× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমার চরিত্রেরা

মোহীত উল আলম

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:৫৮ পিএম

আমার চরিত্রেরা

বাদল ল্যাপটপের কি-বোর্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করছে। ‘কেন আপনি আমাকে আমেরিকা পাঠালেন? আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম, আপনার মতো ঘরকুনো থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিয়ে করিনি, বাচ্চাও ফোটাইনি, অথচ আপনি আমাকে বিয়েও করালেন না, দেশসেবাও করতে দিলেন না, পাঠিয়ে দিলেন সুদূর আমেরিকায়! আচ্ছা তা না হয় দিলেন। আমাকে হারিয়ে ফেললেন কেন?’ বাদল আমার সপ্তম উপন্যাস গ্রেনেড-এর ইয়াং নায়ক। আমার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে সে আমার খুব পছন্দের। কিন্তু আজ সে খেপে গেছে, আমার ট্রিটমেন্ট তার পছন্দ হয়নি। সে কি-বোর্ডকে করেছে যুদ্ধক্ষেত্র। তার পরও বাদলকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। এত দিন বলিনি, কিন্তু আজ বললাম, বাদল, তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু আমার ডাকনামও বাদল। সেজন্য তোমার প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব ছিল।

শুধু বাদল একা নয়, গল্প বা উপন্যাস লিখতে গেলেই আমার চরিত্রগুলো চোখের সামনে লাফ দিয়ে ওঠে। ল্যাপটপের কি-বোর্ডের ওপর নাচানাচি শুরু করে। কীভাবে এটা হয় আমি এখনও ধরতে পারিনি। তারা আমার সঙ্গেও কথাবার্তা বলে। আমিও অবাক হয়ে ভাবি, আমারই সৃষ্ট চরিত্র আমার সঙ্গে কথা বলছে, তর্ক করছে, হাসাহাসি, অভিমান কত কিছু করছে। তবে যে ব্যাপারটা মজার, আমি কথাসাহিত্য রচনা করতে গেলে কখনও আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা করে নামতে পারি না। আমি এক মিনিট আগেও জানি না চরিত্রটার নাম কী হবে বা সে কী করতে যাচ্ছে। কি-বোর্ডে আঙুল ছোঁয়ালাম মাত্রই একটা নাম এসে গেল, এসে গেল একটা আঙ্গিক এবং সৃজনশীল ধারাটা যদি তখন প্রবহমান থাকে গল্পটা ক্রমে বলা হতে থাকে। আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে না লিখলে স্বস্তি বোধ করি না। খুব ভেবেচিন্তে একটা গল্পের শুরু থেকে মধ্য-প্রবাহ এবং শেষের ইতি টেনে পুরো গল্পটা আগে মাথার মধ্যে নিয়ে তারপর লিখতে শুরু করব, এটা আমার আজ পর্যন্ত হয়নি। বরং কি-বোর্ডের ওপর আঙুলের সঞ্চালনই যেন ঠিক করতে থাকে চরিত্রের ভাবনা কী হবে, তার সঙ্গে তার নিজের কিংবা অন্য কোনো চরিত্রের সংঘাত কীভাবে তৈরি হবে, কাহিনীর জটিলতার স্বরূপটা কীরকমভাবে জটিল থেকে ক্রমে একটা সুরাহার দিকে যাবে। এসবই যেন কি-বোর্ড এবং আঙুলের সহমর্মিতায় ঝটপট তৈরি হতে থাকে। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম উপন্যাসের লেখক বিমল মিত্র যেমন বলেছিলেন, তিনি লেখেন না, তার কলমই লেখে।

গ্রেনেড ছাড়া আমি আরও আটটি উপন্যাস ও চারটি ছোটগল্পের বই প্রকাশ করেছি। লক্ষ করেছি, নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির বাইরে আমি খুব বেশি যেতে পারি না। কিন্তু কথাটার এখানেই শেষ নয়। আমি আমার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে শত টুকরো করে বিলি করে দিতে পারি। তবে শুধু তো নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে অবলম্বন করে উপন্যাস বা গল্পের চরিত্র পূর্ণাঙ্গ দাঁড় করানো যায় না, লেখকের জানা বা পরিচিত অন্য লোকদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কথা বা বইয়ে পড়া অথবা যেকোনো উৎস থেকে লেখকের কাছে লেখার মালমসলা সরবরাহকৃত হয়। সুকুমার রায় যে অর্থে ‘হ-য-ব-র-ল ছড়াটি লিখেছিলেন, উপন্যাস বা গল্পে আসলে তাই হয়। কোত্থেকে যে কী হয়, আগে বলা যায় না।

মৌমিতা নামে একটা উপন্যাস লিখলাম, এক অধ্যাপক কর্তৃক একজন রাস্তার বেশ্যার ফেলে যাওয়া কন্যাশিশুকে নিজের আশ্রয়ে নেওয়ার গল্প। মৌমিতা একসময় চিত্রশিল্পী হিসেবে দেশে-বিদেশে নাম করতে থাকলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় বিতর্ক উঠল তার মায়ের পরিচয়টা কীভাবে দেওয়া হবে। লেখকমাত্রই এ ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যার সম্মুখীন হয়। একটা বড় প্রেক্ষাপট রেখে সনদ উপন্যাসটা রচনা করতে চেয়েছিলাম আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে মিথ্যাচার চলছে, তাকে আঘাত করে। কিন্তু সাহস হয়নি, তাই উপন্যাসটা আপসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। বহুদিন আগে, স্বাধীনতার পরপর আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘জনপদ নামে একটি জাতীয় দৈনিক বের হতো। সেখানে সাহিত্যসংখ্যায় ‘পিদিম নামে একটি ভয়াবহ গল্প ছাপিয়েছিলাম, যেটায় আড়েঠারে সমকামিতা বিষয় হিসেবে উঠে এসেছিল। মনে আছে গল্পটি পড়ে আমার এক সহপাঠিনী বেজায় রুষ্ট হয়েছিলেন এবং আমাকে স্পষ্ট বলেছিলেন গল্পটি ভালগার। আবার ২০২২ সালে আমার চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘বিকেল মাতোয়ারায় একটি গল্প ছাপালাম ‘শেষ লড়াই শীর্ষক। গল্পটিতে আছেÑ গল্পের নায়িকা তাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত একজন পাঞ্জাবি অফিসারের লিঙ্গ ছেদন করে ফেলে সদ্য কেনা ব্লেড দিয়ে। গল্পটি পড়ে আমার খুব বুঝদার একজন পাঠিকা বললেন, এ ধারার গল্প লিখলে আমার সামাজিক ভাবর্মূতি ক্ষুণ্ন হবে। এ গ্রন্থে ‘হায়েনা শীর্ষক একটি গল্প আছে যেখানে এক সংস্কৃতিমনা জমিদার হিন্দু দম্পতিকে এক পাঞ্জাবি কর্নেল গান পছন্দ করে এ ভাব দেখিয়ে রাতে জমিদারবাড়িতে থেকে ভোরবেলায় স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই খুন করে, হিন্দু হটাও নীতিতে। অথচ গল্পের এ কাহিনীটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা, আমি ঢাকা ক্লাবে বসে আমাদের আড্ডায় অংশগ্রহণকারী একজন পরিচিতের মুখে শুনেছিলাম। এই শহীদ দম্পতিও মাঝে মাঝে বাদলের মতো ল্যাপটপের কি-বোর্ডে দাঁড়িয়ে আমার কাছে মৃদু প্রতিবাদ জানান। এত নিষ্ঠুরভাবে আমি তাদের কেন মারলাম।

যেকোনো লেখকের জন্য এটি একটি বিরাট সংকট। গল্পের লেখককে পক্ষপাতিত্বহীন হতে হয়। আমি এ কাজটি এখনও সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারিনি। এটা আমার বিরাট খামতি। বাদল যেমন মনে করছে তার প্রতি আমি যথাযথ দায়িত্ব পালন করিনি, তেমনি অন্য চরিত্রগুলোও তাই মনে করতে পারে।

নোঙরের শেষ নেই উপন্যাসটিতে আমি চাটগাঁইয়া ভাষা সংলাপের কিছু অংশে রেখেছিলাম। তখন আবিষ্কার করলাম, চাটগাঁইয়া ভাষার লিখিত রূপ দিলে পাঠোদ্ধার করতে স্বয়ং চাটগাঁইয়াদেরই অসুবিধা হয়। তাই ওই সংলাপগুলোর বাংলা তরজমাও করে দিই। এর ফলে উপন্যাসটির শিল্পরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আরেকটা কথা বলে শেষ করি। লেখক হয়তো একটা অর্থ নিয়ে গল্পটা শেষ করলেন, কিন্তু পাঠকের সীমাহীন স্বাধীনতা থাকে গল্পটির মধ্য থেকে নতুন নতুন ইঙ্গিত বা ইশারা বের করার। নিজের ছেলেমেয়েকে বাবা-মা যে চোখে দেখেন, বাইরের লোকদের দেখা তার থেকে ভিন্নও হতে পারে। ঠিক লেখার বেলায়ও তাই। একটি উপন্যাসের ওপর নানানরকম সমালোচনা সমালোচক বা পাঠকই করে থাকেন। লেখক নিজে এতে মর্মাহত, বিস্ময়াহত বা গৌরবান্বিত বোধ করতে পারেন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা