পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
সেলিম আহমেদ ও ইউছুব ওসমান, জবি
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৩৩ এএম
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৪৫ এএম
ছবি : সংগৃহীত
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একক ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত বাতিলের পর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। নানা জটিলতার পর গতবার রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের নির্দেশে ২২টি সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্তভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছিল। কিন্তু এবার তারাও এ প্রক্রিয়ায় যেতে চাইছে না। ইতোমধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্বভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকেও (ইউজিসি) অনানুষ্ঠানিকভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে।
গুচ্ছে যেতে অনাগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাবি, গুচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বকীয়তা হারিয়েছে। ক্লাস শুরু করতেও অনেক দেরি হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের সেশনজটের কবলে পড়তে হচ্ছে।
ইতোমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, গুচ্ছভুক্ত তিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। তবে গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা কবে হবে তা ঠিক হয়নি। এ নিয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন কমিটি এখনও কোনো সভাও ডাকেনি। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, আগামী মার্চের মধ্যে পরীক্ষা আয়োজনের চিন্তা রয়েছে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষায় অংশ নেবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তাই সংসদ নির্বাচনের পর কমিটি বসে পরীক্ষা আয়োজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
গুচ্ছে থাকতে আপত্তি
ইতোমধ্যেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে অংশ না নেওয়ার এবং নিজস্ব একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের পক্ষে অনড় অবস্থান নিয়েছে। এদের মধ্যে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে ফিরে আসার বিষয়ে বিবৃতিও প্রকাশ করেছে।
এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত আগে থেকেই চূড়ান্ত যে, একক ভর্তি পরীক্ষা না হলে আমরা গুচ্ছ পদ্ধতিতে যাব না। আমাদের শিক্ষকরা সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিছুদিন আগেও চিঠি দিয়ে সেটা ইউজিসিকে জানানো হয়েছে। যেহেতু সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে এবার একক ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না, সে কারণে এই শিক্ষাবর্ষে আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় একক ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। গুচ্ছে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই।’
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে এসব নিয়ে আলোচনা হবে। কীভাবে ভালো হবে, তা নিয়ে সবাই মতামত উপস্থাপন করবেন। সময় হলে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকরা সবসময়ই নিজস্ব একক ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে। তারা গুচ্ছে থাকতে চান না। আমরা সেটা একাধিকবার জানিয়েছি। আবারও সেটাই বলব। আমরা নিজেরা একক ভর্তি পরীক্ষা নিতে চাই।’
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একক ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেই গত বছর সবাইকে গুচ্ছে রাখা হয়েছিল। তাই একক ভর্তি পরীক্ষা না হলে গুচ্ছ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
এছাড়া আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকরা জানান, এবার সব বিশ্ববিদ্যালয়েই একক ভর্তি পরীক্ষা হবে, সেই আশ্বাসে গতবার গুচ্ছ পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছ পদ্ধতির আওতায় আনা যায়নি। অথচ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় হওয়া দরকার। সেটি না হলে এবং বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ পদ্ধতিতে না এলে স্বকীয়তা নষ্ট করে তারাও এ পদ্ধতির মধ্যে থাকতে চান না।
কোন গুচ্ছে কতটি বিশ্ববিদ্যালয়
ইউজিসির সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৫৫টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও ৪৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি শিক্ষার্থী ভর্তিযোগ্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে গতবার ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল। এবার আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এর সঙ্গে যুক্ত হবে।
এর মধ্যে চারটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানÑ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিইউপি ছাড়া বিশেষায়িত তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স, মেরিটাইম, এরোস্পেস) আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা হবে।
তিন গুচ্ছে সাধারণ ২২টি, কৃষি ৯টি ও প্রকৌশল ৩টি মিলিয়ে ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নেয়। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফলে শিক্ষার্থী একটি পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী গুচ্ছে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। গত শিক্ষাবর্ষে সাধারণ গুচ্ছে মোট আসন সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ১১৮টি। বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ২৩১টি।
‘গুচ্ছে স্বস্তির বদলে বেড়েছে সংকট’
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি, হয়রানি এবং অর্থ খরচ কমাতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তি নেমে আসার কথা থাকলেও উল্টো বেড়ে যায় ভোগান্তি। ভর্তি প্রক্রিয়ায় জটিলতা, দেরিতে ক্লাস শুরু হওয়া, মাইগ্রেশন জটিলতা, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েও শিক্ষার্থী না পাওয়াসহ নানা সংকটে আস্থা হারাতে শুরু করে এ পরীক্ষা।
বিগত সময়ের নানা বিশৃঙ্খলতাকে কেন্দ্র করে গত বছর গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় থাকবে না। সংকট সমাধানে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরে দেশের রাষ্ট্রপতি ও আচার্য ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ হতে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একক ভর্তি পরীক্ষার আওতায় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে ইউজিসিকে দায়িত্ব দেন।
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করতে দফায় দফায় বৈঠক করে ইউজিসি তৈরি করেছিল রূপরেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে অধ্যাদেশ জারির জন্য সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ সে আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যায়। ইউজিসি সম্প্রতি জানিয়েছে, অনিবার্য কারণবশত আসন্ন শিক্ষাবর্ষ থেকে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছে, বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহা এবং ইউজিসির সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বসহ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হওয়ার শঙ্কায় একক ভর্তি পরীক্ষা থেকে কর্তৃপক্ষ সরে এসেছে।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশের খসড়া পর্যালোচনা করে জানিয়েছে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের আগে ‘ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি’ (এনটিএ) গঠন করা প্রয়োজন। এই ‘এনটিএ’ গঠন করতে হলে আবার আগে আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আইন পাস করতে হলে এনটিএ গঠন, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, অফিস, প্রস্তুতিÑ এসব মিলিয়ে অনেক সময় প্রয়োজন। তাই সহসাই এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চিঠি দিয়ে গুচ্ছে না থাকার কথা জানিয়েছে। কেউ অনানুষ্ঠানিকভাবে গুচ্ছে না থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বিষয়টি জটিল হয়ে উঠতে চাইছে। আমরা দ্রুত পরীক্ষা আয়োজনের জন্য চিঠি দেব। চিঠি দিলে বোঝা যাবে কারা থাকবে বা কারা থাকবে না।’
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাছিম আখতার বলেন, ‘গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ইতোমধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান বলেন, গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বের হয়ে যাবে, এ রকম এখনও শুনিনি। আশা করছি ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেছেন, ‘একক ভর্তি পরীক্ষা না হলেও গত বছরের মতো আসন্ন শিক্ষাবর্ষেও গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে।’