সৈকত হাবিব
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৪৪ পিএম
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:০৩ পিএম
বাঙালির এমন প্রেমিকা কি আছে আর?
বনলতা সেনের মতো!
পৌনে এক শতাব্দী ধরে তিনি আছেন আমাদের মানসলোকেÑঅজৈব, শরীরহীন, তবু
তীব্র শরীরী। কারণ আমাদের অন্তর্লোককে এমনভাবে প্লাবিত করার ক্ষমতা এমনকি কোনো জীবন্ত
নারীর চেয়েও তার অনেক বেশি। যদিও তিনি পৌরাণিক কোনো দেবী বা নারী নন, ইতিহাসে তার কোনো
উল্লেখ নেই। এমনকি আশি বছর ধরে অনুসন্ধানী কবি-লেখক-গবেষকরা তার কুলপরিচয় আবিষ্কারের
জন্য হন্যে হয়েও কোনো রহস্য ভেদ করে উঠতে পারেননি। যদিও কবি তার ঠিকানা সুনির্দিষ্ট
করে দিয়েছেন ‘নাটোরের বনলতা সেন’ বলে। কিন্তু মনে হয় না এ নাটোর পৃথিবীর
কোনো বাস্তব, বরং মনে হয় কবিতার নায়িকা ও নাটোর উভয়েই অপার্থিব, চিররহস্যময়। অপার্থিব,
কেননা তার পার্থিব অস্তিত্বের নাগাল এখনও মেলেনি, কেবল দুয়েকটি অনুমান ছাড়া; চিররহস্যময়,
কারণ আজও তিনি এক অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই আমাদের অন্তরে বিরাজ করছেন।
আদতে বনলতা সেন তো একজন কবিরচিত কবিতার নায়িকা, কিন্তু আমাদের বিশ্বাসই
হতে চায় না যখন কবিতাটি আমরা পড়ে উঠি। কবিতাটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের অনুভূতিতে
এত তীব্র অভিঘাত তৈরি করে যে, একেবারে বিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়। মনে হয়, এ নারী আমাদের এমন
এক অন্তর্গত সত্তা, যাকে হয়তো আমরা স্বপ্নলোকে খুঁজে ফিরেছি। তৎক্ষণাৎ তিনি হয়ে পড়েন
আমাদের চিরকাঙ্ক্ষিত নারীটি, যার সঙ্গে যেন আমাদের জীবনের হাজার বছরের লেনাদেনা।
যখনই কবি বলেন, ‘হাজার বছর ধ’রে আমি পথ
হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’, এবং ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে
জীবনের সমুদ্র সফেন’, আর তারপর ‘আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল
নাটোরের বনলতা সেন’। এক আশ্চর্য রসায়ন ঘটে আমাদের ভেতরে।
আমরা নিজেরাই পরিণত হই সেই মহাপরিব্রাজকে যার হাজার বছরের পথপরিক্রমা ইতোমধ্যে ঘটে
গেছে। আমরা ‘সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে’, ‘বিম্বিসার
অশোকের ধূসর জগতে’, ‘দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে’ ঘুরে ঘুরে
ক্লান্ত, যদিও জীবন চারদিকে সমুদ্রফেনার মতো উদ্ভাসিত। কিন্তু এ ক্লান্তি দূর হয়ে যায়
যখন আমরা বনলতা সেনের কাছে এসে দুই দণ্ড শান্তি পাই। তবে এ দুই দণ্ডও বহুকাঙ্ক্ষিত,
কেননা এ নারী তো সাধারণ নারী নন। কারণÑ
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’
আর অন্ধকারে আমরা তাকে দেখি, যেন
‘অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর’, তেমনভাবে।
আর পরক্ষণেই, চিরকাঙ্ক্ষিতার মতোন তিনি ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ জানতে চান,
‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
এ যেন তাপিততৃষ্ণার্ত প্রেমিকপুরুষের জন্য আশ্চর্য স্বর্গীয় প্রেমবৃষ্টি।
যেন বনলতা সেনও বহুকাল ধরে অপেক্ষমাণ, যা প্রেমিকহৃদয়কে দেয় কোমল আশ্রয়। এভাবে বনলতা
সেন বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষের চিরকাঙ্ক্ষিত নারী হয়ে ওঠেন। তাই কবিপুরুষটির কণ্ঠে ফুটে
ওঠে :
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসেÑ সব নদীÑ ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
এই যে ‘মুখোমুখি বসিবার’ জন্য এত আয়োজন,
সে তো জীবনের প্রগাঢ় পিপাসা, ভালোবাসার নারীর সান্নিধ্যলাভের চিরব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা।
তাই বনলতা সেন হয়ে ওঠেন আমাদের চিরবাঞ্ছিতা।
জীবনানন্দ তার ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় বলেন
:
আমার হৃদয়Ñ এক পুরুষহরিণÑ
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয়Ñ চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমাকে কি চায় নাই ধরা দিতে?’
আমাদের পুরুষহৃদয় এভাবেই ধরা দিতে চায়, যদি নারীটি হন বনলতা সেনের
মতো। আর জীবনানন্দ এখানেই এক অসাধ্য সাধন করেছেন। ‘বনলতা সেন’ কবিতার ভেতর
দিয়ে তিনি এমন এক নারীপ্রতিমা তৈরি করেছেন, যিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের চিরকালের প্রেমিকা,
চির-আরাধ্য নারী। একজন কবির কবিতা থেকে উঠে এসে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে আমাদের অন্তরগহনে
প্রবেশ করে হয়ে উঠেছেন আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ।