রাজু আহমেদ, রাজশাহী
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৭ এএম
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩৯ পিএম
রাজশাহীর একটি বরজে পানের পরিচর্যা করছেন এক কৃষক। প্রবা ফটো
দেশজুড়ে আমের উৎপাদনের কারণে পরিচিত রাজশাহী। কিন্তু অঞ্চলের আরেক কৃষিপণ্য মিষ্টি পানের কথা তেমন আলোচনায় আসে না। কিন্তু বাজার কেন্দ্রিক তুলনায় দেখা যায়, রাজশাহীর আমের চেয়েও বড় বাজার পানে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতি বছর রাজশাহীতে উৎপাদিত পানের বাজার মূল্য প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, যা এই অঞ্চলে উৎপাদিত আমের বাজারের চাইতেও বড়।
পানকে বলা হয় ‘ক্যাশ ক্রপ’ বা অর্থকরী ফসল। আর কৃষকদের কাছে পানের বরজ হলো অনেকটা ব্যাংকের মতো। যখন প্রয়োজন হয় তারা বরজ থেকে পান তুলে সরাসরি বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, এক বিঘার একটি পানের বরজ থেকে একজন কৃষক মাসে অন্তত ৩৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। প্রতি বিঘা জমিতে পানের বরজ তৈরিতে কৃষকের এককালীন খরচ হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। যার স্থায়িত্বকাল হয়ে থাকে ৩০ থেকে ৪০ বছর। রাজশাহী জেলায় পান চাষে জড়িত কৃষকের সংখ্যা ৩৯ হাজার ১০১ জন। গত ৫ বছরে রাজশাহী জেলায় পানের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ। ২০১৮ সালে পানের আবাদ হতো আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে পান উৎপাদন হয়েছে ৭৭ হাজার ২১৯ মেট্রিক টন। ৯টি উপজেলার মধ্যে বাগমারা, মোহনপুর ও দুর্গাপুরে পানের আবাদ বেশি হয়। পান বরজের সংখ্যা ৩৯ হাজার ৮৭৬টি। এসব বরজে উৎপাদিত পান জেলার ২০টি হাটে সরাসরি বিক্রি করে থাকেন কৃষকরা।
মোহনপুর উপজেলার কৃষক লুৎফর রহমান বাড়ির পাশে ১০ কাঠা জমিতে পাটখড়ি আর খড় দিয়ে বরজ বানিয়ে পান চাষ করেন। তিনি পানের বরজকে ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, গড়ে ১৫ দিন পর একবার পান তোলা হয়। এক দিনে তিন পণ পান তোলা হয়। মৌসুমে যার বাজার মূল্য দশ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এক যুগ আগে আমার গ্রামে ১২ জনের পানের বরজ ছিল। বর্তমানে আছে ৫০ থেকে ৬০ টা।
বাগমারা উপজেলার কৃষক আক্কাস আলী বলেন, পানের বরজ একবার দিলে ২০ থেকে ৩০ বছর আর চিন্তা করা লাগে না। বরজে পাটখড়ি বা খড় পচে গেলে মাঝেমধ্যে সংস্কার করে নিতে হয়। বর্ষার সময় সমস্যা হয়। পানে কীটনাশক ব্যবহার করা যায় না। সার বা কীটনাশক হিসেবে খইল দিতে হয়। বরজে সরাসরি কীটনাশক ব্যবহার হলে ওই পান মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে। তাই এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়।
রাজশাহী জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, রাজশাহীর দুর্গাপুর, মোহনপুর এবং বাগমারায় মিষ্টি পান উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বেশ চাহিদা রয়েছে এখানকার মিষ্টি পানের। ‘রাজশাহীর মিষ্টি পান’ জিআই স্বীকৃতি পেলে কৃষকরা আরও উপকৃত হবে।
নিরাপদ পান উৎপাদনের ভূমিকা তুলে ধরে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, পান মানুষ সরাসরি খায়। ভূ-উপরিস্থ পানিতে মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র থাকে। এই পানি পানের সেচে ব্যবহার নিরাপদ নয়। এই পানিতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তাই সেচে নিরাপদ পানি ব্যবহারের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় একটি জায়গা কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করে গেছে। জমি নির্ধারণ করা হয়েছে এখানে একটি পান গবেষণাগার নির্মাণের জন্য। পানের বরজে নানা রোগবালাই দেখা দেয়। এই গবেষণাগার চালু হলে কৃষকরা উপকৃত হবে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, রাজশাহীর মিষ্টি পান সারা দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। রাজশাহীতে উৎপাদিত পান প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হয়। রেশম ও আমের পাশাপাশি পানও যে অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সে কারণে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দুই মাস আগে আমরা আবেদন করি। জিআই সনদ পেলে আমাদের পান দেশ-বিদেশে আরও সমাদৃত হবে। পান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে। যা অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।