প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৪১ এএম
আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৫৮ এএম
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ
দেশের স্বাধীনতার ভিত মজবুত হয়েছে। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক
অবস্থা ছিল টালমাটাল। প্রতিদিনই চলছে মিছিল মিটিং আর সমাবেশ। ১৯৫৭ সাল, ১৩ জানুয়ারি।
পটুয়াখালী জেলায় জন্ম নেয় এক কন্যা শিশু। অধিকার আদায়ে উত্তাল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের
উত্তাল সময়ে জন্ম নেয়া সেই শিশু কণ্ঠে গানকে ধারণ করে যুগের পর যুগ প্রেম আর শান্তির
বার্তায় সুরের বন্যা নামিয়ে চলেছেন। তার নামটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠে পরিপাটি শান্ত
স্নিগ্ধ এক হাসিমুখ। তিনি কথা বললেই যেন গান হয়ে যায়। তার কণ্ঠে কবিগুরুর গান যেন মনকে
প্রশান্ত করে। বলছি সংগীতজ্ঞ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কথা।
তার বাবা মাজহার উদ্দিন খান। মা
ইসমাত আরা খান। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি অনুরাগ ছিল বন্যার। অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা
করেছেন বন্যা। সংগীত ভুবনে তার পড়াশুনা বিস্তর। তিনি রবীন্দ্রসংগীত ছাড়াও ধ্রুপদী,
টপ্পা ও কীর্তন গানের উপর শিক্ষা লাভ করেছেন। সংগীত শিক্ষার জন্য বন্যা ‘ছায়ানট’ ও পরে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
হন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতেও তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। সংগীত ভুবনে এসে রেজওয়ানা চৌধুরী
বন্যা শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, এবং আশীষ বন্দ্যোপাধায়ের
মতো সংগীতজ্ঞদের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সংগীতের
উপর তার পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন।
বন্যার কর্মজীবন বর্ণাঢ্য। অনেক
পত পরিক্রমায় বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের সহযোগী
অধ্যাপক ও নৃত্যকলা বিভাগের চেয়ারপার্সন হিসেবে কর্মরত।
১৯৯২ সালে তিনি ‘সুরের ধারা’ নামের একটি সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেন।
এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে তিনি সংগীতের শিক্ষাগুরু হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। তার
প্রতিষ্ঠান থেকে সংগীতের বিভিন্ন শাখায় দীক্ষা নিচ্ছে হাজারও শিক্ষার্থি।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি রবীন্দ্রগানের
শিল্পী হিসেবে দুই বাংলাতেই জনপ্রিয়তা পান। তার ২০টির মতো গানের অ্যালবাম পশ্চিম বাংলা
ও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা তার সংগীতচর্চার
দীর্ঘ এই যাত্রা নিয়ে বলেন, ‘আমি আজীবন গান ভালোবেসেছি। গানকেই জীবনের ব্রত করে নিয়েছি।
অনেক প্রাপ্তি আর মধুমাখা স্মৃতিতে ভরে আছে জীবন। পেছনে তাকালে আবেগে ভেসে যাই। কখনোই
কোনা পথচলা সহজ নয়। কঠিন পথেই বরং সাফল্য পাওয়াটা আনন্দের। যারা আমার এই যাত্রার সঙ্গী
ছিলেন সবাইকে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। দোয়া চাই যেন সুস্থ থাকি। দেশের সংগীতচর্চায়
যেন আমৃত্যু নিজেকে নিবেদিত রাখতে পারি।’
বন্যা তার সংগীত জীবনে দেশ-বিদেশে
বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কাজের অবদানের
স্বীকৃতিস্বরূপ রেজওয়ান চৌধুরী বন্যা ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার সম্মাননা পেয়েছেন।
২০১৭ সালে ভারত সরকার তাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বঙ্গভূষণ’ পদক দিয়ে সম্মানিত করে। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
‘ফিরোজা বেগম স্মৃতি স্বর্ণপদক ট্রাস্ট ফান্ড’ কতৃক প্রদত্ত ‘ফিরোজা বেগম স্মৃতি স্বর্ণপদক ও
পুরস্কার ২০১৭’ পেয়েছেন এই প্রখ্যাত
এই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী।
সম্প্রতি তিনি ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ
অসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’
পদক পেয়েছেন। শিল্পকলা, শিক্ষা, বাণিজ্য, সাহিত্য, বিজ্ঞান, খেলাধুলা, সমাজসেবা ও সরকারি
ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ভারত সরকার শিল্পীকে এই সম্মান প্রদান করেছে। এরপর থেকেই
দেশে-বিদেশে অনুরাগীদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি। গত সোমবার সন্ধ্যায় রেজওয়ানা
চৌধুরী বন্যার বাসায় গিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছে সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ। সংগঠনটির
পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান দুই মহাসচিব গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ও সংগীতশিল্পী
নকীব খান। এ সময় তাদের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির প্রচার ও প্রকাশনা সচিব জাতীয়
চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকবি জুলফিকার রাসেল। বন্যা নিজে এই সংগঠনের সভাপতি।
বন্যা বলেন, ‘আমি সত্যি খুবই আপ্লুত।
অন্য কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়াটাকে জীবনের অনন্য প্রাপ্তি মনে করছি। ভারতে
অনেক গুণী সংগীতজ্ঞ রয়েছেন। তাদের ভিড়ে পদ্মশ্রী পাওয়াটা আমাকে প্রেরণা দিচ্ছে। আর
সংগীত ঐক্যের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। তারা চমৎকার আয়োজন করে আমাকে সম্মানিত করলেন। আমি যে
স্বীকৃতি পেয়েছি সেটা যে আমার একার নয়, তারা তারা অনুধাবন করালেন। সংগীত ও সংগীতের
মানুষের জয় হোক।’
একজন লেখক হিসেবে রেজওয়ানা চৌধুরী
বন্যার সমাদৃত। সঙ্গীত নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা রয়েছে তার। রবীন্দ্রনাথ: গানের নানা দিক,
গানের ভেলায় বেলা অবেলায়, ছোটদের নির্বাচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি তার লিখিত
তিনটি বই।