরূপের পরীক্ষানিরীক্ষা ও সাফল্যে আধুনিক মনের কাছে এ কাব্যের বহুমুখী তাৎপর্য এখনও অক্ষুণ্ন। উনিশ শতকের বাংলার সমাজবাস্তবতা, মানব-অস্তিত্বের বহুমুখী সংকট, ব্যক্তিসত্তার জটিল বিকাশপ্রক্রিয়া যেকোনো অনুসন্ধানী পাঠকের কাছেই অপার কৌতূহলের অনুষঙ্গ। মাইকেলের এ কাব্যে জীবন ও শিল্পের এ অভিনব সত্যের প্রকাশ ঘটেছে। বাঙালির মন ও মননে আধুনিকতার দীক্ষার সূত্রপাত মধুসূদনের কালে আর মধুসূদনই ছিলেন কবিতায় সেই আধুনিকতার দীক্ষাগুরু।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা