× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বইমেলা : কিছু স্মৃতি কিছু কথা

মৌলি আজাদ

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:২১ পিএম

বইমেলা : কিছু স্মৃতি কিছু কথা

ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। বছরের আর এগারোটি মাসের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এ মাসটি বাঙালির আবেগ ধারণ করে যেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বইমেলা। আমাদের দেশে প্রধান যে উৎসবগুলো রয়েছে তা থেকে বইমেলা যেন এতটুকুও পিছিয়ে নেই। বইমেলার কথা মনে হলেই চোখে ভাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ। যদি ফিরে তাকাই নব্বইয়ের দশকের বইমেলার দিকে, দেখব তখন বইমেলার রূপ ছিল একেবারেই আলাদা। তখন বইমেলা হতো কেবল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই। আর টিএসসির সামনের রাস্তায় বিক্রি হতো ভারতীয় বাংলা বই থেকে শুরু করে নানা মনিহারি পণ্য। আজকের বইমেলার মতো এত সিকিউরিটির ব্যবস্থাও তখন ছিল না। তবে সব কালেই লেখক-পাঠক সবাই বইমেলার প্রতিটি দিন, মুহূর্ত উপভোগ করেন।

করোনা মহামারির সময় বইপ্রেমীরা সবচেয়ে বেশি মিস করেছেন বইমেলা, তাই না?

যারা জনপ্রিয় লেখক তারা তো বইমেলার মাসটি বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার কথা বোধ করি চিন্তাও করতে পারেন না। বইমেলার প্রতিটি স্টলে থাকে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। লেখকের চারপাশে থাকে অটোগ্রাফ শিকারিরা। কিছু কিছু স্টলের সামনে থাকে পাঠকের সারিবদ্ধ লাইন। যারা তরুণ লেখক, তাদের বইমেলার সময় মনের ভেতর কী অবস্থা থাকে, তা সেই তরুণ লেখক ছাড়া আর কে বোঝে? আর কেউ যদি অটোগ্রাফের জন্য তার দিকে বইটি বাড়িয়ে দেয় তখন তরুণ লেখকের মনের অনুভূতি হয় শূন্যে উড়ে যাওয়ার মতো। তরুণ লেখকদেরই প্রকাশিত বই নিয়ে বুকের ভেতর যে তোলপাড় হয়, তা কিন্তু নয়। যারা অনেক দিন ধরে লিখছেন তাদেরও বই নিয়ে ভালো লাগা ও চিন্তা দুটোই কাজ করে।

কিন্তু দুঃখের কথা হলো, আমাদের দেশে যত বই বের হয়, পাঠক তত নেই। পাঠকের চেয়ে কয়েকজন লেখকের ভক্ত তৈরি হয়। ইদানীং আমরা যারা লিখছি (নামকরা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকসহ) তারা নিজেদের বইয়ের প্রচার নিজেরাই করেন। এখন আর আগের মতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া বা বই নিয়ে লিফলেট প্রকাশের প্রয়োজন হয় না। এখন আমরা আমাদের প্রকাশিত বইয়ের প্রচার চালাই সমাজমাধ্যমে বা ভিডিওতে। আমাদের প্রচারকে পুনঃপুন শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় আমাদের ভক্ত-অনুরাগীরা। ভক্তরা ফেসবুকে বইয়ের পোস্টে যতখানি লাইক/কমেন্টস/শুভকামনা জানায়, ততটা কি বই কেনে? আজকাল নিজের ঢোল নিজে বাজানো যেন প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। তবে লেখকের দোষ কী? যুগটাই যে এখন এমন!

তবে এটা ঠিক, লেখকের উপস্থিতিতে পাঠক বই কিনতে চায়। হয়তো অটোগ্রাফের আশায়। সব লেখকের নির্দিষ্ট কয়েকজন পাঠক তো থাকেই, সেই সঙ্গে বইমেলায় তৈরি হয় নতুন নতুন পাঠক। পাঠক পেলে লেখকের যেমন ভালো লাগে, পাঠকের কি লেখকের সঙ্গ কম ভালো লাগে? মোটেও নয়।

ইদানীং বইমেলা শুরুর আগেই দেখছি অনেক লেখকের বই প্রি-অর্ডারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এতে বিকিকিনি হয়তো বাড়তে পারে, কিন্তু বইমেলা থেকে পাঠকের বই কেনার ইচ্ছা বা যে আনন্দ থাকে তা প্রি-অর্ডারে কিনলে বোধ করি থাকে না। ঢাকা শহরের ভিড়বাট্টা এড়িয়ে চলার জন্য সবকিছুই তো আমরা ‘টেকঅ্যাওয়ে সিস্টেমে নিয়ে এসেছি। বই হয়তো এর বাইরে থাকলেই ভালো।

বইমেলা চলাকালে পড়ে পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইন্স ডে। অন্য দিন বই নেড়েচেড়ে দেখলেও সেদিন প্রায় সবাই তার প্রিয় মানুষকে পছন্দের বইটিই কিনে দেয়। এতে ভালোবাসার সঙ্গে যুক্ত হয় চমৎকার একটি অভ্যাস। তা হলো, বই কেনা ও উপহার দেওয়া।

বইমেলা নিয়ে যখন ভাবি বা লিখি তখন কেন যেন বুকের ভেতরটা খচখচ করে। কিন্তু কেন? বিষাদের কারণটা খুব সহজ।

আমার বাবা প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের জীবনের আনন্দের একটি অংশই ছিল এ বইমেলা। পুরো সময় তিনি বইমেলায় থাকতেন। ভালোবাসতেন কেবল বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে। বারো মাসই চলত তার লেখালেখি আর পড়াশোনা। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বাবার কর্মব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। লিখতেন একের পর এক বই। নিজেই কম্পোজ করতেন। প্রুফ রিডিং হয়ে আসার পর আবার সেটা চেক করতেন। প্রচ্ছদের বিষয়ে খুব বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন। প্রচ্ছদশিল্পীর সঙ্গে প্রচ্ছদ নিয়ে বারবার আলোচনা করে একটা ফাইনাল প্রচ্ছদ দাঁড় করাতেন। বই বের হওয়ার আগে পরিবারের কারও সঙ্গে তিনি বই নিয়ে আলোচনা করতেন না।

বইমেলা শুরুর পর দিনই পেতাম বাবার অটোগ্রাফসহ বই। বাবা বই দেওয়ার পর বলতেন, ‘বই পড়ে বলিস তো, তোর কেমন লেগেছে?’

বাবা সাধারণত কোথায় যাচ্ছেন তা বাসায় কাউকে বলে যেতেন না, আমরা নিজেরা অনুমান করে নিতাম। বইমেলার সময় আমাদের অনুমান করতে অসুবিধা হতো না তিনি কোথায় আছেন। আমরা নিশ্চিত থাকতাম, বিকাল থেকেই তিনি আছেন বইমেলায়। মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো বইমেলায় তিনি কেন এত আনন্দ পান? এ সময় তাকে অন্য কোথাও কেন নেওয়া যায় না? একজন লেখক যিনি অবিরাম নানা বিষয়ে লিখছেন, তার কাছে বইমেলা ছাড়া প্রিয় স্থান আর কী-ই-বা হতে পারে!

বাবা তো তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না! কিন্তু তার ছিল অসংখ্য অনুরাগী। তার কারণ একটাই ছিল, তার সত্যভাষণ। যতই সমালোচিত হোন না কেন সত্য বলতে ও লিখতে তিনি কখনও দ্বিধা করতেন না।

বইমেলা মানেই প্রচুর তরুণ পাঠকের মুখোমুখি হওয়া, বই নিয়ে তাদের সঙ্গে তর্কে মেতে যাওয়া। বাবাকে দেখেছি সেসব উপভোগ করতে। প্রথম দিকে তিনি সারা বইমেলা হেঁটে বেড়াতেন, কিন্তু একটা পর্যায়ে নিয়মিত আগামী প্রকাশনীর স্টলে বসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বইমেলার প্রাঙ্গণকে খুব বেশি নিরাপদ স্থান মনে করতেন তিনি। সাহস তো তার বরাবরই একটু বেশি ছিল, তাই ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ উপন্যাসটি ইত্তেফাকে বের হওয়ার পর অনেকে তাকে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। হিংস্র মানুষরূপী পশুগুলো সে সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছিল।

২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বাবাকে না-ফেরার দেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা। বাবার রক্তে লাল হয়েছিল বইমেলার সামনের সড়ক। বাবা সেদিন বই দিয়েই নিজের মাথাটি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। রক্তে ভেসে গিয়েছিল তার শরীর, কিন্তু তিনি কাঁদেননি, ভয় পাননি, পুলিশের গাড়িতে হাসপাতালেও যেতে চাননি। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি তিনি।

২০০৪ সালের পর থেকে বাবা আর বইমেলার কোথাও নেই। মনে মনে ভাবি, সত্যিই কি বাবা নেই এখানে? বাবা সশরীরে বইমেলায় নেই বটে, কিন্তু তার বইগুলো আর তার গভীর চিন্তাগুলো তো বইয়ে আছেই। চিন্তাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে তার পাঠকের মধ্যে।

বছর ঘুরে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলাও এসে গেল। হ‍ুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ যারা বাংলা সাহিত্য বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, পাঠককে বইয়ের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের পদচিহ্ন খুঁজলে বাংলা একাডেমির বইমেলায় আজও হয়তো পাওয়া যাবে। পাঠক বর্তমান লেখকের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও খুঁজে ফিরবেন বইমেলার মাঠে।

বইমেলার এক মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থাকবে মুখরিত। চলুন ফেব্রুয়ারি মাসটা বাংলা একাডেমির বইমেলায় থাকি। বইয়ের সঙ্গে থাকি।  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা