সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৫৩ পিএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৯ পিএম
ফাইল ফটো
চলতি বছরের ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান (অনুশীলন) বইয়ের ৮৭ পৃষ্ঠায় ‘চাঁদ ও সূর্যের পালা’ শিরোনামের নিবন্ধে লেখা হয়েছে ‘অভিশপ্ত চাঁদ’। এটি সংশোধন করে ‘চাঁদের গল্প’ নাম দেওয়ার সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি।
একই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৮ পৃষ্ঠার ১৩ নম্বর পঙ্ক্তিতে ‘ততদিনে বালক মুজিব পরের জন্য খাটায় উৎসাহ পেয়ে গেছে’ এর পরিবর্তে ‘ততদিনে বালক মুজিব মানুষের জন্য কাজ করার উৎসাহ পেয়ে গেছে’; সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ১১২ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মুখে গোঁফদাড়ির জঙ্গল’ এর পরিবর্তে ‘মুখে গোঁফদাড়ি’ পড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ৪টি বইয়ে এমন ৫৮টি অসঙ্গতি খুঁজে বের করেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। শুধু তা-ই নয়। কমিটির অনুসন্ধানে এই চার বইয়ে ভুলত্রুটি বেরিয়ে এসেছে আরও ১৮৮টি।
এনসিটিবি বলছে, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশসহ ৫টি উপায়ে এবারের বইগুলোর ভুলত্রুটি ও অসঙ্গতি তুলে আনা হয়েছে। ঈদের পর স্কুল খোলার আগেই যেসব ভুলত্রুটি সংশোধন করা প্রয়োজন, তা শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে পাঠানো হবে। পরে তারা শ্রেণিশিক্ষকদের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পাঠ্যপুস্তকে এ ত্রুটিগুলো সংশোধন নিশ্চিত করবেন। এ ছাড়া আগামী বছরের বইয়ে তা পরিমার্জন করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
চলতি বছর থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদান শুরু হয়েছে। ফলে বদলে গেছে পাঠ্যপুস্তক ও পাঠদান পদ্ধতি। পরীক্ষামূলকভাবে এসব শ্রেণিতে প্রণয়ন করা হয় পাঠ্যবই। এতে ধরা পড়ে নানা ভুল ও অসঙ্গতি। এ নিয়ে বছরের শুরুতেই দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠলে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি প্রত্যাহার করে নেয় এনসিটিবি।
তখন এনসিটিবি জানিয়েছিল, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ এবং ‘বিজ্ঞান অনুশীলন’ পাঠ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব কটি বইয়ের ভুল-অসঙ্গতিগুলোর সংশোধনী দেওয়া হবে। এরপর গত ৩১ জানুয়ারি পাঠ্যবইয়ের ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল হালিমকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এই কমিটি ভুল সংশোধনীগুলো খুঁজে বের করে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।
প্রতিবেদনের ৪টি বইয়ের ভুলের তালিকা এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ১০টি অসঙ্গতি, ২৫টি ভুল; সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ৪টি অসঙ্গতি ও ৫০টি ভুল; ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ে ৩৫টি অসঙ্গতি ও ৯০টি ভুল; একই শ্রেণির ‘বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ’ বইয়ে ৯টি অসঙ্গতি ও ২৩টি ভুল খুঁজে বের করা হয়েছে। ভুলগুলোর মধ্যে বানান ভুলের পরিমাণই বেশি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ১১ পৃষ্ঠার ১৫-১৭ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘রোকেয়োর’, ‘সাহাত্য’, ‘সবখানইে’, ‘সমাজার’। প্রকৃতপক্ষে তা হবে ‘রোকেয়ার’, ‘সাহিত্য’, ‘সবখানেই’, ‘সমাজের’। এই বইয়ের ৩০ পৃষ্ঠার ৫ নম্বর লাইনে শুরুকে লেখা হয়েছে ‘শুরি’, ৮৬ পৃষ্ঠার অষ্টম লাইনে নির্দেশনাকে লেখা হয়েছে ‘নির্দেশনাক্ত’, নবম লাইনে শনাক্তকে লেখা হয়েছে ‘সনাক্ত’, ১৫১ পৃষ্ঠার ত্রয়োদশ লাইনে ভিন্নকে লেখা হয়েছে ‘ভন্ন’, সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৬৬ পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় লাইনে বিশ্লেষণকে লেখা হয়েছে ‘বিশ্লেশন’, ৭০ পৃষ্ঠার ২২, ৩১ ও ৩২ নম্বর লাইনে তাজউদ্দীন আহমদের নাম লেখা হয়েছে ‘তাজউদ্দিন’, ৭৬ পৃষ্ঠার ৩৩ নম্বর লাইনে বুদ্ধিজীবীরা- এর জায়গায় লেখা হয়েছে ‘বুদ্ধিজবীরা’, ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ে চতুর্থ পৃষ্ঠার ২১ নম্বর লাইনে জিজ্ঞাসু বা অনুসন্ধিৎসু মনের জায়গায় লেখা হয়েছে ‘বৈজ্ঞানিকমন’ ইত্যাদি।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশসহ ৫টি পদ্ধতিতে এবারের বইয়ের ভুলত্রুটি ও সংশোধনী খুঁজে বের করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুলত্রুটি নিয়ে প্রকাশিত সব মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গত ১৫ ও ১৬ মার্চ এনসিটিবির কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের নির্ধারিত শিক্ষকরা দেশের ২৬টি জেলার ৫৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি কার্যক্রম পরিদর্শন করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে সংগৃহীত মতামত নেন। পাঠ্যপুস্তকের লেখকরা সুবিধাজনক একটি বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি রিপোর্ট দেন।
এ ছাড়া এনসিটিবি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক-প্রশিক্ষক এবং শ্রেণিশিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত স্বতন্ত্র কমিটি ২০ থেকে ২২ মার্চ এনসিটিবিতে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন দেন। এই ৫ সূত্র থেকে পাওয়া ভুলত্রুটিগুলো গত ২৭ থেকে ৩১ মার্চ সাভার বিসিডিএমে অনুষ্ঠিত পাঁচ দিনব্যাপী আবাসিক কর্মশালায় প্রতিটি বিষয়ের লেখক কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়। কমিটি প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য, মতামত, সংশোধনীর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সংশোধন কার্যক্রম সম্পন্ন করে।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, চলতি বছর পাঠ্যপুস্তকে যেসব ভুলত্রুটি সংশোধন করা প্রয়োজন, তার একটি তালিকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে পাঠানো হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ঈদের পর পাঠদান শুরু হলেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শ্রেণিশিক্ষকের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পাঠ্যপুস্তকে ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করা নিশ্চিত করবেন। আর আগামী বছর তা পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিতরণ করা হবে।