× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হাজারি গুড়ের দেশ ঘুরে

শওকত আলী রতন

প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৫৭ পিএম

আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:২১ পিএম

হাজারি গুড়ের দেশ ঘুরে

মানিকগঞ্জের প্রসিদ্ধ হাজারি গুড়, ইচ্ছা ছিল এ গুড় তৈরির প্রক্রিয়া সামনাসামনি দেখার। প্রিয় বন্ধু আজিজকে সঙ্গে নিয়ে হাজারি গুড় দেখার জন্য আমরা মানিকগঞ্জ যাওয়ার মনস্থির করি। ১১ জানুয়ারি বুধবার সকাল ৭টার দিকে ঢাকা থেকে রওনা দেন আজিজ। ৯টার আগেই পৌঁছে যান নবাবগঞ্জ উপজেলার মাঝিরকান্দায়। মাঝপথ থেকে আজিজের সফরসঙ্গী সই আমি। মাঝিরকান্দা থেকে দুজনে ইজিবাইকে চেপে ১০টার মধ্যে পৌঁছে যাই নবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী ঘোষাইল বেড়িবাঁধ এলাকায়।

ইজিবাইক পিচঢালা পথ ধরে চলে তার আপন গতিতে। চলার সময় রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়ে সারিসারি সরিষার ক্ষেত। দূর থেকে দেখে মনে হয়, সরিষা ফুলের হলদে রঙে পুরো এলাকা হলুদে ছেয়ে গেছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা চলার পর আমাদের বাহন পৌঁছে যায় ঝিটকা বাজারে।
বাজারটি অতিপ্রাচীন। ঝিটকা বাজারে গিয়ে আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে জেনে নিই হাজারি গুড়ের গ্রামে যাওয়ার ঠিকানা। স্থানীয়রা হাজারি গুড় তৈরির গ্রামকে গাছিপাড়া নামে জানেন। হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা বাজার থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরেই ঝিটকা সিকদারপাড়া। এ গ্রামেই তৈরি হয় বিখ্যাত হাজারি গুড়। গুড় তৈরির জন্যই এ এলাকার রয়েছে বিশেষ পরিচিতি। ঝিটকা বাজার থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই গাছিপাড়ায়। রিকশা থেকে নেমেই রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়ে সারিসারি খেজুরের গাছ। পাশেই খেজুরের গাছ কাটা গাছিদের কর্মযজ্ঞ। তখন প্রায়দুপুর।
এ সময়টায় সাধারণত গাছিরা খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য হাঁড়ি পাতার কাজটি করেন। শীত মৌসুমে ভোর থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে খেজুরের রস সংগ্রহের নানান কর্মযজ্ঞ। তবে এ কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা বিশেষ সহযোগিতা করে থাকেন। কয়েকজন গাছির সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।
জানা যায়, বংশপরম্পরায় এ কাজটি করে যাচ্ছেন বর্তমান বংশধরেরা। নানা প্রতিকূলতায় এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই। তবে বংশীয় মর্যাদা হাজারি গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় গাছিপাড়ায় এখনও ২০টির মতো পরিবার কাজ করে যাচ্ছে। গাছিপাড়ার সবাই নিজেদের তৈরি গুড়ে হাজারির সিল ব্যবহার করেন। তবে আশপাশ গ্রামের অনেকেই অন্য নাম ব্যবহার করে গুড় বিক্রি করেন। মূলত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি- এ চার মাস খেজুরের রস থেকে হাজারি গুড় তৈরি হয়। দেশের অন্যান্য এলাকায় খেজুর রসের গুড় তৈরি হলেও এখানকার গুড় স্বাদেগন্ধে অতুলনীয়।
রস সংগ্রহ করে ফিরছেন আজমত আলী হাজারি 
ঝিটকা সিকদারপাড়ার গাছি জাহিদ হাজারি জানান, বংশপরম্পরায় তিনি এ পেশায় রয়েছেন ৩০ বছর ধরে। প্রতিদিন ২৫-৩০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। দেশের অনেক অঞ্চলে খেজুরের গুড় তৈরি হলেও হাজারি গুড়ের মতো গুড় তৈরি করতে পারে না। এজন্য এ গুড়ের কদর সারা দেশের মানুষের কাছে। অনেকে নকল গুড় তৈরি করে হাজারি পরিবারের নামে চালিয়ে দেন বলেও জানান তিনি।
আজমত আলী হাজারি জানান, ১৫-২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গুড় তৈরি করতে হয়। আগের দিন বিকালে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে রস সংগ্রহ করে ছেঁকে চুলা জ্বালিয়ে মাটির পাত্রে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় হাজারি গুড়। তবে এ পদ্ধতি এখন আর হাজারি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ গুড় দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও সুস্বাদু। রঙ ও স্বাদের কারণেই হাজারি গুড়েরেএত সুখ্যাতি।
আজমত আলী হাজারি আরও জানান, ‘মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া হাজারি গুড় তৈরি করা যায় না। এ জন্য রস সংগ্রহের সময় বাড়তি সতর্ক থাকতে হয়। প্রতি কেজি হাজারি গুড়ের বর্তমান বাজার মূল্য ১ হাজার ৬০০ টাকা।’ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে লোকজন গুড় সংগ্রহ করে নিয়ে যান বাল্লা ইউনিয়নের ঝিটকা গাছিপাড়া থেকে।
হাজারি গুড় নিয়ে নানা কল্পকাহিনির কথা শোনা যায়। প্রায় ২০০ বছর আগে ঝিটকা গ্রামে হাজারি প্রামাণিক নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। হঠাৎ একদিন বিকালে খেজুর গাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ তার কাছে রস খেতে চান। তখন ওই গাছি দরবেশকে বলেছিলেন, সবে গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এই অল্প সময়ে হাঁড়িতে রস জমা হয়নি। তবু দরবেশ তাকে গাছে উঠে হাঁড়ি নামিয়ে রস খাওয়ানোর আকুতি জানান।
দরবেশের রস খাওয়ার ইচ্ছায় গাছি গাছে উঠে দেখতে পান কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই পুরো হাঁড়ি রসে ভরে গেছে। হাজারি প্রামাণিক সেই রস দরবেশকে খাওয়ান। রস খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে দরবেশ দোয়া করেন তাকেÑ ‘তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে’, এই বলে দরবেশ দ্রুত চলে যান। ওই দিন থেকে হাজারি প্রামাণিকের নামেই এ গুড়ের নামকরণ হয় ‘হাজারি গুড়’।
ঝিটকা বাজারে বিক্রি হচ্ছে হাজারি গুড়
এছাড়াও কথিত আছে, ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ এ গুড় খেয়ে অনেক প্রশংসা করেছিলেন এবং খুশি হয়ে গুড় তৈরির পর ব্যবহার করার জন্য একটি সিল উপহার দিয়েছিলেন। তখন থেকেই গুড়ে হাজারি পরিবার সিলটি ব্যবহার করে আসছে।
এখানকার উৎপাদিত গুড়ের হাট বসে ঝিটকা বাজারে। আগে সপ্তাহে এক দিন অর্থাৎ শনিবার হাট বসত। এখন প্রতিদিনই বাজারে গুড় পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুড় কেনা ও গুড় বানানো দেখার জন্য এখানে আসেন দর্শনার্থীরা। এজন্য শীত মৌসুমে বাল্লা ইউনিয়নের সিকদারপাড়া মানুষের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। 
ঢাকার গুলিস্তান থেকে মানিকগঞ্জে বাস চলাচল করে। সেখান থেকে লোকাল বাসে ঝিটকা। ঝিটকা থেকে রিকশা সরাসরি গাছিপাড়ায় চলে আসতে পারেন। 
প্রতি কেজি খাঁটি হাজারি গুড় বিক্রি হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। তবে হাজারি গুড়ের আদলে অন্য গুড়ও তৈরি করা হয়। সেগুলো বিক্রি হয় বিভিন্ন দামে। খুব সকালে গিয়ে গুড় তৈরির সময় কেনা গেলে ভেজালমুক্ত গুড় পাওয়া সম্ভব।
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা