রফিকউল্লাহ খান
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:২৮ পিএম
বাঙালিজীবনে ট্র্যাজিক প্রেমের আদর্শরূপ হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
দেবদাস ও পার্বতীর আধিপত্য শতবর্ষব্যাপী। যদিও একটা বয়সের মধ্যেই তার গতিবিধি। বাঙালির
অক্রিয় (passive) স্বভাবের সঙ্গে দেবদাস-পার্বতীর প্রেম ও তার আত্মবিনাশী পরিণতির মিলই
সম্ভবত এর অন্যতম কারণ। ২০১৭ সালে ‘দেবদাস’ উপন্যাস প্রকাশের
শতবর্ষ পূর্ণ হয়। কিন্তু গ্রাম ও শহরের ব্যবধানের সমান্তরাল দেবদাস ও পার্বতীর করুণা-আশ্রিত
প্রেমের প্রাসঙ্গিকতা তরুণ মন থেকে এত দিনেও মুছে গেছে বলে মনে হয় না। অতি-আবেগী ব্যক্তির
প্রত্যাশার অপ্রাপ্তিজনিত আত্মক্ষয় কেবল দেবদাসের নয়, বাঙালি তরুণ-তরুণীর স্বভাবের
সঙ্গে অনেকটাই মিলে গেছে। গ্রামীণ জীবনের সচ্ছল পরিবেশে বেড়ে ওঠা পার্বতী ও দেবদাসের
প্রাথমিক সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই অগ্রসর হয়েছে। এ ধরনের কিশোর-কিশোরী আমাদের
সমাজকাঠামোয় এখনও প্রচুর। শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব এখানে যে, বিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত
জীবনের সীমারেখা তিনি সমাজের এমন এমন ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করলেন, যা আগে দেখা যায়নি।
তিনি সামাজিক সমস্যা, সংকট-জিজ্ঞাসা ও তার সংবেদনশীল পরিপ্রেক্ষিত নগর জীবনের তলদেশে
এবং গ্রামীণ জীবনের কেন্দ্রমূলে সম্প্রসারণ করে এমন কিছু চরিত্র আবিষ্কার করলেন, যেগুলো
বাঙালি পাঠকের আত্মরূপের প্রতিচ্ছবি হয়ে দেখা দিল। দেবদাস ও পার্বতী সে-জাতীয় চরিত্রের
চিরায়তিক আদর্শ হয়ে উঠল। নাগরিক সংস্কৃতি থেকে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি পর্যন্ত তার
উপন্যাসের বিষয়ের পরিধি যেমন বিস্তৃত, তেমন চরিত্রগুলোও এসব পরিস্থিতি থেকে উত্থিত।
প্রেমের বিশ্লেষণ তার কাছে গুরুত্ববহ ছিল না, প্রেমের পরিণতিই তিনি বড় করে দেখলেন।
সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথাগত সংস্কারসমূহের তীক্ষ্ণ সমালোচনা কোনো কোনো উপন্যাসে প্রকাশ
পেলেও, নরনারীর পরস্পর সম্পর্কের আবেগঘন বিন্যাস শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের মাধ্যমে বাঙালি
পাঠকের মনোজগৎ প্রবলভাবে আলোড়িত করতে সমর্থ হয়। বাঙালি জীবনের সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর
প্রসঙ্গ তার উপন্যাসকে কেবল পাঠকপ্রিয়ই করেনি, উপন্যাসের অনেক চরিত্রও ব্যক্তি-অনুভবের
প্রতীকে পরিণত করেছে। দেবদাস কিংবা পার্বতীকে বাঙালি তরুণ-তরুণীরা অনেকটা সেই দৃষ্টিকোণ
থেকেই দেখবে বলে আমার ধারণা।
বিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্তের যে জীবনসত্য শরৎচন্দ্রের অন্বিষ্ট ছিল,
সেখানে বহির্জীবনের সক্রিয়তা অপেক্ষা মনোজগতের সক্রিয়তাই প্রাধান্য পেয়েছে। তার উপন্যাসের
গ্রামীণ পরিপ্রেক্ষিতে বেড়ে ওঠা দেবদাস ও পার্বতী সম্পর্কে এ সত্য আরও বেশি প্রযোজ্য।
নাগরিক রুচির সঙ্গে সঙ্গে আর্থসামাজিক বিকাশের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে মানবীয় সম্পর্কও
যে বাধাগ্রস্ত হয, দেবদাস ও পার্বতীর প্রেমের পরিণতি তার দৃষ্টান্ত। বাঙালি মধ্যবিত্তের
যে ব্যাপক অংশ গ্রামের ভূসম্পত্তির মালিকানা থেকে উদ্ভূত হয়েছে দেবদাস বহুলাংশে তাদের
প্রতিনিধি এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার
মতো দেবদাসও সামন্ত আর্থ-উৎপাদন ব্যবস্থার সচ্ছল বৃত্তের অধিকারী। নাগরিক জীবন সে যাপন
করলেও নাগরিক ব্যক্তিত্ব তার গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে সামন্ত আভিজাত্যবোধ থাকলেও মূলত সামন্ত
মূল্যবোধের নেতিবাচক দিকগুলো তার বিশ্বাস, সংস্কার ও মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ কারণে
জীবনের বস্তুগত চাহিদার পরিবর্তে ভাবগত সত্যই সে আন্তরিকভাবে গ্রহণ এবং আত্মক্ষয়ী পরিস্থিতির
মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। গ্রামের প্রাত্যহিক আটপৌরে জীবনের মধ্যে পার্বতীর সঙ্গে সম্পর্কটাই
একটু ভিন্ন মাত্রা নিয়ে দেখা দিয়েছে। ‘দিনের পর পর দিন যায়Ñএ দুটি বালক-বালিকার আমোদের
সীমা নাইÑসমস্ত দিন ধরিয়া রোদে রোদে ঘুরিয়া বেড়ায়, সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসিয়া মারধর
খায়, আবার সকালবেলায় ছুটিয়া পলাইয়া যায়Ñআবার তিরস্কার-প্রহার ভোগ করে। রাত্রে নিশ্চিন্ত-নিরুদ্বেগে
নিদ্রা যায়; আবার সকাল হয়, আবার পলাইয়া খেলা করিয়া বেড়ায়। অন্য সঙ্গীসাথী বড় কেহ নাই
প্রয়োজনও হয় না।’ (তৃতীয় পরিচ্ছেদ)। এ নিরুদ্বিগ্ন নির্দ্বন্দ্ব
সম্পর্কায়নে কোনো জটিলতাও নেই। কিন্তু সম্পর্কের গুরুত্ব ও জটিলতা তখনই প্রবল হতে থাকে
যখন দেবদাসকে ‘পড়াশোনা’ করার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
এর ফলে দেবদাস ও পার্বতীর অভ্যাসগত জীবনের ছন্দপতনের সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরের সম্পর্কের
মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হলো। সূক্ষ্ম গভীর প্রেম বলতে যা বোঝায় তার কোনো লক্ষণ ছাড়াই
তাদের কৈশোরক আবেগ একে অন্যকে অনুভব শুরু করে। ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’-এর পরিবর্তে
প্রথম অদর্শনে তাদের প্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হলো। দেবদাস কলকাতায় চলে গেলে ‘...পার্বতীর
কত কষ্ট হইল; কত চোখের জলের ধারা গাল বাহিয়া নীচে পড়িতে লাগিল; কত অভিমানে তাহার বুক
ফাটিতে লাগিল। প্রথম কয়েকদিন এইরূপে কাটিল। তাহার পর হঠাৎ একদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া দেখিতে
পাইল, সমস্ত দিনের জন্য তাহার কিছু করিবার নাই।’ (চতুর্থ পরিচ্ছেদ)।
অন্যদিকে কলকাতা বসবাসের ফলে দেবদাসের স্বভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দিল। আগে তার
যেসব ‘গ্রাম্যতা-দোষ’ ছিল, শহরে বাস করার ফলে সেগুলো একেবারেই
বিদায় নিল। ‘গ্রামের নদীতীরে বেড়াইতে আর সাধ যায় না; বরং তাহার পরিবর্তে বন্দুক হাতে
শিকারে বাহির হইতেই আনন্দ পায়। ক্ষুদ্র পুঁটিমাছ ধরার বদলে বড় মাছ খেলাইতে ইচ্ছা হয়।
শুধু কি তাই? সমাজের কথা, রাজনীতির চর্চা, সভা-সমিতিÑক্রিকেট, ফুটবলের আলোচনা! হায়
রে! কোথায় সেই পার্বতী, আর তাহাদের সেই তালসোনাপুর গ্রাম! বাল্যস্মৃতিজড়িত দুই-একটা
সুখের কথা যে মনে পড়ে না, তাহা নয়Ñকিন্তু নানা কাজের উৎসাহে সে-সকল আর বেশীক্ষণ হৃদয়ে
স্থান পায় না।’ কিন্তু দেবদাসের বাইরের কর্মব্যস্ত জীবনের পরিচয় শরৎচন্দ্রের
কাছে তাৎপর্যহীনই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। পার্বতীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিয়ে কেন্দ্র
করেই উভয়ে সম্পর্কের চরম সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়। প্রথাগত সামাজিক জটিলতা অপেক্ষা দেবদাসের
জমিদার পিতার পারিবারিক অহং এবং অনেকটা দেবদাসের নিষ্ক্রিয়তার ফলেই পার্বতীর সঙ্গে
শেষ পর্যন্ত দেবদাসের বিয়ে হয় না। দেবদাস এ পর্যায়ে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে, ‘পার্বতী
তাহার সেই একঘেয়ে গ্রাম্য-জীবনের মধ্যে নিশিদিন শুধু তাহাকেই ধ্যান করিয়া আসিয়াছে।
শুধু তাই নয়। সে ভাবিত ছেলেবেলা হইতে যাহাকে নিতান্ত আপনার বলিয়াই জানিয়াছিল, ন্যায়-অন্যায়
সমস্ত আবদারই এতদিন যাহার উপর খাটাইয়া লইয়াছে, যৌবনের প্রথম ধাপটিতে পা দিয়াই তাহা
হইতে এমন অকস্মাৎ পিছলাইয়া পড়িতে হইবে না।’ (পঞ্চম পরিচ্ছেদ)।
বয়স্ক জমিদারপাত্রের সঙ্গে বিয়ের কথা চূড়ান্ত হওয়ার পর এক গভীর ম্লান জ্যোৎস্নারাতে
পার্বতী দেবদাসের ঘরে উপস্থিত হয় এবং আত্মনিবেদন করে : ‘দেবদা, নদীতে কত জল। অত জলেও
কি আমার কলঙ্ক চাপা পড়বে না?’ কিন্তু শেষবারের মতো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে দেবদাস। পিতার
অনুগত সন্তানের মতো আত্মরক্ষার পন্থা হিসেবে পালিয়ে যায় গ্রাম থেকে। পত্রে পার্বতীকে
জানিয়ে দেয় বিয়েতে অক্ষমতার কথা। সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূলতা অপেক্ষা দেবদাসের
অবজ্ঞা-অবহেলায় কিছুকালের জন্য হলেও পার্বতীর মধ্যে এক ব্যক্তিত্বময়ী নারীর জন্ম দেয়।
তার এ অপুষ্ট ব্যক্তিত্বের ক্ষণকালীন প্রকাশই দুই নারী-পুরুষের জীবনের মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডির
কারণ হয়ে ওঠে। পার্বতীর বিয়ের আগে দেবদাস পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দিলে নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যান
করে পার্বতী : ‘তোমাতে কিছুমাত্র আমার আস্থা নেই। ... আমার মা-বাপ আমার মঙ্গল কামনা
করেন; তাই তাঁরা তোমার মত একজন অজ্ঞান, চঞ্চলচিত্ত, দুর্দান্ত লোকের হাতে আমাকে কিছুতেই
দেবেন না। তুমি পথ ছেড়ে দাও।’ সে আরও বলে, ‘তোমার রূপ আছে গুণ নেইÑআমার
রূপ আছে, গুণও আছে। তোমরা বড় লোক, কিন্তু আমার বাবাও ভিক্ষে করে বেড়ান না।’ (অষ্টম পরিচ্ছেদ)।
কিন্তু লোকায়ত প্রেমের এই নাগরিক তীব্রতা যে কতটা অসার পার্বতী ও দেবদাসের পরিণতি তাকেই
যেন প্রমাণ করেছে। দেবদাস মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পুরো প্রেম ও তার ব্যর্থতাজনিত যন্ত্রণাভার
বহনের দায় যেন সম্পূর্ণরূপে পার্বতীকেই অর্পণ করে। সে কেবল অপেক্ষা করবে প্রেমের ঋণ
শোধ করার জন্য। কর্ম দিয়ে নয়, চরম দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে।
দেবদাস-পার্বতীর মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের জীবন ও প্রেমের ভাবরূপ শরৎচন্দ্র
যে দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন, তা আগেকার কোনো লেখকের মধ্যে দেখা যায়নি। এ ধরনের
অক্রিয় চরিত্রের প্রতি বাঙালি মানসের আকর্ষণ চিরকালীন। দেবদাস-পার্বতীর প্রেমের মধ্যে
এ কারণেই আত্মরূপ প্রত্যক্ষ করে পাঠক। ব্যক্তিসত্তার স্বাধীন বিকাশের প্রশ্ন বাঙালি
জীবনের পরিবর্তনের ধারায় রবীন্দ্রনাথ বারবার উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিসত্তা
বিকাশের উপযোগী সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ফলেই
দীর্ঘকাল বিঘ্নিত হয়েছে। এ অপুষ্ট সমাজ-সংস্কৃতি ও তার অন্তর্গত মানব-মানবীকে গভীর
অভিনিবেশ ও তাৎপর্যের সঙ্গে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন শরৎচন্দ্র। ব্যক্তিত্বের মূল
থেকে উৎসারিত কোনো সমস্যা নয়, বরং তাৎক্ষণিক আবেগজাত সংকটই শেষ পর্যন্ত তার চরিত্র-পাত্রের
জীবনের করুণ পরিণতি ত্বরান্বিত করেছে। যে কারণে দেবদাস-পার্বতীর প্রেম সারা জীবনের
আবেগ-মননের তপস্যা না হয়ে বয়ঃসন্ধির করুণ ক্রন্দনে রূপায়িত হয়েছে।