সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪ ০৯:৪৭ এএম
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৪ ১১:১৮ এএম
ফাইল ফটো
নতুন কারিকুলামের মূল্যায়নে অ্যাসাইনমেন্টের পাশাপাশি আগের মতো লিখিত পরীক্ষাও যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হতো, সেই অনুযায়ী বাড়ি থেকে তা লিখে নিয়ে আসতে হতো। ফলে অভিযোগ ছিল, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা না করে ইউটিউব কিংবা বই দেখে অ্যাসাইনমেন্ট লিখে নিয়ে আসছে। এই বিতর্কের অবসান করতে লিখিত পরীক্ষা যুক্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া আগামী বছর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিনের পরিবর্তে এক দিন করা হবে। ফলে শনিবার খোলা থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে এ মাসের শুরুতে উচ্চ পর্যায়ের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে সরকার। গত ১২ মার্চ এই কমিটির প্রথম সভায় বর্তমান শ্রেণি মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কাঠামোগত অন্য কোনো বিষয় পরিবর্তন বা সংযোজন করার প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়। এনসিটি, মাউশি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রতি কমিটি এই পরামর্শ দিয়ে তা পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করার আহ্বান জানায়।
সে অনুযায়ী গত রবিবার কমিটির দ্বিতীয় সভায় এনসিটি নতুন কারিকুলামের বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে একটি রূপরেখা উপস্থাপন করে। তবে রূপরেখাটি ওই সভায় চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে শিগগিরই আরেকটি বৈঠক হবে বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, নতুন কারিকুলামের বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতিতে তিন দিনে শিক্ষার্থীদের অ্যাসেসমেন্ট করা হতো। যার নাম দেওয়া হয়েছিল অ্যাসেসমেন্ট উৎসব। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রথম দিন ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হয়, দ্বিতীয় দিনে তাদের ডাটা প্রসেস করতে দেওয়া হয় এবং তৃতীয় দিনে চূড়ান্ত ফল দেওয়া হয়।
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যা থাকবে
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এক দিনে একটি বিষয়ের মূল্যায়ন কিংবা অ্যাসেসমেন্ট হবে। অর্থাৎ স্কুল সময়ে (সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা) প্রতিদিন একটি বিষয়ের মূল্যায়ন করা হবে। মাঝখানে থাকবে এক ঘণ্টার বিরতি। ফলে এই মূল্যায়ন বা অ্যাসেসমেন্টের সময় হবে ৫ ঘণ্টা। এই পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়ভেদে এক থেকে দেড় ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা হবে।
খসড়া মূল্যায়ন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, প্রতিটি বিষয়ে মিডটার্ম ও বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে পাঁচ ঘণ্টার। পাঁচ ঘণ্টায় হবে এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাগুলোও। পাবলিক পরীক্ষা হবে অন্য কেন্দ্রে। আর চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির এ পরীক্ষা হবে নিজ নিজ স্কুলে। মিডটার্ম ও বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলোর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। এ ছাড়া ধারাবাহিক মূল্যায়ন নতুন কারিকুলামের আলোকে চলবে।
এনসিটিবি জানিয়েছে, মূল্যায়ন বা অ্যাসেসমেন্টের দিন শিক্ষার্থীদের একটি আইডিয়া বা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে। তারা সেই অনুযায়ী তাদের প্রজেক্ট তৈরি করবে। এই প্রজেক্ট তারা দলগতভাবে তৈরির সুযোগ পাবে। প্রজেক্ট তৈরির পর বিষয় বেঁধে শেষ এক বা দেড় ঘণ্টা হবে লিখিত পরীক্ষা। সেই লিখিত পরীক্ষায় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা দিতে হবে।
পাবলিক পরীক্ষা ছাড়া অন্য পরীক্ষাগুলো হবে নিজ নিজ স্কুলে। আর পাবলিক পরীক্ষা হবে সংশ্লিষ্ট পাবলিক পরীক্ষার সেন্টারে। পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাইরের অ্যাসেসর থাকবেন অর্থাৎ অন্য স্কুলের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অ্যাসেসমেন্ট করবেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা সারাদিন যে কাজ করবে তা দেখে অবজারভেশন-চেকলিস্ট অনুযায়ী তাদের অ্যাসেস করা হবে।
পরীক্ষার জন্য মার্কিং সিস্টেম থাকবে না। মূল্যায়নকারীরা ফলাফলকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করবে। মূল্যায়নে ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটের পরিবর্তে এবার ‘রিপোর্ট ভালো’, ‘অর্জনের পথে’ এবং ‘প্রাথমিক পর্যায়’— এমন তিন ভাগে ফলাফল হবে।
সাপ্তাহিক ছুটি কমছে
নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটি বর্তমানে দুই দিন। তবে সিলেবাস শেষ করতে রমজানের কয়েকদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্তও হয়। এই বছর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘটেছে লঙ্কাকাণ্ড। বিষয়টি গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। মাধ্যমিকে ১৫ দিন ও প্রথম ১০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হলে বিষয়টির বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রিট করেন এক ক্ষুব্ধ অভিভাবক। এরপর হাইকোর্ট তা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। পরে হাইকোর্টের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ দেয়। এরপর থেকে খোলা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
গতকাল মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে আগামী বছর থেকে প্রয়োজনে শনিবার স্কুল খোলা থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। রমজানের ছুটি সমন্বয় করতে বা এ মাসে স্কুল খোলা রাখা নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ করতে এ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
সর্বশেষ ওই সভায় উপস্থিত মাউশির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এনসিটিবি শুধুমাত্র নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির বিষয়টি উপস্থাপন করেছে। বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা হবে। মাউশি ও শিক্ষা বোর্ড তাদের মতামত ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করবেন। এরপর সভায় সিদ্ধান্ত শেষে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত হবে।
এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘এগুলো এখনও আলোচনার পর্যায়ে আছে। কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যে প্রস্তাবনার কথা বলা আছে, তা পাঁচ ঘণ্টা। এগুলো আমরা প্রস্তাব করেছি। যখন ফাইনাল (চূড়ান্ত) হবে, তখন আমরা জানিয়ে দেব। আগামী জুন মাস থেকেই স্কুলগুলো এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবে। এর আগেই সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যাবে।’
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষা সঠিক নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বসে পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষা দিতে হবে না। তারা সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা দলগতভাবে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করা অ্যাসাইনমেন্টের রূপরেখা তৈরি করবে। এরপর এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা হবে। এর বেশি আসলে হবে না। তার মানে পাঁচ ঘণ্টা বসে বসে তারা লিখছে, এটা কেউ মনে করলে সেটি ভুল।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিভাবকরা মনে করছেন লিখিত পরীক্ষা না দিলে তাদের সন্তানরা পড়ালেখায় মনোযোগী হবে না। তারা দীর্ঘদিন থেকে লিখিত পরীক্ষার দাবি জানিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করছেন। তাই এবার লিখিত পরীক্ষা নিয়ে আসা হচ্ছে। তবে এই লিখিত পরীক্ষা আগের কারিকুলামের মতো হবে না।’
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সভা হয়েছে। সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। আরেকটি সভা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বলেন, ‘মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে এনসিটিবি একটি উপস্থাপনা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আরও বৈঠক হবে। এরপর মূল্যায়নপদ্ধতি চূড়ান্ত হবে।’
প্রসঙ্গত, গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হয়েছিল নতুন কারিকুলামের আলোকে পাঠদান। এরপর চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবমে এবং ২০২৫ সালে নতুন কারিকুলাম চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে। নতুন কারিকুলামে এসএসসি পরীক্ষা হবে ২০২৬ সালে। নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা না থাকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে অভিভাবক মহলে। পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলনে নামেন অভিভাবকরা। তাদের দাবি মেনে নিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।