× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্বীকৃতির গোলকধাঁধায় নারীর শ্রম

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:৩৭ পিএম

আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:২৭ পিএম

স্বীকৃতির গোলকধাঁধায় নারীর শ্রম

বাইরে তো কাজ করতে হয় না তোমাকে, সারা দিন বাসায় থাকো। টুকটাক রান্নাবান্না করো আর বাচ্চাদের দেখভাল- তুমি কি করে বুঝবে টাকা আয় করা কত কষ্টকর। এসব কথা শুনতে হয়নি এমন মেয়ে বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদিও-বা এহেন পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, তবে তার মাত্রা কতটুকু? চাঁটগায়ের শারমিন, ঢাকার সুমি, রাজশাহীর নিপু, খুলনার টিয়া, সিলেটের সুস্মিতা, রংপুরের ইশরাত, ময়মনসিংহের তহুরা- সবার গল্প একই। কাজের সূত্রে দেশের প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাদের কথায় একটা বিষয় পরিষ্কার, আমাদের সমাজে নারীর শ্রমের স্বীকৃতির অভাব এবং বৈষম্যে ভরা। 

শুধু তাই নয়, খেয়াল করলে দেখা যায়, সাধারণত একটি পরিবারে কোনো সন্তান ভালো কিছু করলে মায়ের কথা সচরাচর কেউ বলে না। বলা হয় বাবার কথা। বাবার মতো হয়েছে, বাবার মতো করেছে। পুরনো প্রচল প্রবাদÑ ‘বাপকে বেটা’। এমনকি পরিবারে সন্তানের বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও মায়ের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনবোধ করে না কেউ। ভাবা হয় সন্তান জন্মদানই শুধু নারীর কাজ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজে নারী অপারগ। শুধু সন্তান নয়, পারিবারিক যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর মতামত জানতে চাওয়া হয় না। 

আমাদের পরিবারে একজন নারী নিজেকে যেভাবে দেখতে বাধ্য হয় তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মুক্তি’ কবিতায় লিখেছেন-

এইটে ভালো, ঐটে মন্দ, যে যা বলে সবার কথা মেনে,

নামিয়ে চক্ষু, মাথায় ঘোমটা টেনে,

বাইশ বছর কাটিয়ে দিলেম এই তোমাদের ঘরে।

তাই তো ঘরে পরে,

সবাই আমায় বললে লক্ষ্মী সতী,

ভালো মানুষ অতি!

পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। গৃহস্থালির কাজকর্ম থেকে বাইরে এসে উপার্জন করতে একজন নারীকে হাজারটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। যদিও-বা নারী উপার্জনে বের হয়, তাকে ঘরের সমস্ত কাজ ঠিকঠাক মতো পালন করেই বের হতে হয়। রান্না, ঘর পরিষ্কিার, কাপড়চোপড় ধোয়া, বাচ্চা সামলানো- এসব শুধুই পরিবারের নারীটির কাজ। খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখে এসেছি, মেয়েশিশুটিকে শেখানো হয় কীভাবে রান্না করতে হয়, ঘর পরিষ্কার করতে হয় আর পরিবারের ছেলেশিশুটির হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ফুটবল। তাদের শেখানো হয় কীভাবে বাজার করতে হয়, সংসারের হাল ধরতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক বলয়ে, যুগের পর যুগ ধরে এমনটাই চলে এসেছে। 

দেশের উন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান অসীম। অথচ কোথাও তার কোনো স্বীকৃতি নেই। খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত খেয়াল করলে দেখা যাবে, নারীর অবস্থান পুরুষের পরে। ক্ষেত্রবিশেষে নারীর কন্ট্রিবিউশন পুরুষের চেয়ে বেশি থাকলেও তাকে দেখা হয় পুরুষের নিচে। কখনই বলা হয় না নারী-পুরুষ সমান।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পৃথিবীর মোট কাজের তিন ভাগের দুই ভাগ সম্পন্ন করে; কিন্তু ১০ ভাগের এক ভাগ মাত্র ভোগ করে। অথচ নারীকে সব সময় ভোগকারী হিসেবেই দেখা হয়। আদতে নারী যে অনুপাতে ভোগ করে, তার সমানুপাতে উৎপাদনও করে। আমাদের সমাজে নারীকে সব সময় পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হিসেবেই দেখা হয়। একই সঙ্গে মনে করা হয়, নারী পুরুষের অধস্তন। এই সমাজে নারীটিও পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। নারী নিজেও তার গর্ভজাত সন্তানের লিঙ্গ পরিচয়ের মাধ্যমে সন্তানের প্রতি আচরণ নির্ধারণ করে। যেমন- পরিবারের সন্তানটি যদি হয় ছেলে তবে তাকে পরিবারের ‘বংশ প্রদীপ’ হিসেবে বড় করা হয় আর মেয়েটিকে দেখা হয় পরের বাড়ির সম্পত্তি হিসেবে। বিয়ের আগে পরিবারের অভিভাবকরা মেয়েটির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে, বিয়ের পরে এই দায়িত্ব পালন করবে তার স্বামী। ফলে মেয়েটির খুব বেশি লেখাপড়া না করলেও হবে। পরের বাড়ির সংসার দেখভাল করতে পারলেই হবে তার উচ্চতর শিক্ষা! শহরে এই চিত্রের কিছুটা পরিবর্তন হলেও দেশজুড়ে চিত্র একই।

ঘরের বাইরে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রেও নারীর উপস্থিতি বাড়ছে। যা আগে ভাবাই যেতো না। তবুও আমরা কোথায় যেন আটকে আছি, নারীকে ঘরের কাজের বাইরে অন্য কোথাও দেখে খুব একটা স্বস্তিবোধ করি না। একজন নারীকর্মী কাজ শেষে রাত করে বাড়ি ফিরলে তাকে পথে পথে এবং পদে পদে যত ধরনের হেনস্তার শিকার হতে হয়, সে তুলনায় পুরুষকে তার সিকিভাগও সহ্য করতে হয় না। একজন কর্মজীবী নারীর পথ আটকে দিতে তার চরিত্র নিয়ে তৈরি হয় নানারকম মুখরোচক গল্প, তার চরিত্র নিয়ে চলতে থাকে নানারকম রটনা। নারী একজন মানুষ, এই কথাটা কর্মক্ষেত্রে এক সময় গৌন হয়ে যায়, মুখ্য হয় নারীর রক্ত-মাংসের শরীর। তাকে নিয়ে নানারকমের যৌনগন্ধি আলাপের মসলা বাটা হয়, যা তার চারপাশ শেকলের মতো ঘিরে ধরে। এসব আলোচনা তাকে উন্নয়নের পথ থেকে পিছন দিকে টানে।

নারী শারীরিকভাবে পুরুষের তুলনায় দুর্বল- এই আলাপ দিয়ে যুগের পর যুগ ধরে নারী ও পুরুষের কাজের বিভাজন হয়ে আসছে। সমাজে একটা অংশের ধারণা, ভারী কাজ মেয়েদের জন্য নয়। কারণ মেয়েদের শক্তি কম- তারা নরম-কোমল-পেলব-মসৃণ। এমনকি প্রতি মাসে হওয়া নারীর পিরিয়ডকেও দুর্বলতা হিসেবে ধরা হয়। যদিও পিরিয়ড একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যার ওপর নারীর শারীরিক শক্তি নির্ভর করে না। 

২০২০ সালে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ১ কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবার অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে। তবে শিল্প খাতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়লেও মজুরি বাড়েনি। তারা যে মজুরিতে কাজ করেন, সেটা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। মূলত তাদের নেওয়াই হয় সস্তা শ্রমের জন্য। বাংলাদেশে কৃষিক্ষেতে প্রায় ৯০ শতাংশ নারী কাজ করছেন। এর মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ নারী বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। দেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদানের যে পরিসংখ্যান তা একটি অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যান। এখন পর্যন্ত এখানে নারীর অবদানের তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই। ক্ষেত্রবিশেষে কোথাও কোথাও কিছুটা উন্নয়ন ঘটছে, তবে সেটাও যে খুব বেশি- এ কথা বলা যাচ্ছে না। 

আবারও চলে আসি গৃহস্থালিতে। এখনও বাইরে থেকে ক্লান্ত হয়ে এলে পুরুষটির জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, যা নারীর জন্য এক বিরল দৃশ্য। মেঝেতে বিছিয়ে দেওয়া পাটির ওপর বসে স্বামী খাচ্ছে আর নারী তাকে তালাপাখার বাতাস দিচ্ছে- এই চিরচেনা দৃশ্য যেমন গ্রামে, তেমনি নগরের ডাইনিং টেবিলেও। নারী তার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিল তিল করে সমৃদ্ধ করছে তার পরিবার। অথচ সমতার ক্ষেত্রে, অধিকারের ক্ষেত্রে নারীর নামটি পুরুষের পাশাপাশি উঠে আসে না কখনও। যতদিন পর্যন্ত সমাজে লিঙ্গ সমতা না আসবে, ততদিন পর্যন্ত পরিবার-সমাজ-অর্থনীতিতে নারী তার শ্রমের অধিকারের যথাযথ স্বীকৃতি পাবে না। 

পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই, একজন নারী কখনই চায় না কাজ শেষে এসে যখন ঘরে ফিরবে- কেউ তার জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুক। সে শুধু চায় তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু। ঘরে এবং বাইরে যে শ্রম দিচ্ছে, তার শ্রমের স্বীকৃতিটুকু। যেদিন সে তার শ্রমের স্বীকৃতি পাবে, সেদিন থেকে সমাজ সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের পথে হাঁটবে। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা