সাহিদা আক্তার
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:১৫ পিএম
বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কথা উঠলে যাঁর নাম সমগ্র পৃথিবী একবাক্যে স্মরণ করে, তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। আফ্রিকানরা তাঁকে ডাকে ‘মাদিবা’ বলে। তাঁর দেওয়া একটি বক্তৃতা পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন সাহিদা আক্তার
আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি শুধু তরুণদের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানাতে। কেননা বর্ণবৈষম্যের অচলায়তন ভেঙে এই তরুণরাই আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। বর্ণবাদবিরোধী বিপ্লবের অগ্রভাগে থেকে তারা নেতৃত্ব দিয়েছে। মুক্তি বা স্বাধীনতা যখনই ইশারায় ডেকেছে, তখনই এই তরুণরা, মানে তোমরা সাড়া দিয়েছ। এই তোমরা মৃত্যুকে বলেছ, কুছ পরোয়া নেহি! মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে বুলেটের আঘাতকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছ তোমরা। বিপ্লবের ময়দান থেকে তোমরা কখনই পিছু হটনি। একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন জাতি গঠনের আহ্বানে তোমরা সাড়া দিয়েছ দ্বিধাহীনভাবে।
তোমরা এসব করেছ নিজেদের জন্য, জাতির জন্য। অথচ বিনিময়ে তোমরা বিশেষ কোনো সুবিধা চাওনি। এমনকি আজও চাইছ না। তাই আজ আমি কৃতজ্ঞচিত্তে বলতে চাই, আমরা সবাই তরুণদের কাছে ঋণী। তোমাদের সহযোগিতা ছাড়া এ জাতি সফল হতে পারবে না। কারণ, তোমরা তরুণরাই জাতির কর্ণধার।
আমি আবারও বলি, আমরা ঋণী তরুণদের কাছে, যারা জাতির জন্য অকাতরে নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে। তারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের জন্য, যেন সবাই উন্নত ও সুখী জীবনযাপন করতে পারে। ২০ বছর আগের সেই দিন, ১৬ জুন ১৯৭৬, নিদ্রামগ্ন জাতিকে তোমরা তরুণরা সেদিন জাগিয়ে তুলেছিলে। তখন বর্ণবৈষম্যের শাসনব্যবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল ক্রীতদাস। তোমরা সেই তরুণ, যারা সেদিন নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে দাসত্ব থেকে জাতিকে এনে দিয়েছিলে মুক্তি। বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে তোমরা পাল্টে দিয়েছ ইতিহাসের গতিপথ।
আমাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দারিদ্র্যকে জয় করা। ঘরহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ এখন অশিক্ষা আর অজ্ঞানতাকে জয় করা। পৃথিবীটা দিনকে দিন ছোট হয়ে আসছে। আমাদের দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে। উদ্ভাবনের দিকে আমাদের উন্নতি করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক পণ্য উৎপাদন করতে হবে এবং এসব চ্যালেঞ্জ আসলে তরুণদেরই মোকাবিলা করতে হবে। যখন শহর আর গ্রাম থেকে তোমরা প্রকৌশলী, পদার্থবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে উঠবে এবং এই সংখ্যাটা ধীরে ধীরে বাড়বে, তখনই আমরা বলতে পারব, আমরা উন্নতি করছি। এ জন্য যত ধরনের সুযোগসুবিধা তোমরা পাবে, তা ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাবে।
জাতির জন্য চাই কর্মঠ ও পরিশ্রমী তরুণ। দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে তরুণদের ওপর, তোমাদের ওপর। তোমরাই পার, তোমাদের নিরলস পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় নিজ জাতিকে সবচেয়ে সফল, সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে। জাতি গঠনের এ লক্ষ্যটা পূরণ করতে তোমাদের কাজ করতে হবে পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে।
যেসব তরুণ এখনো বেকার রয়েছ, তাদের বলি, তোমরা হতাশ হইয়ো না। সুযোগকে কাজে লাগাতে শেখো। বড় হোক ছোট হোক, কাজে যোগ দাও। অন্যের ওপর নির্ভর করো না। নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে। নিজের জন্য নিজেই সুযোগ তৈরি করো। সরকারের দেওয়া ছোট কোনো কাজÑ হতে পারে সেটা কৃষিকাজ, তুমিও যোগ দাও।
তোমরা আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। তোমরা দুঃসাহসের প্রতীক। তোমাদের ত্যাগ ও বীরত্ব কখনও ভোলার নয়। তোমাদের মতো সংগ্রামী তরুণদের জন্য আমাদের বুক স্ফীত হয়ে ওঠে। আজকের দিনে প্রতিটি জাতির জন্য এমন দুঃসাহসিক তরুণ-যুবাদের আরও বেশি প্রয়োজন। তোমরা সাহসী হও। শেখায় মনোযোগ ঢেলে দাও। নিজেদের দক্ষতা বাড়াও। মতৈক্য গড়ে তোলো। জাতির ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতেই। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে তোমরা এই জাতির ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করো, আলোকিত করো। তোমাদের জন্য শুভ কামনা।
স্বাধীনতা অর্জনের কোনো সহজ পথ নেই। গোটা জীবনটা আমি উৎসর্গ করেছি আফ্রিকার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে। আমি শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি এবং লড়েছি কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও। তোমরা তরুণেরা বাঁধার দেয়াল ভেঙে ফেল।
আমি লালন করি সেই গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের স্বপ্ন, যেখানে সবাই শান্তি ও সৌহার্দে থাকবে এবং কোনো বৈষম্য থাকবে না। নেতৃত্ব সম্পর্কে বিজয় উদযাপনকালে ও সুসময়ে পেছন থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ভালো, অন্যদের ভাবতে দিতে হবে যে তারাই সামনে আছে। তুমি তখনই সামনে আসতে পারো যখন সম্মুখে বিপদ; তাহলেই জনগণ তোমার নেতৃত্বকে মূল্যায়ন করবে। তুমি যদি সাধারণ ভাষায় মানুষের সঙ্গে কথা বলো, তাহলে সে কথা বুঝবে; সে কথা মাথায় ঢুকবে। আর তুমি যদি তার ভাষায় কথা বলো, তাহলে সেটা তার হৃদয়ে গেঁথে যাবে।
এই আদর্শকে আমি অর্জনে রূপ দেওয়ার ইচ্ছা রাখি। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, তবে এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।